
পদ্মা সেতু বাংলাদেশের মানুষের স্বপ্ন।
পদ্মা সেতু আজ স্বপ্ন নয়, বাস্তব। বাংলাদেশের সামগ্রিক উন্নয়নের প্রতীক। বাংলাদেশের
গর্ব ও অহংকারের প্রতীক। সক্ষমতার প্রতীক। দেশের সামগ্রিক উন্নয়নের মাইলফলক। এ স্বপ্নের
পদ্মা সেতুর শুরুর বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ায় আমি সম্পৃক্ত ছিলাম। যোগাযোগমন্ত্রী হিসেবে
আমি দ্রুত প্রস্তুতিকাজ প্রায় শেষ করেছিলাম। সততার সাথে দায়িত্বপালন করেছিলাম। কাজে
কোন গাফিলতি প্রদর্শন করিনি। রাতদিন পরিশ্রম করে পদ্মা সেতুর বাস্তবায়নকে সম্মুখে এগিয়ে
নিয়েছি। পদ্মা সেতুকে ঘিরে আমার সততা নিয়ে যে অপবাদ দেওয়া হয়েছে তা ছিল সম্পূর্ণ মিথ্যা
এবং উদ্দেশ্যমূলক। পরিকল্পিত একটি প্রপাগান্ডা। আওয়ামী লীগের উন্নয়ন রাজনীতিকে স্তব্ধ
করার একটি নীলনকশা। দুদকের তদন্ত এবং ২০১৭ খ্রিষ্টাব্দে কানাডা আদালতের রায়ে অভিযোগ
ভিত্তিহীন প্রমাণিত হয়। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ষড়যন্ত্রকারীদের উদ্দেশ্য
ভালোভাবেই বুঝতে পেরেছিলেন। নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের ঘোষণা দিয়ে তিনি
ষড়যন্ত্রকারীদের ষড়যন্ত্র রুখে দিয়েছিলেন। আজ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাহস, বিচক্ষণতা,
দৃঢ়চেতা মনোভাব ও রাষ্ট্রনায়োকচিত নেতৃত্বের কারণে পদ্মা সেতু দৃশ্যমান। দেশি-বিদেশি
সকল ষড়যন্ত্র, বানোয়াট, মনগড়া ভিত্তিহীন অভিযোগকে মিথ্যা প্রমাণিত করে আজ পদ্মা সেতু
দাঁড়িয়ে আছে। এই সেতু দক্ষিণ এশিয়া-সহ বিশ্বে শেখ হাসিনার রাজনৈতিক ও দেশের অর্থনৈতিক
অবস্থানকে সুসংহত ও মজবুত করেছে।
পদ্মা
সেতু নির্মাণের উদ্যোগ ও আওয়ামী লীগ
বঙ্গবন্ধু সেতু দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন
ও উত্তরাঞ্চলের সঙ্গে রাজধানী-সহ পূর্বাঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থায় প্রভূত অবদান রাখে।
এই পরিপ্রেক্ষিতে দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জনগণ অবাধ সড়ক যোগাযোগ প্রতিষ্ঠার
জন্য প্রমত্তা পদ্মা নদীর ওপর সেতু নির্মাণের জন্য দীর্ঘকাল হতে দাবি জানিয়ে আসছিল।
দীর্ঘ ২১ বছর পর ১৯৯৬ খ্রিষ্টাব্দে আওয়ামী লীগ বিপুল জনপ্রিয়তা নিয়ে সরকার গঠন করে
এবং ১৯৯৮ খ্রিষ্টাব্দে পদ্মা সেতু নির্মাণের উদ্যোগ নেয়। ১৯৯৯ খ্রিষ্টাব্দে প্রাক-সম্ভাব্যতা
যাচাইয়ের মধ্য দিয়ে পদ্মা সেতু নির্মাণের পরিকল্পনা শুরু হয়। ২০০১ খ্রিষ্টাব্দের ৪ঠা
জুলাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মাওয়া পয়েন্টে (বর্তমান সেতুর অবস্থানে) পদ্মা সেতুর
ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। ইআরডি ফিজিবিলিটি স্টাডির জন্য অর্থ সংগ্রহের উদ্যোগ নেয়।
এক পর্যায়ে জাপান সরকার ইআরডির প্রস্তাবে সম্মত হয় এবং ২০০১ খ্রিষ্টাব্দের ১৮ই জুন
নোট-ভারবালে স্বাক্ষর করে। এর ধারাবাহিকতায় ২০০১ খ্রিষ্টাব্দের ৪ঠা ডিসেম্বর বাংলাদেশ
ও জাপানের মধ্যে সমীক্ষা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।
‘বিএনপি’-র ৫ বছর: পদ্মা সেতুর ‘নো
প্রগ্রেস’
২০০১ খ্রিষ্টাব্দের শেষের দিকে বিএনপি
রাষ্ট্রক্ষমতায় আসে। ক্ষমতায় এসে তারা সেতুর কার্যক্রম এগিয়ে না নিয়ে সেতুর পূর্ব-নির্ধারিত
স্থান পরিবর্তনে চেষ্টা করে। যেহেতু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মাওয়া পয়েন্টে ভিত্তি
প্রস্তর স্থাপন করেছেন, সেজন্য এ জায়গায় পদ্মা সেতু না করার জন্য বিএনপি সমীক্ষার নামে
৫ বছর কালক্ষেপণ করে। ‘বিএনপি’-র নির্দেশনায়
পরামর্শক কমিটি ১.পাটুরিয়া-দৌলদিয়া পয়েন্ট, ২.দোহার-চরভদ্রাসন পয়েন্ট, ৩. মাওয়া-জাজিরা
পয়েন্ট এবং ৪.চাঁদপুর-ভেদরগঞ্জ পয়েন্টে প্রি-ফিজিবিলিটি করায়। সমীক্ষায় বলা হয়, “আগের সিদ্ধান্ত
অনুযায়ী মাওয়া-জাজিরা পয়েন্টে পদ্মা সেতু নির্মাণ কারিগরি ও আর্থিকভাবে অধিক লাভজনক।” ২০০৪ খ্রিষ্টাব্দে
জাইকা নিয়োজিত কনসালটেন্ট নিপ্পন কোয়েই (Nippon Koei) পদ্মা সেতু
নির্মাণকল্পে বিস্তারিত সমীক্ষা পরিচালনার পর আগে নির্ধারিত মাওয়া-জাজিরা পয়েন্টেই
সেতু নির্মাণের পরামর্শ দেয়। বিএনপি ফিজিবিলিটি স্টাডির নামে ৫ বছর সময় ক্ষেপণ করল।
সেতু বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ার কিছু করতে পারেনি। পদ্মা সেতু নির্মাণ কার্যক্রমে তারা কোনো
অবদান রাখতে পারেনি, তাদের সে যোগ্যতাও ছিল না।
পদ্মা
সেতু: আওয়ামী লীগ সরকার ২০০৯
আওয়ামী লীগ ২০০৮ খ্রিষ্টাব্দের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে বিপুল ভোটে জয়লাভ করে ২০০৯ খ্রিষ্টাব্দের ৬ই জানুয়ারি সরকার গঠন করে। প্রধানমন্ত্রী এবং মন্ত্রিসভা ২০০৯ খ্রিষ্টাব্দের ৬ই জানুয়ারি, বঙ্গভবনে শপথগ্রহণ করে। আমিও মন্ত্রিসভার সদস্য হিসেবে শপথ গ্রহণ করি। শপথ গ্রহণের আগে মন্ত্রীদের দায়িত্ব বন্টিত হয়নি। হলেও কারও জানা ছিল না- কে কোন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পেয়েছেন বা পাবেন। শপথের পর আপ্যায়নের সময় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাকে কাছে ডেকে বললেন, “তোমাকে সরকারের এ মেয়াদের মধ্যেই পদ্মা সেতু চালু করতে হবে। পদ্মা সেতু বাস্তবায়ন জনগণের প্রতি আমার নির্বাচনী অঙ্গীকার। এ অঙ্গীকার বাস্তবায়ন করে এ মেয়াদে পদ্মা সেতু চালু করে আমি এর সফলতা দিয়ে পরবর্তী মেয়াদে নির্বাচিত হতে চাই। আন্তরিকভাবে কাজে লেগে যাও।” মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কথায় বুঝলাম- আমি যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পেতে চলেছি। অবশ্য, বঙ্গভবন ত্যাগের পূর্বেই আমি মন্ত্রীদের দপ্তর বণ্টনের প্রজ্ঞাপন পেয়ে যাই।
পদ্মা
সেতুর বাস্তবায়ন কাজ শুরু
যোগাযোগমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণের পর প্রথম
দিন থেকে আমি পদ্মা সেতু নির্মাণের কার্যক্রম শুরু করি। ২০০৯ খ্রিষ্টাব্দের ৯ই জানুয়ারি
দায়িত্ব গ্রহণের ৪ দিনের মাথায় অনুষ্ঠিত সরকারি ক্রয়-সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির সভায়
পদ্মা বহুমুখী সেতুর ডিজাইন পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগের প্রস্তাব অনুমোদিত হয়। একই
মাসের ২৯শে জানুয়ারি সেতুর ডিজাইন পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।
২০০৯ খ্রিষ্টাব্দের ২রা ফেব্রæয়ারি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান বিস্তারিত ডিজাইন প্রণয়নের
কাজ শুরু করে। চুক্তি অনুযায়ী ২২ মাসের মধ্যে বিস্তারিত ডিজাইন প্রণয়ন, প্রি-কোয়ালিফিকেশন
ডকুমেন্ট ও মূল টেন্ডার ডকুমেন্ট প্রণয়ন এবং টেন্ডার প্রস্তাবের কারিগরি মূল্যায়নে
সেতু বিভাগকে সহায়তা ইত্যাদি শর্ত অন্তর্ভুক্ত করা হয়। কিন্তু ১৮ মাসের মধ্যে উল্লিখিত কাজ শেষ করার লক্ষ্যে
পরামর্শক প্রতিষ্ঠান সেতু বিভাগের সঙ্গে যৌথভাবে একটি অ্যাকসিলার্যাটেড প্রোগ্র্যাম
(Accelerated Programme) গ্রহণ করে। প্রকল্পের যাবতীয় কাজ বাংলাদেশ
সেতু কর্তৃপক্ষ অত্যন্ত দক্ষতা, দ্রুততা ও স্বচ্ছতার সঙ্গে পরিচালনা করতে থাকে। ইতোমধ্যে
একজন প্রকল্প পরিচালক নিয়োগ দেওয়া হয়। সেতু বিভাগের প্রকৌশলীর সঙ্গে কাজ করার জন্য
যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের সড়ক বিভাগ হতে অভিজ্ঞ কিছু প্রকৌশলী এবং যোগ্য কর্মকর্তা প্রেষণে
আনা হয়। পদ্মা সেতু নির্মাণ প্রকল্প দেশের সর্ববৃহৎ সেতু প্রকল্প। এসব বিবেচনায় যোগ্য
ব্যক্তিদের পদ্মা সেতু নির্মাণ বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেওয়া হয়। ২০০৯ খ্রিষ্টাব্দের ৮ই
ডিসেম্বর পদ্মা সেতুর পরামর্শক নিয়োগের দরপত্র আহ্বান করা হয়। ২০১০ খ্রিষ্টাব্দের ১৪ই
জানুয়ারি পর্যন্ত ১৩টি বিদেশি প্রতিষ্ঠান দরপ্রস্তাব দাখিল করে।
প্রকল্পের
ভূমি অধিগ্রহণ ও পুনর্বাসন
সময়ক্ষেপণ পরিহার করে একই সঙ্গে প্রকল্পের
বিভিন্ন কাজ এগিয়ে নেওয়ার পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়। একদিকে ডিজাইন প্রণয়ন এবং অন্যদিকে
আনুষঙ্গিক কাজের প্রস্তুতি তথা জমি অধিগ্রহণ, মূল্য প্রদান, পুনর্বাসন সাইট উন্নয়ন,
পরিকল্পনামতে রাস্তাঘাট ও ইউটিলিটি সার্ভিস স্থাপন, নাগরিক সুবিধাদির ব্যবস্থাকরণ,
পরিবেশ সংরক্ষণ ইত্যাদি কার্যক্রম স্বচ্ছতার সঙ্গে দ্রæত সম্পাদনের পদক্ষেপ গ্রহণ করা
হয়।
প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য সর্বমোট ১ হাজার
একশ ২৫ হেক্টর ভূমি অধিগ্রহণের পরিকল্পনা করা হয়। প্রচলিত বিধিমতে, জমি অধিগ্রহণের
দায়িত্ব ন্যস্ত ছিল শরিয়তপুর, মাদারীপুর ও মুন্সিগঞ্জ জেলা প্রশাসনের ওপর। এই তিনটি
জেলায় ভূমি অধিগ্রহণের ফলে ১৫ হাজার ২৬১ পরিবারের প্রায় ৭৯,৪৭১ জন ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
প্রায় ৫০০০ পরিবার ঘরবাড়ি হারানোর-শঙ্কায় তাদের পুনর্বাসনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। ক্ষতিগ্রস্তদের
পুনর্বাসনের জন্য নদীর উভয় পাড়ে ২টি করে মোট ৪টি পুনর্বাসন সাইট নির্মাণ কাজ শুরু করা
হয়। এসব কাজের টেন্ডার প্রক্রিয়া সর্বোচ্চ স্বচ্ছতার সঙ্গে সম্পাদন করা হয়। জমি অধিগ্রহণের
অর্থ পরিশোধের বিষয়ে কিছু কিছু অভিযোগ পাওয়া গেলেও তাৎক্ষণিক জেলা প্রশাসকদের সঙ্গে
যোগাযোগ করে প্রতিকারের ব্যবস্থা নেওয়া হয়। সেতুর স্থান-সংলগ্ন মাওয়া ও জাজিরা পাড়ের
অধিগ্রহণ-করা কিছু জমির মালিকদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে মূল্য পুনঃনির্ধারণ ও প্রদানের
ক্ষেত্রে আমাদের গৃহীত পদক্ষেপ ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ এবং এলাকার জনপ্রতিনিধিগণের দ্বারা
বিপুলভাবে প্রশংসিত হয়।
প্রকল্প এলাকায় চলমান কাজ পর্যবেক্ষণ ও
পরিদর্শনের জন্য আমি নিয়মিত সচিব ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের নিয়ে প্রকল্প এলাকা পরিদর্শনে
যেতাম। প্রায় প্রতিসপ্তাহে ছুটির দিনগুলোতে পদ্মা পাড়ে যেতাম। বিশ্বব্যাংক, এডিবি,
জাইকা ও আইডিবির বিভিন্ন পর্যায়ের বিশেষজ্ঞ, প্রতিনিধি ও উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের নিয়ে
বিভিন্ন সময় প্রকল্প এলাকা পরিদর্শন করেন। তারা কাজের মান ও অগ্রগতি অবলোকন করে সন্তোষ
প্রকাশ করেন।
পদ্মা
সেতুর ৫টি প্যাকেজ
পদ্মা সেতু প্রকল্পের ভৌত কাজকে মূলত ৫টি প্যাকেজে ভাগ করা হয়। যথা: ১. মূল সেতু, ২. নদী শাসন, ৩. জাজিরা এপ্রোচ-রোড ও টোলপ্লাজা, ৪. মাওয়া এপ্রোচ-রোড ও টোলপ্লাজা এবং ৫. জাজিরা সার্ভিস এরিয়া। এসব কাজ বাস্তবায়নে বিদ্যমান নীতি অনুসরণ করা হয়। প্রকল্পের কাজে নিয়োজিত পরামর্শক প্রতিষ্ঠান এসব কাজে ঠিকাদার নিয়োগের প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে প্রি-কোয়ালিফিকেশন বিড ডকুমেন্ট প্রণয়ন করে সেতু বিভাগে জমা দেয়। সেতু বিভাগে নিয়োজিত প্রকৌশলী ও বিশেষজ্ঞ কমিটি বিড ডকুমেন্ট যাচাই-বাছাই করে উন্নয়ন সহযোগী সংস্থাসমূহের সম্মতির জন্য প্রেরণ করা হয়। বিশ্বব্যাংকের নেতৃত্বে উন্নয়ন সহযোগী টাস্ক টিম বিভিন্ন সময় এসব ডকুমেন্ট প্রযোজ্য ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সংশোধন-সহ সম্মতি প্রদান করে। অতঃপর আহ্বান করা হয়- প্রি-কোয়ালিফিকেশন টেন্ডার ।
মূলসেতু
নির্মাণ: প্রি-কোয়ালিফিকেশন টেন্ডার আহ্বান
মূলসেতুর নির্মাণ কাজের প্রি-কোয়ালিফিকেশন
টেন্ডার বিজ্ঞপ্তি ২০১০ খ্রিষ্টাব্দের ১০ই এপ্রিল আহ্বান করা হয়। বিভিন্ন সংবাদপত্রে ১১ই এপ্রিল এ বিজ্ঞপ্তি ছাপা হয়। সারা বিশ্বের
৪০টি প্রতিষ্ঠান প্রি-কোয়ালিফিকেশন ডকুমেন্ট ক্রয় করে। প্রস্তাব জমা দেওয়ার নির্ধারিত
তারিখ জুন-২০১০-এর মধ্যে ১১টি প্রতিষ্ঠান তাদের টেন্ডার প্রস্তাব জমা দেয়। পরামর্শক
প্রতিষ্ঠান ও প্রকল্পের ঠিকাদার নিয়োগের জন্য গঠিত কারিগরি মূল্যায়ন কমিটি ‘টিইসি(TEC)’-র চূড়ান্ত মূল্যায়নে
৫টি প্রতিষ্ঠান প্রাক-যোগ্য (Pre-qualified) বিবেচিত হয়।
মূলসেতুর নির্মাণ কাজের প্রি-কোয়ালিফিকেশন টেন্ডার আহ্বানের পূর্বেই প্রকল্পের নির্মাণ তদারকি পরামর্শক ও ব্যবস্থাপনা পরামর্শক এক্সপ্রেশন অব ইন্টারেস্ট [(Expression of Interest (EOI)] নিয়োগের আহ্বান করা হয়। নির্মাণ তদারকি প্রতিষ্ঠান সিএসসি (CSC) নির্বাচনের জন্য ১৩টি প্রতিষ্ঠান আবেদন করে। এদের মধ্য থেকে ৫টি প্রতিষ্ঠানকে সংক্ষিপ্ত তালিকায় (Short listed) রাখা হয়। ২০১০ খ্রিষ্টাব্দের ২৯শে মার্চ লেটার অব ইনটেন্ট {Letter of Intent (LOI)} আহ্বান করা হলে প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের আর্থিক ও কারিগরি প্রস্তাব দাখিল করে।
মূল
সেতুর প্রি-কোয়ালিফিকেশন: টেন্ডার প্রক্রিয়ায় বিশ্বব্যাংক টিমের কোয়ারি
বিশেষজ্ঞগণের সমন্বয়ে গঠিত কারিগরি মূল্যায়ন
কমিটির মূল্যায়নের পর ৫টি প্রতিষ্ঠানের তালিকা ২০১০ খ্রিষ্টাব্দের ২০শে জুলাই টাস্ক
টিমের সম্মতির জন্য বিশ্বব্যাংকে পাঠানো হয়। বিশ্বব্যাংকের গাইড লাইন অনুসরণ করে মূল্যায়ন
প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হয়। তবুও বিশ^ব্যাংক পরীক্ষানিরীক্ষার নামে প্রায় ২ মাস মূল্যায়নটি
ধরে রাখে। বিশ্বব্যাংক টিম ২০১০ খ্রিষ্টাব্দের ২৩শে সেপ্টেম্বর পুনরায় প্রি-কোয়ালিফিকেশন
টেন্ডার আহ্বানের পরামর্শ দেয়। যেসব যুক্তিতে পুনঃটেন্ডার আহ্বান করার জন্য বিশ্বব্যাংক
পরামর্শ দেয়- সেগুলো যুক্তিযুক্ত ও গ্রহণযোগ্য ছিল না। ধারণা করা হয়- তাদের উদ্দেশ্য
ছিল নানা অজুহাতে কালক্ষেপণ করা। কাজের দ্রুততার জন্য বিশ্বব্যাংকের পরামর্শ মেনে নিয়ে
প্রি-কোয়ালিফিকেশন শর্ত আংশিক পরিবর্তন করে ১০ই অক্টোবর পুনরায় টেন্ডার আহ্বান করা হয়। এবার ৪২টি প্রতিষ্ঠান
দরপত্র ক্রয় করে। দর-প্রস্তাব দাখিলের শেষ দিন অর্থাৎ ২৪শে নভেম্বর ১০টি প্রতিষ্ঠান
দরপ্রস্তাব দাখিল করে। এদের মধ্যে ৮টি প্রতিষ্ঠান প্রথম বারের দরপত্র প্রতিযোগিতায়
অংশগ্রহণ করেছিল।
সুপারভিশন
কনসালটেন্ট নিয়োগ: টেন্ডার মূল্যায়ন প্রক্রিয়া
মূল্যায়ন প্রক্রিয়া সম্পর্কে একটু আলোকপাত করা দরকার। মূলসেতু, নদী শাসন এবং সংযোগ সড়ক-সহ যাবতীয় নির্মাণ প্যাকেজের মূল্যায়ন প্রক্রিয়ায় প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটিকে সহায়তা করে সেতু কর্তৃপক্ষ নিয়োজিত পদ্মা সেতু প্রকল্পের ডিজাইন পরামর্শক মনসেল-এইকম (MAUNSELL-AECOM)। প্রথমে মনসেল-এইকম (AECOM)-এর ঢাকাস্থ প্রকল্প অফিসে নিয়োজিত কারিগরি বিশেষজ্ঞগণ দর-প্রস্তাবগুলো পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পরীক্ষা করেন। এরপর ই-মেইলের মাধ্যমে এদের নিউজিল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া ও হংকং অফিসে দায়িত্বরত উচ্চপদস্থ বিশেষজ্ঞগণের সম্মতি গ্রহণের পর কারিগরি মূল্যায়ন কমিটির (TEC) নিকট প্রতিবেদন আকারে উপস্থাপন করা হয়। পদ্মা সেতু প্রকল্পের কারিগরি মূল্যায়ন কমিটি অত্যন্ত স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষভাবে কাজ করে। কমিটির চেয়ারম্যান ও সদস্যগণ ছিলেন সততা, ব্যক্তিত্ব, সুনাম ও পেশাদারি দক্ষতায় আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন। প্রথমবার টেন্ডার আহ্বানের পর যে পাঁচটি প্রতিষ্ঠান প্রাক-যোগ্য (Pre-qualified) বিবেচিত হয়েছিল বিশ্বব্যাংকের অনুরোধে দ্বিতীয়বার টেন্ডার আহ্বানের পর প্রাপ্ত টেন্ডার প্রস্তাবসমূহ মূল্যায়নেও আগের ৫টি প্রতিষ্ঠানই প্রাক-যোগ্য বিবেচিত হয়।
দরদাতা
প্রি-কোয়ালিফিকেশন: মূল্যায়ন প্রক্রিয়ায় বিশ্বব্যাংকের তদবির
দ্বিতীয় বারের প্রি-কোয়ালিফিকেশন মূল্যায়ন প্রতিবেদন বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ ২০১১ খ্রিষ্টাব্দের ৭ই জানুয়ারি বিশ্বব্যাংকে প্রেরণ করে। কিন্তু প্রাক-যোগ্য ঠিকাদার নির্বাচনের এক পর্যায়ে বিশ্বব্যাংক, কারিগরি কমিটিকে একটি প্রাক-যোগ্য Qualified ঠিকাদার China Construction Communication Company (CCCC) -কে বিশ্বব্যাংকের কালো তালিকাভুক্ত থাকার কারণে বাদ দিতে বলে এবং একটি প্রাক-যোগ্যতায় Disqualified ঠিকাদার China Railway Construction Company (CRCC)-‡K Qualify করতে বলে। কারিগরি কমিটি প্রাক-যোগ্য ছঁধষরভরবফ দরদাতাকে বিশ্বব্যাংকের কালো তালিকাভুক্তির কারণে বাদ দেয়। কিন্তু প্রাক-যোগ্য Disqualified দরদাতাকে অভিজ্ঞতার জাল সার্টিফিকেট দেওয়ায় Qualify করতে অস্বীকৃতি জানায়। ২০১১ খ্রিষ্টাব্দের ২৯শে মার্চ বিশ্বব্যাংক টাস্ক টিম লিডার একটি ই-মেইলের মাধ্যমে টিইসি (TEC)-এর মূল্যায়নে বাদ পড়া চায়না রেলওয়ে কনস্ট্রাকশন কোম্পানি [China Railway Construction Company (CRCC)] নামের প্রতিষ্ঠানটিকে প্রাক-যোগ্য বিবেচনার জন্য বিষয়টি পুনরায় পরীক্ষানিরীক্ষা করার অনুরোধ করে। সে মতে ডিজাইন পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ও দরপত্র মূল্যায়ন কমিটি সিআরসিসি (CRCC)-এর দাখিলীয় কাগজপত্র পুনঃপরীক্ষা করে এবং সিআরসিকে প্রাক- যোগ্য বিবেচনা করা যায় না মর্মে প্রতিবেদন দাখিল করে। সেতু কর্তৃপক্ষ ৩০শে মার্চ এ প্রতিবেদন বিশ্বব্যাংকে প্রেরণ করে। প্রত্যুত্তরে বিশ্বব্যাংক পুনরায় সিআরসিকে (CRCC) প্রাক-যোগ্য বিবেচনার অনুরোধ করলে সেতু বিভাগ এ প্রতিষ্ঠানকে প্রাক-যোগ্য বিবেচনা না করার কারণ ব্যাখ্যা করে বিশ্বব্যাংকে পত্র দেয়।
২০১১ খ্রিষ্টাব্দের ১৩ই এপ্রিল বিশ্বব্যাংক
সিআরসিসি (CRCC)-এর নিকট থেকে
বৃহৎ সেতু নির্মাণের বিষয়ে অধিকতর তথ্য সংগ্রহ করে পরীক্ষানিরীক্ষাপূর্বক ওই প্রতিষ্ঠানকে
প্রাক-যোগ্য বিবেচনা করার জন্য পুনরায় প্রস্তাব পাঠায়। বিশ্বব্যাংকের বারবার অনুরোধের
কারণে সেতু কর্তৃপক্ষ সিআরসিসি (CRCC)-এর কাছে পদ্মা
সেতুর মতো বৃহৎ সেতুর কাজে তাদের পূর্ব অভিজ্ঞতার স্বপক্ষে ড্রয়িং, ডিজাইন, নির্মাণ
সামগ্রী এবং রেকিং পাইলে ব্যবহৃত হ্যামারের বর্ণনা এবং সেতু ও পাইলিং-এর ছবি পাঠানোর
জন্য চিঠি লিখে। তদ্পরিপ্রেক্ষিতে সিআরসিসি (CRCC) যেসব তথ্য ও ছবি প্রেরণ করে তাতে ডিজাইন পরামর্শক
ও মূল্যায়ন কমিটি বড়ো রকমের অসংগতি দেখতে পায়। সিআরসিসি (CRCC) অন্য প্রতিষ্ঠানের নির্মাণ করা
যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোনিয়ায় অবস্থিত ব্রিজের ছবি পরিবর্তন করে নিজেদের নির্মিত দাবি
করে জমা দিয়েছিল।
ভেনচার ইন্টারন্যাশনাল লি. (Venture International Ltd.) নামক বাংলাদেশি একটি প্রতিষ্ঠান সিআরসিসি (CRCC)-এর স্থানীয় এজেন্ট হিসেবে কাজ করে। জানা যায়, ক্যাপ্টেন রেজা নামক একজন ঠিকাদার এর স্বত্বাধিকারী। চিঠিপত্রে দীপ্তিময় তনঞ্চইংগ্যা নামক একজন পরিচালক স্বাক্ষর করেন। এ প্রতিষ্ঠানের চিঠিপত্র, সিআরসিসি (CRCC)-এর ব্যবহৃত লেটার প্যাড ইত্যাদি দেখে আমাদের সন্দেহ হয়। ৮ই মে তারিখে ঢাকাস্থ চীনা দূতাবাসের ইকনমিক কাউন্সিলরকে সেতু বিভাগে আমাদের অফিসে আমন্ত্রণ জানানো হয়। কাউন্সিলরকে সিআরসিসি (CRCC)-এর বিভিন্ন চিঠি দেখানো হয়। তিনি জানান, চিঠিতে প্রদত্ত চীনা কর্মকর্তার স্বাক্ষর চীনা ভাষার নকল স্বাক্ষর। লেটার হেডটিও হংকং অফিসের ঠিকানায় ছাপা এবং এটি বেইজিংস্থ সিআরসিসি (CRCC)-এর মূল অফিসের নয়। দূতাবাসের ইকনমিক কাউন্সিলর তৎক্ষণাৎ বেইজিংস্থ সিআরসিসি (CRCC)-এর সদর দপ্তরে কথা বলেন। টেলিফোনের কথায় মনে হলো, কাগজপত্র জাল করার জন্য তিনি সিআরসিসি (CRCC) কর্তৃপক্ষকে ভবিষ্যতে কালো তালিকাভুক্ত (Black listed) হওয়ার আশঙ্কার বিষয়ে সতর্ক করেছেন।
CRCC -এর আবেদন প্রত্যাহার এবং মূল সেতুর মূল্যায়নে দরদাতার
প্রাক-যোগ্য নির্বাচনে বিশ্বব্যাংকের সম্মতি
৯ই মে সিআরসিসি (CRCC) সেতু কর্তৃপক্ষকে পত্র দিয়ে প্রাক-যোগ্যতার আবেদন প্রত্যাহার করে নেয় এবং স্থানীয় এজেন্ট ভেনচার ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড-এর এজেন্সিশিপ বাতিল করে। এতে প্রমাণিত হয় যে, সিআরসিসি (CRCC)-এর পক্ষে স্থানীয় এজেন্ট ভেনচার ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড সিআরসিসি (CRCC)-এর একটি শাখা অফিসের মাধ্যমে বিভিন্ন জাল তথ্য পরিবেশন করা হয়েছিল। ২০১১ খ্রিষ্টাব্দের ১৮ই মে সেতু কর্তৃপক্ষ সিআরসিসি (CRCC)-এর প্রাক-যোগ্যতার প্রতিযোগিতা থেকে নাম প্রত্যাহার করার চিঠি-সহ পুনরায় ৫টি প্রতিষ্ঠানের প্রি-কোয়ালিফিকেশন সুপারিশ বিশ্বব্যাংকের সম্মতির জন্য প্রেরণ করে। সিআরসিসি (CRCC) সদর দপ্তর থেকে নাম প্রত্যাহার করায় বিশ্বব্যাংক তাদের পক্ষে আর চাপ প্রয়োগ করেনি। ২০১১ খ্রিষ্টাব্দের ১লা জুলাই বিশ্বব্যাংক মূল সেতুর দরদাতা প্রাক-যোগ্য মূল্যায়নে সম্মতি দেয়। ২০১০ খ্রিষ্টাব্দের ১৪ই জানুয়ারি মুল সেতুর দরপত্র আহ্বান করা হয়।
দাতা
সংস্থার সঙ্গে ঋণচুক্তি স্বাক্ষর
২০১১ খ্রিষ্টাব্দের ২৪শে ফেব্রুয়ারি বিশ্বব্যাংকের
বোর্ড সভায় ১২০ কোটি মার্কিন ডলারের ঋণসহায়তা অনুমোদিত হয়। ২০১১ খ্রিষ্টাব্দের ২৮শে
এপ্রিল বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে ঋণচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ২০১১ খ্রিষ্টাব্দের ২৮শে মে জাপানের
জাইকা, ২৪শে মে ইসলামি উন্নয়ন সংস্থা এবং ৬ই জুন এডিবির সঙ্গে ঋণচুক্তি স্বাক্ষরিত
হয়।
মাঝ
পদ্মায় বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে ঋণচুক্তি স্বাক্ষর
যে-কোনো প্রকল্পের ঋণচুক্তি হয় সাধারণত
ইআরডির সম্মেলন কক্ষে। কিন্তু পদ্মা সেতুর বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে ঋণচুক্তিটি আমি
পদ্মা নদীতে আয়োজন করি। পদ্মা সেতু এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প যা সমগ্র বাংলাদেশকে
সড়ক নেটওয়ার্কে যুক্ত করবে। পদ্মা সেতু হবে বাংলাদেশের উন্নয়নে এক কালজয়ী ইতিহাস। পদ্মা
সেতুর উপকারিতা হবে বহুমাত্রিক। অধিকন্তু, পদ্মা সেতু নির্মাণ বাংলাদেশের জন্য হবে
একটি বিশ্ব ঐতিহ্যের অবিস্মরণীয় স্মারক। উত্তাল পদ্মায় সেতুর অপরিহার্যতা, বিশাল পদ্মা
নদী সম্পর্কে ধারণা প্রদান, নির্মাণ কার্যক্রমের প্রেক্ষাপট, পরবর্তী প্রজন্মের কাছে
পদ্মা সেতুর গুরুত্ব সমুন্নত রাখা, সর্বোপরি ঐতিহাসিক অবদান বিবেচনা করে বিশ্বব্যাংকের
সঙ্গে সম্পাদনীয় চুক্তিটিকে একটি নতুন আমেজ দিয়ে স্মরণীয় ও বরণীয় করে রাখার জন্য আমি
নিজ উদ্যোগে একটি ফেরি জাহাজকে নতুন আঙ্গিকে সজ্জিত করে অনুষ্ঠানের ভেন্যু নির্ধারণ
করি।
চুক্তির দিন পদ্মা পাড়ে সাজ সাজ রব। চারিদিকে আনন্দের ঢেউ। এলাকার মানুষ পদ্মা পাড়ে বসে নদীর মধ্যখানের চিত্র অবলোকন করছেন। বিশ্বব্যাংকের ম্যানেজিং ডিরেক্টরকে ঢাকা থেকে হেলিকপ্টারে পদ্মা পাড়ে নিয়ে যাওয়া হলো। অতিথিরা যথাসময়ে ফেরিতে উঠলেন। ফেরিকে পদ্মার বুকে ভাসিয়ে রাখা হলো। অতিথিরা ফেরিতে চড়ে পদ্মা নদীতে কিছুক্ষণ প্রমোদ ভ্রমণ করলেন। নদীর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও ফেরির সাজসজ্জা দেখে সবাই মুগ্ধ। অনুষ্ঠানের ভাবগম্ভীর পরিবেশ এবং মাঝ নদীতে পদ্মার উত্তলতা সবাইকে মুগ্ধ করে। ঋণচুক্তির এ আয়োজন সবার ভালো লাগে। এমন আনন্দমুখর পরিবেশে ব্যতিক্রধর্মী আমেজের মধ্যে আমরা বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে পদ্মা সেতুর ঋণচুক্তি স্বাক্ষর করি। দুপুরে অতিথিদের ফেরিতে ইলিশ, আইড় ও চিংড়ি-সহ নানা উপাদেয় দেশি খাবার পরিবেশন করা হয়। শেষে মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করা হয়।
পদ্মা
সেতু: লিড ডোনার বিশ্বব্যাংক
আওয়ামী লীগ সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর এ
প্রকল্পটিকে দেশের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার প্রকল্প হিসেবে ঘোষণা করে এবং সরকারের মেয়াদকাল
অর্থাৎ ২০১৩ খ্রিষ্টাব্দের ডিসেম্বরের মধ্যে সেতুর নির্মাণ কাজ শেষ করার পরিকল্পনা
ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করে। পদ্মা সেতু প্রকল্পের গুরুত্ব ও ব্যাপকতা এবং জাতীয় স্বার্থ
বিবেচনায় ঠিকাদারের কাজ তদারকি ও পরামর্শক নিয়োগের জন্য দেশি-বিদেশি বিশেষজ্ঞের সমন্বয়ে
১১ সদস্যের একটি প্যানেল অব এক্সপার্ট (পিওই) গঠন করা হয়। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন
সিভিল ইঞ্জিনিয়ার ও বিশেষজ্ঞ প্রফেসর ড. জামিলুর রেজা চৌধুরীকে ‘পিইও’-র চেয়ারম্যান
নিযুক্ত করা হয়। এতে বুয়েটের ৫ জন, জাপানের ২ জন এবং কলম্বিয়া, ডেনমার্ক ও যুক্তরাষ্ট্রের
একজন করে বিশেষজ্ঞকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এরা সবাই বিশ্বখ্যাত বিশেষজ্ঞ।
সরকার পদ্মা সেতু প্রকল্পে সর্বাধিক গুরুত্ব
আরোপ এবং ডিজাইন প্রকল্পের পরামর্শকগণ কাজ শুরু করায় উন্নয়ন সহযোগী সংস্থাগুলো আশ্বস্ত
হয়। ফলে পদ্মা সেতু প্রকল্পে অর্থায়নে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ বিশ্ব্যাংক, এডিবি ও জাইকা সহায়তা
বৃদ্ধির আশ্বাস দেয়। বিশ্বব্যাংক ১০০০ মিলিয়ন, এডিবি ৫০০ মিলিয়ন এবং জাইকা ৩০০ মিলিয়ন
ডলার ঋণ প্রদানের ইঙ্গিত দেয়। এদিকে, বাংলাদেশ সরকার ইসলামিক ডেভেলপমেন্ট ব্যাংককে
প্রকল্পে অর্থায়নের অনুরোধ করলে আইডিবিও যৌথ অর্থায়নে সম্মত হয়। সরকার লিড ফাইনানসার
(Lead Financier) হিসেবে বিশ্বব্যাংককে কো-অর্থায়নকারী
সমন্বয়কের দায়িত্ব প্রদান করে। প্রসঙ্গত, উন্নয়ন সহযোগী বিশ্বব্যাংক, এডিবি, জাইকা
এবং ইসলামিক ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের পক্ষে আলাদা দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা থাকলেও লিড
ফাইনানসার (Lead Financier) হিসেবে বিশ্বব্যাংক কর্মকর্তা
মাসুদ আহমদকে পদ্মা সেতু প্রকল্পের টাস্ক ডিম লিডার (Task Team Leader) মনোনীত করে টাস্ক টিম গঠন করে।
উন্নয়ন সহযোগীদের টাস্ক টিম, সেতু বিভাগের
তত্ত্ববধানে পরিচালিত ডিজাইন পরামর্শকদের কাজের অগ্রগতি সময় সময় পর্যবেক্ষণ এবং ক্ষেত্র
বিশেষে তাদের কাজে পরামর্শ ও সম্মতি প্রদান করে। প্রকল্পের প্রাথমিক কাজ সম্পাদনের
জন্য বিশ্বব্যাংক ৩ মিলিয়ন ডলার বরাদ্দ করে। সেতু বিভাগ এবং উন্নয়ন সহযোগীদের সঙ্গে
আলোচনাক্রমে ডিজাইন পরামর্শক প্রতিষ্ঠান সেতুর সম্ভাব্যতা সমীক্ষায় প্রস্তাবিত চার
লেনবিশিষ্ট সেতুর ডিজাইন পরিবর্তন করে ডেনমার্কের একটি সেতুর অনুরূপ দ্বিতল (Double
Deck)
সেতুর ডিজাইন প্রস্তাব করে, যা সেতু বিভাগ ও উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা গ্রহণ করে।
প্রস্তাবিত স্কিম ডিজাইন অনুযায়ী সেতু নির্মাণের প্রাক্কলিত খরচ সংশোধন করে ২.৪০ বিলিয়ন (অর্থাৎ ১৬ হাজার ৯৭০ কোটি টাকা) নির্ধারণ করা হয়। ইস্পাতের তৈরি স্ট্রাকচারের উপর নির্মিত চার লেনবিশিষ্ট সড়ক সেতুর নিচ দিয়ে হবে রেল সেতু। দোতলা এ সেতুর দৈর্ঘ্য হবে ৬.১৫ কিলোমিটার এবং প্রস্থ ২৩.৬ মিটার। সেতু নির্মাণ প্রস্তুতি কাজ অর্থাৎ ভূমি অধিগ্রহণ, পুনর্বাসন, নকশা চূড়ান্তকরণ ইত্যাদি দ্রুত গতিতে চলতে থাকে। ২০০৯ খ্রিষ্টাব্দের নভেম্বর মাসে মনসেল এইকম [(Maunsell-AECOM (USA)] প্রাথমিক নকশা চূড়ান্তকরণ ও আনুষঙ্গিক বিভিন্ন কাজের প্রতিবেদন দাখিল করে। ২০১০ খ্রিষ্টাব্দের মার্চে মূল সেতু, নদী শাসন ও সংযোগ সড়ক নির্মাণের ঠিকাদারদের প্রাক যোগ্যতা যাচাইয়ের লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করা হয়।
প্রকল্প
বাস্তবায়নে আইনি বাধ্যবাধকতা অনুসরণ
দেশে প্রথম মেগা প্রকল্প পদ্মা সেতু নির্মাণের
প্রস্তুতিমূলক প্রতিটি কাজে আইনি বাধ্যবাধকতা মেনে চলা হয়েছে। স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি
নিশ্চিত করা হয়েছে। মুল সেতু নির্মাণ ও পরামর্শক নিয়োগ কার্যক্রম স্বচ্ছভাবে পরিচালিত
হয়েছে। এসব কার্যক্রমে কোনো গোপনীয়তা ছিল না। কাউকে প্রভাবিত করা হয়নি। বিদ্যমান আইন
ও বিধি কখনো ভঙ্গ করা হয়নি। ঋণদাতা সংস্থার তদারকিতে, বিশেষ করে, নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে
বিশ্বব্যাংকের অনুমোদনে পদ্মা সেতু নির্মাণের প্রতিটি ধাপ এগিয়েছে। বিশ্বব্যাংক ও অর্থায়ন
সংস্থার অনুমোদনে প্রতিটি কাজ বাস্তবায়িত হয়েছে। এখানে আমার বা অন্য কারো দুর্নীতি
করার বা দরদাতা বা পরামর্শক নির্বাচন প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করার কোনো সুযোগ ছিল না।
মন্ত্রী
হিসেবে আমি শুধু প্রস্তাব অগ্রায়ন করেছি
মূলত পদ্মা সেতুর বিভিন্ন স্তরে সকল কার্যক্রমে
বিশ্বব্যাংক অনুমোদন দিয়েছে। আমি শুধু কারিগরি কমিটির সিদ্ধান্ত যোগাযোগ মন্ত্রী হিসেবে
বিশ্বব্যাংকে অগ্রায়ন করেছি। আমার কোনো মতামত তাতে ছিল না। বিশ্বব্যাংক ও অন্যান্য
দাতা সংস্থার সন্তুষ্টি ও অনুমোদনে সকল কার্যক্রম বাস্তবায়িত হয়েছে। ভূমি অধিগ্রহণ
ও পুনর্বাসনের কাজ স্বচ্ছতা আর জবাবদিহির সঙ্গে সম্পাদিত হওয়ায় দাতা সংস্থাগুলো ভূয়সী
প্রশংসা করেছে। কিন্তু মূল সেতুর দরদাতা নির্বাচনে প্রাক-যোগ্য টেন্ডার আহ্বানের সময়
বিশ্বব্যাংক এক পর্যায়ে- একজন দরদাতাকে বাদ দিতে বলে এবং অন্য একজন অযোগ্য (Disqualified) দরদাতাকে যোগ্য (Qualify) ঘোষণা করার
অনুরোধ করে। বিশ্বব্যাংকের নির্দিষ্ট ঠিকাদার নিয়োগের বিষয়ে তদবির থাকায় এবং কারিগরি
কমিটি তাদের টেন্ডার ডকুমেন্টে জালিয়াতি পাওয়ায় তাদের অযোগ্য (Disqualified) ঘোষণা করে এবং বিষয়টি বিশ্বব্যাংককে
অবহিত করে। পরে প্রতিষ্ঠানটি দরপত্র প্রত্যাহার করে নেয়। সম্ভবত অনৈতিক তদবির ব্যর্থ
হওয়ায় বিশ্বব্যাংক খুশি হতে পারেনি।
দুই
বছর: পদ্মা সেতুর চুড়ান্ত প্রস্তুতি কাজ
পদ্মা সেতুর নির্মাণ ছিল প্রধানমন্ত্রী
শেখ হাসিনার রাজনৈতিক অঙ্গীকার। দেশের সামগ্রিক উন্নয়নের অঙ্গীকার। তাই সেতু নির্মাণ
যাতে দ্রুত এবং লক্ষ্য অনুযায়ী বাস্তবায়িত হয় সে ব্যাপারে আমি সর্বাত্মক ভূমিকা পালন
করেছি। প্রতিটি মুহূর্তকে যথাযথভাবে কাজে লাগানোর চেষ্টা করেছি। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ১৮
ঘণ্টা কাজ করেছি। দ্রুততম সময়ে সরকারের অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সমন্বয়পূর্বক দাতা
সংস্থার সঙ্গে ঋণচুক্তি স্বাক্ষরের ব্যবস্থা করেছি। স্বল্প সময়ে পদ্মা সেতু নির্মাণে
ভূমি অধিগ্রহণ, ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসনে ৪টি পুনর্বাসন উপশহর গড়ে তোলা,
ভূমি উন্নয়ন করা, কমিনিউটি সেন্টার, মার্কেট, স্কুল ও মেডিকেল সেন্টার নির্মাণ, পানি
নিষ্কাশন ব্যবস্থা এবং ওয়াটার ট্যাংক নির্মাণের কাজ শেষ করে প্লট বরাদ্দের কাজের কার্যক্রম
গ্রহণের পর্যায়ে নিয়ে আসি। প্রাক-যোগ্য দরদাতা নির্বাচন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে ২০১৩
খ্রিষ্টাব্দের ডিসেম্বরে সেতুর কাজ শেষ করার লক্ষ্য নিয়ে দ্রুততার সঙ্গে এগিয়ে যাই।
যেখানে বঙ্গবন্ধু সেতুর প্রস্তুতি কাজ সম্পন্ন করতে ১০ বছর লেগেছে, সেখানে মাত্র দুবছরে
আমরা পদ্মা সেতুর সব প্রস্তুতির কাজ সম্পন্ন করতে সক্ষম হই। দ্রুত পদ্মা সেতুর কাজ
এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে সততা ছিল আমার মূলধন, নিষ্ঠা ছিল আমার দক্ষতা আর শ্রম ছিল আমার
প্রেরণা। এ তিনের সমন্বয়ে আমি পদ্মা সেতুর কাজকে এগিয়ে নিয়েছি।
বিশ্বব্যাংক, এডিবি, জাইকা ও আইডিবির নিকট
পদ্মা সেতুর পুনর্বাসন প্রকল্পটি আদর্শ প্রকল্প হিসেবে বিবেচিত হয়। আমাদের পুনর্বাসন
প্রকল্পকে বিশ্বের অন্যতম সেরা পুনর্বাসন প্রকল্প হিসেবে গণ্য করা হয়। সকল দাতা সংস্থা
প্রকল্প কাজে খোলাখুলি সন্তোষ প্রকাশ করে। কাজের দ্রুত অগ্রগতি, গুনগতমান এবং স্বচ্ছতা
দেখে সবাই মুগ্ধ হয়। পুনর্বাসন কাজের টিমকে তারা ধন্যবাদ জানান।
দুই
বছর আমি নির্বাচনী এলাকায় যেতে পারিনি
আগেই বলেছি, পদ্মা সেতুর কাজকে দ্রুত এগিয়ে নিতে আমি দুবছর অক্লান্ত পরিশ্রম করেছি। এ দুবছর আমি আমার নির্বাচনী এলাকায় যাইনি।এলাকার মানুষের সুখ-দুঃখের সাথি হতে পারিনি। জনগণের সেবার প্রয়োজনীয় কাজটুকু যথাযথভাবে করতে পারিনি। জনগণ তাদের জনপ্রতিনিধিকে সবসময় পাশে পেতে চায়। তাদের অভিযোগ ও দাবি সরাসরি জানাতে চায়। তাদের দুঃখ-কষ্ট শেয়ার করতে চায়। আমি তাদের আকাক্সক্ষা ও ঐকান্তিকইচ্ছে পূরণ করতে পারিনি। আমি সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছি- পদ্মা সেতু নির্মাণের ওপর। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমার ওপর যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের যে দায়িত্ব দিয়েছেন, শপথ গ্রহণের পর পদ্মা সেতু দ্রæত নির্মাণের যে নির্দেশ দিয়েছেন- সেই নির্দেশপ্রসূত অমোঘ ও পবিত্র দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে অবিরাম কাজ করেছি। পদ্মা সেতু নির্মাণের টিমকে সক্রিয় করেছি। তাদের পরামর্শ ও সাহায্য নিয়ে দুই বছরের মধ্যে মেগাপ্রকল্প ‘পদ্মা সেতু’র প্রস্তুতি কাজ শেষ করেছি।পদ্মা সেতুর জন্য দুই বছর আমি নির্বাচনী এলাকায় যাইনি। তবুও এলাকার মানুষ আমার এ অনুপস্থিতি মেনে নিয়েছেন। কষ্ট স্বীকার করেছেন। আমাকে পদ্মা সেতু-সহ যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের লক্ষ্যে দায়িত্ব পালনে সহযোগিতা করেছেন। এলাকাবাসী পদ্মা সেতু নির্মাণের অংশীদার হচ্ছে, পদ্মা সেতু তাদের ভাগ্য খুলে দেবে- এ প্রত্যাশায় তারা আল্পুত হয়েছে, খুশি হয়েছে। আমি তাদের প্রতি কৃতজ্ঞ।
পদ্মা
সেতু: প্রস্তুতি পর্যায়ে আমার মতামত
আমি কারিগরি জ্ঞানসম্পন্ন লোক নই- প্রকৌশল
বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করিনি, লেখাপড়া করেছি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। আমার অনুসন্ধানী
মন জানার আগ্রহ নিয়ে বিশ্বের বড়ো বড়ো সেতু এলাকা পরিদর্শন করেছি। জাপান গৃহীত ডিজাইন
দেখেছি। বিশ্বখ্যাত নর্থ আমেরিকার সেনটিনিয়াল পানামা ব্রিজ সম্পর্কে বিস্তারিত জেনেছি।
এটি প্যান-আমেরিকান হাইওয়ে ক্যারিয়ার হিসেবে প্রতিস্থাপনের জন্য নির্মিত হয়েছিল যা
২০০৪ খ্রিষ্টাব্দে চালু করা হয়। চায়নার থ্রি গরজেস প্রকল্প একাধিকবার পরিদর্শন করেছি।
৩০ বিলিয়ন ডলার ব্যয়ে নির্মিত এ প্রকল্প যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ বিশ্বের বিশিষ্ট
প্রকৌশলীগণ পরিদর্শন করেছেন। শুনেছি, বোয়াও ফোরাম ফর এশিয়ার সম্মেলন শেষে আমেরিকার
সাবেক প্রেসিডেন্ট সিনিয়র বুশ-সহ বিশ্বনেতৃবৃন্দ এ গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পটি পরিদর্শন
করেন। আমি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিরোধী দলীয় নেত্রী থাকাকালীন পৃথিবীর অন্যতম
শ্রেষ্ঠ নির্মাণ এ প্রকল্পটি পরিদর্শন করি। আমি আগেই বলেছি, চীনের বেশ কয়েকটি সিঙ্গেল
ডেকার ব্রিজ আমি পরিদর্শন করেছি। চীনের ডাবল-ডেকার ব্রিজ- ইয়াংসিগাং ব্রিজ, মিনপু সেতু,
ওউসেনজ্যাশন সেতু এবং টেনসিংজা সেতু আমি দেখেছি এবং দক্ষিণ কোরিয়ার ডাবল-ডেকার ব্রিজ
বেনপো সেতুও দেখেছি। এসব পরিদর্শন থেকে আমি অভিজ্ঞতা লাভ করেছি। তার আলোকে কারিগরি
কমিটিকে ডিজাইনে কিছু বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা যায় কি না তা বিবেচনার জন্য অনুরোধ করেছিলাম।
এই ডিজাইনের বিষয়ে আমি প্রকল্প পরিচালক (পিডি) রফিক সাহেবকে নিয়ে ডিজাইন কনসালট্যান্ট
মনসেল এইকম-এর সঙ্গে আলোচনায় বসেছিলাম। তাদের সঙ্গে আমার ভাবনা নিয়ে আলোচনা হয়েছে।
হংকং-এ গিয়েও এ বিষয়ে তাদের সঙ্গে সভা করেছি। পদ্মা সেতু দ্রুত বাস্তবায়নের কৌশল নিয়েও
কথা বলেছি। ডাবল ডেকার ব্রিজ স্টিল স্ট্রাকচারের বিষয়ে কথা বলেছি। উহানের আদলে এ ধারণা
নিলে ৩ বছরে পদ্মা সেতু করা সম্ভব তাও বলেছি। ডিজাইন প্রতিষ্ঠান মনসেল-এইকম বিশ্বের
অন্যতম ডিজাইনার প্রতিষ্ঠান। তাদের দিয়ে ডিজাইন তৈরি করাই। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে
তা উপস্থাপিত হয় এবং উপযুক্ত গণ্যে তা তিনি অনুমোদন করেন।
আমি কারিগরি কমিটির কাছে প্রস্তাব রেখেছিলাম, স্ট্রাকচারাল ডিজাইন এমনভাবে করতে, যাতে বড়ো ধরনের ভূমিকম্প হলেও ব্রিজের তেমন কোনো ক্ষতি না হয়। এক্ষেত্রে জাপানি বিশেষজ্ঞদের সাহায্য নিতে অনুরোধ করি। কারণ, জাপানিরা ভূমিকম্প সহনীয় ডিজাইন তৈরিতে এক্সপার্ট। আমি তখন বিভিন্ন দেশের সেতু পরিদর্শনের অভিজ্ঞতার আলোকে অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরীকে বলেছিলাম,“পাইলিং করতে গিয়ে যদি শক্ত মাটি পাওয়া না যায় কিংবা নরম মাটির স্তর আসে তাহলে কনক্রিট ফাউন্ডেশনর দেওয়ার বিধান রাখতে; অর্থাৎ নরম মাটি এলে তা কেমিক্যাল দিয়ে কংক্রিটে রূপান্তর করা সম্ভব।” চায়নার উদাহরণও আমি দেখিয়েছিলাম। পাইলিং করতে গিয়ে মাটির গভীরে গ্যাস পাওয়া গেলেও ফাউন্ডেশন করা সম্ভব- এ উদাহরণ চায়নায় রয়েছে। এ ধরনের পরিস্থিতি এলে কাজ যাতে বিলম্ব না ঘটে বা ব্যয় না বাড়ে- এ শর্ত জুড়ে দিতে কারিগরি কমিটির প্রধান অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরীকে অনুরোধে করেছিলাম এবং চুক্তির আগে চায়না গিয়ে সরেজমিনে তা দেখে আসতে বলেছিলাম। এক্ষেত্রে ভ্যারিয়েশন (Variation)-এর পরিবর্তে থোক (Lumpsum) চুক্তির বিধান (provision) রাখতে বলেছিলাম। যাতে পরবর্তীকালে সেতু নির্মাণের ব্যয় না বাড়ে। এছাড়া ব্রিজটি আরো ৫ ফুট উঁচু এবং পদ্মা সেতুর মধ্যভাগে কয়েকটি স্প্যানে এক্সট্রা ডোজ ক্যাবল স্ট্রেইট করা-সহ নানা টেকনিক্যাল বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়ার জন্য কনসালটেন্টের সঙ্গে কথা বলে অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরীকে অবহিত করি। কিন্তু তিনি আমার মতামতের গুরুত্ব বিবেচনায় নেননি।
উল্লেখ্য, একজন বিডারকে বিশ্বব্যাংকের
পরামর্শে বাদ দিয়ে আমার রেখে যাওয়া প্রি-কোয়ালিফাইড বিডারদের মধ্যে থেকে নির্বাচন করা
হলো, কিন্তু সুপারভিশন কনসালটেন্ট নিয়োগে নতুনভাবে প্রি-কোয়ালিফিকেশন আহ্বান করা হলো।
অথচ এসএনসি-লাভালিনকে বাদ দিয়ে অন্যদের মধ্য থেকে সুপারভিশন কনসালটেন্ট নির্বাচন করা
সমীচীন ছিল। নতুনভাবে প্রি-কোয়ালিফিকেশন দরপত্র আহ্বানের ফলে কোরিয়ার মতো তুলনামূলকভাবে
অনভিজ্ঞ সুপারভিশন কনসালটেন্ট নিয়োগ পেল। যদি নতুন প্রি-কোয়ালিফাইড টেন্ডার আহ্বান
না করে পূর্বের দ্বিতীয় সর্বনিম্ম প্রি-কোয়ালিফাইড বিডার মনসেল-এইকম (Maunsell -AECOM) নির্বাচিত হতো
তাহলে এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হতো না। এক্ষেত্রে ঠিকাদার নিয়োগে এক নীতি এবং সুপারভিশন
কনসালটেন্ট নিয়োগের ক্ষেত্রে অন্য নীতি গ্রহণ করা হয়েছে। ফলে সময়ক্ষেপণ ও নির্মাণ ব্যয়
দুটোই বেড়ে গেছে।
আমার আশঙ্কা সত্য হলো- যখন নির্মাণ পর্যায়ে দেখা গেল নদীর তলদেশে শক্ত মাটি নেই- আছে তরল কাদা যা পাইলিং-এর উপযুক্ত নয়। তখন বর্তমান ঠিকাদার, যারা নির্মাণ কাজে অভিজ্ঞ, তারা ক্যামিক্যাল ব্যবহার করে মাটি শক্ত করে পাইলিং করার পরামর্শ দেয়। তাদের এ পরামর্শ আমার আগের পরামর্শের সঙ্গে সাজুস্যপূর্ণ ছিল। কিন্তু কোরিয়ান কনসালটেন্ট সে পথে না গিয়ে গবেষণার নামে দুই বছর সময়ক্ষেপণ করল। দুই বছর পর ঠিকাদারের সেই পরামর্শ অনুযায়ীই বর্তমানে স্ক্রিন গ্রাউটিং পদ্ধতিতে ক্যামিক্যাল ব্যবহারের পথ বেছে নিল। ফলে সেতু নির্মাণে সময়ক্ষেপণ হলো। ব্যয়ও বেড়ে গেল অনেক।
২০১৩ খ্রিষ্টাব্দের ডিসেম্বরে সেতু চালুর টার্গেট: ষড়যন্ত্র শুরু
বিশ্বব্যাংক ঠিকাদার প্রাক-যোগ্য নির্বাচনে কারিগরি কমিটির সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করতে নানা কোয়ারি করে। উদ্দেশ্য: বিশ্বব্যাংকের পছন্দনীয় ঠিকাদারকে নিয়োগ পাইয়ে দেওয়া। কিন্তু কারিগরি কমিটি সেই নির্দিষ্ট প্রাক-যোগ্য নির্বাচনে অযোগ্য ঠিকাদারকে কোনোভাবে বৈধতা দিতে না পারায় বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতুর অর্থায়নে অনীহা প্রকাশ করে। বিশ্বব্যাংকের গোর্য়াতুমি, দেশীয় স্বার্থান্বেষী মহল ও রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের যোগসাজশে গৃহীত ষড়যন্ত্রে পদ্মা সেতু নির্মাণ বাধাগ্রস্ত হয়। মূলত দ্রততম সময়ে যাবতীয় প্রস্তুতিকাজ শেষ হওয়ায় পদ্মা সেতু ২০১৩ খ্রিষ্টাব্দের ডিসেম্বরের মধ্যে চালু হবে- এটি স্বার্থান্বেষীরা মেনে নিতে পারেনি। তারা সর্বাত্মকভাবে এ কার্যক্রমে বাধ সাধে এবং এর সঙ্গে বিশ্বব্যাংক কাক্সিক্ষত ঠিকাদারকে নিয়োগ দিতে ব্যর্থ হওয়ায় এদের সঙ্গে যোগ দেয়। বিশ্বব্যাংক ও দেশীয় ষড়যন্ত্রকারীর ষড়যন্ত্র আমি তখনই বুঝতে পারি যখন দেখি- বিশ্বব্যাংকের আবাসিক প্রতিনিধি গোল্ড স্টেইনের কথাবার্তা, আলাপ-আলোচনা, চালচলন এবং তৎপরতায় এক ধরনের সময়ক্ষেপণ ও কালবিলম্ব রয়েছে। আমি এতে কান দেইনি বরং পরিকল্পনা অনুযায়ী পদ্মা সেতু নির্মাণের কার্যক্রম চালিয়ে যাই। এরপর থেকে শুরু হয় পত্র-পত্রিকায় আমাকে জড়িয়ে পদ্মা সেতু নির্মাণের প্রস্তুতিমূলক কাজের অনিয়মের নানা গাঁজাখুরি গল্প।
পদ্মা
সেতুর অভিযোগের মূল প্রেক্ষাপট
বিশ্বব্যাংকের পছন্দের প্রতিষ্ঠান সিআরসিসি (CRCC) চায়নাকে কোয়ালিফাই করতে ব্যর্থ হয়ে পুনঃটেন্ডারের ৭ মাস পর ২০১১ খ্রিষ্টাব্দের ১লা জুলাই সেতুর মূল কাজের প্রি-কোয়ালিফিকেশন মূল্যায়নে সম্মতি দেয়। সম্মতির পর সেতু বিভাগ দরপত্র আহ্বানের অনুমতি চায়। বিশ্বব্যাংক তাৎক্ষণিক অনুমোদন না দিয়ে প্রক্রিয়াধীন রাখে। এ অবস্থানে এসে বিশ্বব্যাংক মূল কাজে দুর্নীতির কথা বলে। প্রথমে বলা হয়, পদ্মা সেতুতে দুর্নীতি হয়েছে। কিছুদিন পর সুর পাল্টে বলে, দুর্নীতি হয়নি, দুর্নীতির চেষ্টা হয়েছে। এরপর আবারও সুর পালটে দিয়ে বলে, দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের আশঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে। এ কথাগুলো বিশ্বব্যাংক বলেছে তখন, যখন বিশ্বব্যাংক একটি চীনা কোম্পানিকে মূল সেতুর ঠিকাদার প্রাক-যোগ্য করতে বারবার চেষ্টা করেও মূল্যায়ন কমিটি দ্বারা যোগ্য করাতে ব্যর্থ হয়। নানা অজুহাত, বিভিন্ন ব্যাখ্যা এবং ব্যাখ্যার ব্যাখ্যা চেয়েও যখন কোম্পানিটিকে কারিগরি মূল্যায়ন কমিটি দ্বারা যোগ্য করানো সম্ভব হয়নি, তখনই তারা দুর্নীতির অভিযোগ আনে। অথচ বিশ্বব্যাংকের অনুমোদনে ঠিকাদার প্রাক-যোগ্য নির্বাচনের প্রতিটি স্তর অতিক্রম হয়েছে। পরবর্তীকালে মূল সেতু নির্মাণের পরামর্শক নিয়োগের প্রতিটি পদক্ষেপও বিশ্বব্যাংকের প্রত্যক্ষ তদারকি ও অনুমোদনসাপেক্ষে গৃহীত হয়েছিল।
রমেশ
শাহর ডায়ারি প্রসঙ্গে
রমেশ শাহের ডায়ারিতে নাকি এম (M) লেখা ছিল, এম মানে করা হয়েছিল মিনিস্টার। আমি তখন ছিলাম যোগাযোগমন্ত্রী। এম দিয়ে অনেক কিছু হতে পারে। বিশ্বব্যাংক বলছে, এটি নাকি আমার সাংকেতিক নাম। কী উদ্ভট অপকল্পনা, কী হাস্যকর ভাবনা! আসলে M -বর্ণ দিয়ে কী আমাকে না কি অন্য কাউকে ইঙ্গিত করেছে কিংবা রমেশ শাহর ডায়ারিতে আদৌ এমন কিছু ছিল কি না তা নিশ্চিত নয়। অবশ্য শেষ পর্যন্ত কানাডার আদালত এসব বিষয়কে গালগল্প বলে রায় দিয়েছে। গ দিয়ে আমাকে ইঙ্গিত করা হলেও রমেশ শাহ কী কারণে অন্তর্ভুক্ত করেছেন- তা আমার জানা নেই। রমেশ শাহর ডায়ারিতে লেখা- ‘পিসিসি’ তিনি কী উদ্দেশ্যে লিখেছেন তা তিনি নিজেই জানেন। আমার সঙ্গে রমেশ শাহ বা অন্য কারো সঙ্গে অনৈতিক কোনো বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়নি। আমি তাদের কারো সঙ্গে এককভাবে কথা বলিনি, দেখাও করিনি। আমাকে সম্পৃক্ত করে এ ধরনের লেখা (যদি আদৌ থেকে থাকে) তা অসত্য, অন্যায় এবং অযৌক্তিক। রমেশ শাহকে জিজ্ঞাসাবাদ ব্যতিরেকে কল্পিত ডায়ারির বিষয়টি সঠিক ও সত্য ধরে নিয়ে আমার বিরুদ্ধে আনা কোনো অভিযোগই আইনের দৃষ্টিতে গ্রহণযোগ্য ছিল না। এক্ষেত্রে, কথিত ডায়ারির কপি, রমেশ শাহর বক্তব্য এবং তার সঙ্গে আমার কোনো সর্ম্পক আছে কিনা- তা পরীক্ষা-সহ পারিপার্শ্বিক অন্যান্য বিষয়া অনুসন্ধান করে প্রকৃত তথ্য উদ্ঘাটন করা উচিত ছিল। বিশ^ব্যাংক তা না করে নানা উপায়ে আমাকে অপদস্থ করে ও দোষী বানিয়ে পক্ষান্তরে পদ্মা সেতুর কাজকে ব্যাহত করতে চেয়েছিল।
আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ
এরপর বিশ্বব্যাংক প্রাক-যোগ্য নির্বাচনে বাদ পড়া ঠিকাদারের স্থানীয় এজেন্ট দিয়ে আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ উত্থাপন করে এবং এ অভিযোগ পত্রিকায় প্রকাশের ব্যবস্থা করে। এক্ষেত্রে স্থানীয় কতিপয় পত্রিকা তাদের সহযোগী হিসেবে কাজ করে। স্থানীয় এজেন্ট দিয়ে ভুয়া অভিযোগ তোলে। স্থানীয় পত্রিকার মাধ্যমে ভুয়া অভিযোগের ভিত্তিতে দুর্নীতির সন্দেহ পোষণ করে সরকার এবং আমাকে সম্পৃক্ত করে নানা অপপ্রচার চালায়। এ দিয়েই ষড়যন্ত্রের প্রথম সূত্রপাত। অসত্য ও ভিত্তিহীন অভিযোগের ওপর নির্ভর করে কতিপয় পত্রিকা মনগড়া রিপোর্ট করে। যোগাযোগমন্ত্রীর অফিস সংস্কার, নতুন গাড়ি ক্রয়, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে প্রেরণের একটি তথাকথিত সারসংক্ষেপের খসড়া বিকৃতি এবং আমার ব্যক্তিগত কর্মকর্তা ও আমার স্বাক্ষর সুপার ইম্পোজ করে কয়েকটি চিঠির মাধ্যমে অসত্য সংবাদ প্রকাশ করা হয়। এসব পত্রিকা ষড়যন্ত্রমূলকভাবে আমাকে সমালোচিত করেছে। আমাকে উপহাস করে অনেক উপসম্পাদকীয় ও সম্পাদকীয় লেখা হয়েছে। টকশোতে অলোচনা হয়েছে। অথচ এসব অভিযোগের সঙ্গে আমার কোনো সম্পৃক্ততা ছিল না। উদ্দেশ্যমূলকভাবে আমাকে বিতর্কিত করার জন্য এবং পদ্মা সেতু বাস্তবায়নে বাধা সৃষ্টির জন্য এসব অসত্য খবর প্রকাশ করা হয়। আমি এসব ভিত্তিহীন অসত্য খবরের গুরুত্ব দেইনি। কারণ, আমার সততা, স্বচ্ছতা, নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার প্রতি অগাধ বিশ্বাস ছিল। এই বিশ্বাসের জোরে আমি পদ্মা সেতু নির্মাণের কাজ চালিয়ে যাই।
বিশ্বব্যাংকের ইন্ট্রিগ্রিটি বিভাগের কল্পিত
রিপোর্ট এবং রিপোর্টের আলোকে বাংলাদেশের কতিপয় মিডিয়ার রিপোর্টে সরকারের ব্যর্থতা হিসেবে
দেখানো হয়। এসব ভিত্তিহীন অভিযোগ আমলে নিয়ে বিশ্বব্যাংক সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে যোগাযোগ
করে। দুদক তদন্ত করে কোনো সত্যতা খুঁজে পায়নি। বিশ্বব্যাংককে বিষয়টি জানিয়ে দেওয়া হলেও
তারা মিথ্যা অভিযোগের ভিত্তিতে চিঠি দেয় এবং সরকারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে মৌখিকভাবে তা
জানায়। সরকার সুনির্দিষ্ট অভিযোগের তথ্য দেখতে চায়, কিন্তু বিশ্বব্যাংক তা দেখাতে পারে
না। তারা জানায়, বিশ্বব্যাংকের বোর্ড মিটিং-এর সময় তথ্য প্রদান করা হবে। তারা শুধু
রেফারেল তালিকা ছাড়া অন্য কোনো তথ্য প্রদানে ব্যর্থ হয়।
এ পর্যায়ে বিশ্বব্যাংকের তিন সদস্যের একটি বিশেষজ্ঞ, প্যানেল চেয়ারম্যান আইনজ্ঞ লুইস মোরেনো ওকাম্পোর নেতৃত্বে ঢাকা আসে। তারা শুধু রেফারেল তালিকার ভিত্তিতে মন্ত্রী, অর্থনৈতিক উপদেষ্টা ও সচিবকে অ্যারেস্ট করতে বলে; কিন্তু সরকার প্রমাণ ছাড়া কাউকে অ্যারেস্ট করতে অস্বীকার করে। পরবর্তীকালে ওকাম্পোর দল লম্পজম্প করে চলে যায়। তাদের রিপোর্টের ভিত্তিতে তৎকালীন বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট একতরফাভাবে ঋণদান স্থগিত করে দেয়।
ষড়যন্ত্র:
দেশের ক্ষতি
যোগাযোগমন্ত্রীর দায়িত্ব লাভ করে আমি প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ মোতাবেক মন্ত্রীত্বের প্রথম দিন থেকে আন্তরিকভাবে কাজ শুরু করি। প্রতিটি ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করি। সেতুর কার্যক্রমের প্রতি পদক্ষেপে বিশ্বব্যাংকের অনুমোদন নিয়ে দুই বছরে পদ্মা সেতুর প্রস্তুতি কাজ প্রায় শেষ করি। ভূমি অধিগ্রহণ ও পুর্নবাসন কাজ শেষ পর্যায়ে নিয়ে আসি। কোনো ক্ষেত্রেই কোনো অস্বচ্ছতা ছিল না। আমি শত ভাগ সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করি। কিন্তু বিশ্বব্যাংক এবং স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক চক্রান্তকারীরা হঠাৎ ষড়যন্ত্র শুরু করে। অহেতুক অসত্য ও কল্পিত অভিযোগে আমাকে দোষী উপজীব্য করে পদ্মা সেতুর দুর্নীতির গল্প তৈরি করে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে এ দুর্নীতির অভিযোগের গল্প শুনতে হয়। সরকার, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এবং তৎসঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর পরিবারকে অবর্ণনীয় ঝামেলা পোহাতে হয়। ষড়যন্ত্রকারীদের অসত্য খবরে স্ফুলিঙ্গ ছড়ায় কতিপয় জাতীয় পত্রিকা এবং নিশিরাতের টকশোর কুশিলবরা। তারা প্রভাবিত হয়ে অসত্যকে সত্য বানানোর চেষ্টা চালায়। পদ্মায় বহু পানি গড়িয়ে যায়। বিশ্বব্যাংক ঋণ দেওয়া থেকে ২০১২ খ্রিষ্টাব্দের ২৯শে জুন সরে দাঁড়ায়। ষড়যন্ত্রকারীরা দেশের ক্ষতি হয়েছে দেখে আনন্দ উৎসব করে।
চারিদিকের সাঁড়াশি আক্রমণে জনগণ বিভ্রান্ত
হয়। পদ্মা সেতু ষড়যন্ত্রের কবলে পড়ে। আমাকে জড়িয়ে পরামর্শক ও মূল দরদাতা প্রাক-যোগ্য
নির্বাচনে যে দুর্নীতির অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছিল শেষ পর্যন্ত তা মিথ্যা প্রমাণিত হয়।
পদ্মা সেতু এবং আমি সততায় উদ্ভাসিত হই। মাঝখানে অসত্য অভিযোগে পদ্মা সেতু নির্মাণ বিলম্বিত
হয়। এ সময় আমার কষ্ট আর সামাজিক হেনস্থার জন্য কাউকে গালাগাল করিনি বা মন্দ কথা বলিনি।
সত্য তথ্য দিয়ে আসল ঘটনা জানানোর চেষ্টা করেছি। আমার ভালো কথাবার্তা, কার্যকলাপ, পারিবারিকসূত্রে অর্জিত শিষ্টাচার, ব্যবহার এবং
সততার মাধ্যমে আসল অবস্থা তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। শেষ পর্যন্ত দুদকের তদন্ত এবং কানাডার
আদালতের রায় ষড়যন্ত্রকারীদের আনন্দে পানি ঢেলে দেয়। তাঁরা সত্য উপলব্ধি করে। কিন্তু
তাঁরা সত্য কথা বলে না। আর তাই প্রধানমন্ত্রীর খোলামেলা সত্য কথা তাদের গ্রহণ করতে
কষ্ট হচ্ছে। আর কিছু করতে না পেরে সমালোচনা করছে। অথচ ষড়যন্ত্র না হলে, বিশ্বব্যাংক
অর্থায়ন থেকে সরে না গেলে ২০১৩ খ্রিষ্টাব্দের ডিসেম্বরে পদ্মা সেতু চালু হতো। পদ্মা
সেতু নির্মাণ ৯ বছর বিলম্বিত হতো না। এখন দেখা যায়, অনেকে পদ্মা সেতুর ব্যয় বৃদ্ধির
জন্য সমালোচনা করছেন। ভারতের সেতু নির্মাণের সঙ্গে পদ্মা সেতুর ব্যয়ের তুলনা করছেন।
এটি মোটেও যৌক্তিক নয়। পদ্মা একটি উত্তাল প্রকৃতির নদী। এমন প্রকৃতির নদীর উপর সেতু
নির্মাণে ব্যয়ের পরিমাণ ফাউন্ডেশন ও মাটির অবস্থানই নির্ধারণ করে; কাজেই তা প্রাক্কলিত
ব্যয়ে হয় না। এর ব্যয় বৃদ্ধি স্বাভাবিকতায় পড়ে। এর সঙ্গে নতুন করে যুক্ত হয়েছে রেল
লাইন। তাই সবাইকে অনুরোধ করব,“আপনারা সমালোচনার জন্য সমালোচনা
না করে বাস্তবতাকে মেনে নিন। আপনারা এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ নন। শোনা কথায় কান দিয়ে কান চলে
গেছে ভেবে কাকের পেছনে না দৌড়ে আগে গালের পাশে অবস্থিত কানে হাত দিয়ে দেখুন।”
দুর্নীতির অনুসন্ধান ও পরবর্তী পরিস্থিতি
বিশ্বব্যাংকের শেষ প্রস্তাব ছিল আমাকে
যোগাযোগ মন্ত্রণালয় থেকে সরালেই সেতুর কাজ চালিয়ে নেওয়া যাবে। দেশ ও জাতির স্বার্থে
আমি সরে যাওয়ার পরও তারা স্থগিত কার্যক্রম পুনরায় শুরু করেনি। সরকারের ঊর্ধ্বমহল থেকে
বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তারা জানায়, বিষয়টি ব্যাংকের প্রেসিডেন্ট রবার্ট জোয়েলিকের হাতে। শোনা যায়, নিচের দিকে কিছু চেষ্টা
হলেও জোয়েলিকের অনীহার কারণে কাজ শুরু করা যায়নি। বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশ সরকারকে জানিয়ে
দেয়, কানাডিয়ান পুলিশ কর্তৃক এসএনসি-লাভালিনের বিরুদ্ধে চলমান তদন্ত সমাপ্ত না হওয়া
পর্যন্ত সেতুর কাজ শুরু করা হবে না।
এদিকে সরকারের ঊর্ধ্বমহল বুঝতে পারে, পদ্মা
সেতুর কাজে কোনো অনিয়ম বা দুর্নীতি হয়নি। তৎসত্তে¡ও পদ্মা সেতুর কাজ চালিয়ে নেওয়ার
জন্য বিশ্বব্যাংকের ইচ্ছানুসারে আমার মন্ত্রীত্বের দপ্তর বদল করা হলো। তারপরও বিশ্বব্যাংক
কাজ বন্ধ রাখার সিন্ধান্তে অটল থাকে, যা আদৌ সঠিক হয়নি। সরকারের পক্ষ থেকে কয়েকবার
চিঠির মাধ্যমে অনুরোধ এবং একজন উপদেষ্টা বিশ্বব্যাংকের সদর দপ্তরে গিয়ে বিষয়টি নিস্পত্তির
চেষ্টা করে। দুর্নীতি দমন কমিশনও বিষয়টি তদন্ত করে। দুদক তদন্তে মূল সেতুর বিষয়ে যোগাযোগমন্ত্রী
হিসেবে কথিত দুর্নীতির কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তার তদন্ত ও সুনির্দিষ্ট প্রমাণাদি
ছাড়া কাউকে বিশ্বব্যাংকের কথায় বিদায় করা অযৌক্তিক, যেখানে পুরো অভিযোগটিই প্রশ্নবিদ্ধ।
সরকারের উচ্চমহলের সঙ্গে আলোচনা চলাকালে হঠাৎ করে বিশ্বব্যাংকের ঋণচুক্তি বাতিল করার
ঘোষণা স্বেচ্ছাচারের শামিল।
যখন বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতুর কো-অর্ডিনেটর
হিসেবে পাকিস্তানি বংশোদ্ভুত বিহারি জনাব মাসুদ আহমদকে নিয়োগ দেয় তখনই আমার শঙ্কা হয়েছিল
যে, পদ্মা সেতু নির্মাণে বিশ্বব্যাংক বিলম্বের আশ্রয় নেবে। তাই আমি পদ্মা সেতু দ্রুত
নির্মাণের লক্ষ্যে বিশ্বব্যাংকের পরিবর্তে এডিবির কো-অর্ডিনেটর নিয়োগের প্রস্তাব দিয়েছিলাম।
বিশ্বব্যাংক ঋণের বেশিরভাগ অর্থায়নের সুবাদে
পদ্মা সেতুতে লিড ডোনারের আগ্রহ দেখায় এবং লিড ডোনার হওয়ার সুযোগ পায় যা শেষ পর্যন্ত
পদ্মা সেতুর জন্য অভিশাপ হয়ে দাঁড়ায়। আমি চেয়েছিলাম, এডিবি লিড ডোনারের দায়িত্ব পাক।
এডিবির তৎকালীন ভাইস-প্রেসিডেন্ট মি. ওয়াং-এর সঙ্গে আমি কথা বলি। তারাও লিড ডোনার হতে
চায়।মি. ওয়াং বলেছিলেন,“প্রয়োজনে আমরা বিশ্বব্যাংকের চেয়ে বেশি
অর্থায়ন করব এবং প্রজেক্ট কো-অর্ডিনেটর হিসেবে বাংলাদেশ সরকার যাকে নিয়োগ দেবে তিনিই
পদ্মা সেতুর কার্যক্রম বাস্তবায়নে শীর্ষ কর্মকর্তা হবেন।” অর্থাৎ নীতিনির্ধারণ
কার্যক্রম অনুমোদনের জন্য সদর দপ্তরে যেতে হবে না। বঙ্গবন্ধু সেতু নির্মাণে এডিবি লিড
ডোনার ছিল এবং প্রজেক্ট কো-অর্ডিনেটর এডিবি দিয়েছিল। এই প্রজেক্ট কো-অর্ডিনেটরের সিদ্ধান্ত
ডোনারদের সিদ্ধান্ত বলে গণ্য হতো। আমি বিষয়টি তৎকালীন অর্থমন্ত্রীকে অবহিত করি। কিন্তু
তিনি বিশ্বব্যাংকের ওপর দায়িত্ব দিলেন। বিশ্বব্যাংকে চাকরি করেছিলেন বলে তিনি বিশ্বব্যাংকের
প্রতি অনুরক্ত ছিলেন বলে অনুমেয়।
যখন বিশ্বব্যাংক পাকিস্তানি বংশোদ্ভুত জনাব মাসুদ আহমাদকে নিয়োগ দেয়, তখন তার ব্যাপারে আমি আপত্তি তুলেছিলাম। তাকে প্রজেক্ট কো-অর্ডিনেটর হিসেবে গ্রহণ না করতে তৎকালীন অর্থমন্ত্রীকে অনুরোধ করেছিলাম। জনাব মাসুদের পরিবর্তে কোনো ইউরোপীয় বা সুইডেনের কাউকে আনতে বলেছিলাম। কিন্তু আমার এ অনুরোধ অর্থমন্ত্রী গ্রহণ করেননি। অবশ্য বিষয়টি আমি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে জানাইনি।
নিয়োগের পর দেখা যায়, জনাব মাসুদ আহমদ
পদ্মা সেতু সংশ্লিষ্ট লোকদের চেয়ে বাইরের লোকদের সঙ্গে বেশি যোগাযোগ রাখতেন। তাদের
সঙ্গে কী বলতেন- জানি না। তবে তার বাইরের লোকদের সঙ্গে বহুমুখী কার্যক্রম বন্ধ হয়নি।
বিশ্বব্যাংকের আবাসিক প্রতিনিধি গোল্ড স্টেইন তাকে সহযোগিতা করতেন। প্রজেক্ট কো-অর্ডিনেটর
ও গোল্ড স্টেইন-এর কার্যক্রম ইতিবাচক ছিল না। পদ্মা সেতু প্রকল্প বাস্তবায়নে ধীরগতি
এবং বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে বন্ধে- এ দুজন সম্পৃক্ত ছিলেন বলে অনুমেয়।
ওকাম্পোর দুর্নীতি
মূলত বিশ্বব্যাংকের বিশেষজ্ঞ প্যানেলের
প্রধান লুইস মোরেনো ওকাম্পোর নেতিবাচক রিপোর্টে বাংলাদেশের স্বপ্নের পদ্মা সেতুর অর্থায়ন
থেকে বিশ্বব্যাংক সরে যায়। অথচ ওকাম্পো আজ বিশ্বের বড়ো দুর্নীতিবাজ হিসেবে চিহ্নিত।
ওকাম্পোর দুর্নীতির চল্লিশ হাজার নথি ইতিমধ্যে মিডিয়ায় প্রকাশিত হয়েছে। ওকাম্পোর নেতিবাচক
রিপোর্ট পদ্মা সেতু নিয়ে বাংলাদেশকে বিতর্কিত ও সমালোচিত করেছে। তৎকালীন যোগাযোগমন্ত্রী
হিসেবে আমার সততাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। এই দুর্নীতিবাজ ওকাম্পোর পরামর্শেই বিশ্বব্যাংক
গ্লোবাল সার্চ করে আমার সম্পর্কে কোনো অনিয়ম পায়নি। বিশ্বব্যাংক আজ পদ্মা সেতুর অর্থায়ন
করতে না পেরে বিশ্বব্যাপী লজ্জিত। আমার কাছে অনুতপ্ত। সেই উদ্ধতবাদী ওকাম্পো আজ বিশ্বব্যাপী
নিন্দিত ও বিতর্কিত। বাংলাদেশের কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তি বৈঠক করে পদ্মা সেতু প্রকল্পের
দুর্নীতি প্রমাণের জন্য তার অপচেষ্টার সঙ্গী হয়েছিলেন। আজ সত্য প্রকাশিত হয়েছে। আমি
নির্দোষ প্রমাণিত হয়েছি।
ওকাম্পোর রিপোর্টে পদ্মা সেতুতে দুর্নীতির
ষড়যন্ত্রের আশঙ্কাকে উপজীব্য করে বিশ্বব্যাংক অর্থায়ন থেকে সরে যায়। সরে যাওয়ার জন্য
সৃষ্ট কাল্পনিক অভিযোগের অজুহাতে বিশ্বব্যাংকের এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়া ঠিক হয়নি।
পদ্মা সেতুর স্বার্থে আমি পদত্যাগ করার পরও বিশ্বব্যাংক ঋণ দিতে এগিয়ে আসেনি। এটা প্রমাণ
করে- বিশ্বব্যাংক ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে পদ্মা সেতুতে ঋণ দেয়নি। প্রস্তুতিপর্বে দুর্নীতির
ষড়যন্ত্রের আশঙ্কা ছিল অমূলক, ভিত্তিহীন, কাল্পনিক, বায়বীয় এবং উদ্দেশ্যমূলক। পরে পদ্মা
সেতুর দুর্নীতির মামলায় অভিযুক্তদের বাংলাদেশের আদালত নির্দোষ বলে রায় দেয়। কানাডার
আদালতও একই অভিযোগে আনীত মামলায় কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি বলে রায় দেয়, গালগল্প বলে
মন্তব্য করে। আমি কোনো অন্যায় ও অসত্যের সঙ্গে কখনো আপস করিনি। বিশ্বব্যাংকের গ্লোবাল
সার্চ ও দুদকের নিবিড় তদন্ত আমার সম্পর্কে কোনো অনিয়ম খুঁজে পায়নি- যা তার প্রমাণ।
পদ্মা সেতুর কোনো প্লান ছিল না, চূড়ান্ত
ডিজাইন ছিল না, অর্থের সংস্থান ছিল না। কোনো দাতা সংস্থার কমিটমেন্ট ছিল না। দুবছরে
প্রস্তুতিকাজ সম্পন্ন করে ঠিকাদার প্রাক-যোগ্য নির্বাচন চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে এসেছিলাম।
সেই প্রাক-যোগ্য ঠিকাদারই এখন পদ্মা সেতু নির্মাণ করেছে। পদ্মা সেতুর কাজ যেভাবে আমি
এগিয়ে নিয়েছিলাম- তাতে সরকারের প্রথম মেয়াদে ২০১৩ খ্রিষ্টাব্দের ডিসেম্বরে পদ্মা সেতু
চালু হতো। বঙ্গবন্ধু সেতু নির্মাণের প্রস্তুতি কাজ করতে যেখানে ১০ বছর লেগেছে, মাননীয়
প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে পদ্মা সেতুর সে পর্যায়ের কাজ আমি দুবছরে শেষ করেছি। বিশ্বব্যাংক
ও দেশীয় স্বার্থান্বেষী মহলের ষড়যন্ত্রে ২০১৩ খ্রিষ্টাব্দে পদ্মা সেতুর চালু করা সম্ভব
হয়নি। বাংলাদেশের অব্যাহত উন্নয়নে এটি একটি বিরাট বাধা হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। আমি
মনে করি, বাংলাদেশের ষড়যন্ত্রকারীরাও একদিন ওকাম্পোর মতো নানা প্রশ্নের সম্মুখীন হবেন।
বিশ্বব্যাংক: পদ্মা সেতু প্রকল্পে অর্থায়ন থেকে বঞ্চিত
স্বল্পোন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের সরকার এবং
সরকারি প্রতিষ্ঠানের মর্যাদা ও জবাবদিহিকে দাতা সংস্থা সবসময় খাটো করে দেখে। দুদক বিশ্বব্যাংকের
অভিযোগের কোনো ভিত্তি ও সত্যতা খুঁজে পায়নি। তারা এটি বিশ্বব্যাংককে জানিয়ে দিলে বিশ^ব্যাংক
দুদকের তদন্ত সরকারকে বাঁচানোর অজুহাত হিসেবে দেখল। কিন্তু কানাডার আদালতের রায় তাদের
সত্যের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়। এরপর তারা চুপ হয়ে যায়। মূলত পদ্মা সেতুতে অর্থায়ন
বন্ধ করা ছিল বিশ্বব্যাংকের একটি ভুল সিদ্ধান্ত। পদ্মা সেতুতে বিশ্বব্যাংকের মিথ্যা
অভিযোগের তদন্ত করাটাই ছিল ধৃষ্টতার সামিল। যেখানে ঠিকাদার নিয়োগ হয়নি, কনসালটেন্ট
নিয়োগ হয়নি, ঋণচুক্তি স্বাক্ষর হয়নি, অর্থ ছাড় হয়নি- সেখানে দুর্নীতির আশঙ্কা বা দুর্নীতির
অভিযোগ এক ধরনের প্রতারণা। এটা কোনো আইনে বা সিস্টেমে পড়ে না। তাই বিশ্বব্যাংকের সিদ্ধান্ত
ছিল ভুল। এই ভুল সিদ্ধান্তের কারণে বাংলাদেশ ক্ষতিগ্রস্ত হলো এবং বিশ্বব্যাংক পদ্মা
সেতুর মতো একটি বড়ো প্রকল্পে অর্থায়নের সুযোগ হারাল। পরে শুনেছি, বিশ্বব্যাংকের তৎকালীন
প্রেসিডেন্ট রবার্ট জোয়েলিক প্রভাবিত হয়ে বিশ্বব্যাংকের বোর্ড সভায় আলোচনা না করে এবং
অনুমোদন না নিয়ে নিজ উদ্যোগে পদ্মা সেতুর অর্থায়ন স্থগিত করে দিয়েছিলেন। বিশ্বব্যাংকের
অধিকাংশ কর্মকর্তাই অর্থায়ন স্থগিতের বিষয় সমর্থন করেননি। বিশ্বব্যাংকের তৎকালীন প্রেসিডেন্টের
সঙ্গে চায়নায় বোয়াও ফোরামে এক অনুষ্ঠানে আমার সাক্ষাৎ হয়, পরিচয় হয়। তখন তিনি পদ্মা
সেতুর অর্থায়ন বাতিল করার বিষয়ে দুঃখ প্রকাশ করেন। রবার্ট জোয়েলিকের মতো বিশ্বব্যাংকের
হাতে গোনা কতিপয় কর্মকর্তার ষড়যন্ত্রের কারণে পদ্মা সেতু অর্থায়ন না করার দায় বিশ্বব্যাংককে
নিতে হলো। আমি মনে করি, বিশ্বব্যাংক আগামী ১০০ বছরেও পদ্মা সেতুর মতো এমন মেগা প্রকল্প
বাস্তবায়নের সুযোগ পাবে না। বিশ্বব্যাংকের সেই রবার্ট জোয়েলিক এখন কোথায়? মিস গোল্ড
স্টেইন এখন কোথায়?সেই লুইস মোরেনো ওকাম্পো কোথায়?ওকাম্পো একজন দুর্নীতিবাজ। এ খবর দেশ-বিদেশের
পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। অথচ ওকাম্পো বাংলাদেশে এসে সততার নামে মিথ্যা নাটক করেছে,
ভণ্ডামি করেছে পদে পদে; বাংলাদেশের অব্যাহত উন্নয়নকে এক দশক পিছিয়ে দিয়েছে। জাতি তাদের
কখনো ক্ষমা করতে পারবে না।
পদ্মা সেতু, আমি এবং বাংলাদেশ
আমার কর্মজীবনে, ব্যবসায়িক জীবনে এবং সরকারি
দায়িত্ব পালনে সর্বদা স্বচ্ছতা, জবাবদিহি ও ইন্ট্রিগ্রিটিতে বিশ্বাসী একজন পরিচ্ছন্ন
মানুষ। আমি কোনো দিন, কোনো সময়, কোনো অন্যায়কে প্রশ্রয় দিইনি। সরকারি নিয়ম-আইন ভঙ্গ করে কোনো নথিতে স্বাক্ষর
করিনি। পদ্মা সেতুর ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করেছি। প্রধানমন্ত্রীর
নির্দেশে লক্ষ্য অনুযায়ী ২০১৩ খ্রিষ্টাব্দের ডিসেম্বরে পদ্মা সেতু চালু করার বিষয়ে
বদ্ধপরিকর ছিলাম। আমাদের লক্ষ্য ছিল পরবর্তী নির্বাচনে এটা সরকারের সাফল্য হিসেবে জনগণের
কাছে তুলে ধরা। পদ্মা সেতু নির্মাণের প্রস্তুতি পর্যায়ে যে, কোনো অনিয়ম হয়নি, দুর্নীতি
হয়নি- তা আজ দিবালোকের মতো পরিষ্কার। অথচ এই পদ্মা সেতু নিয়ে সংগঠিত ও পরিকল্পিত দেশি
ও বিদেশি ষড়যন্ত্রের কারণে পদ্মা সেতু নির্মাণ ৯ বছর পিছিয়ে গেছে। নিজস্ব অর্থায়নে
পদ্মা সেতু বাস্তবায়ন করতে হয়েছে। আর বিনাদোষে আমাকে ষড়যন্ত্রের বলি হতে হয়েছে। দেশের
স্বার্থে, পদ্মা সেতুর স্বার্থে আমাকে পদত্যাগ করতে হয়েছে। দেশ-বিদেশে আমার মর্যাদা
ও সুনাম বিনষ্ট হয়েছে। দেশের ক্ষতি হয়েছে। পদ্মা সেতুর বাস্তবায়ন বিলম্বিত হয়েছে। বিলম্বের
কারণে পদ্মা সেতুর নির্মাণ ব্যয় বেড়েছে। পদ্মা সেতু নিয়ে যারা আড়ালে-আবডালে ষড়যন্ত্র
করেছে, সেসব রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা, বিশ্বখ্যাত ব্যক্তিরা ষড়যন্ত্র
করেছে, তারাই এ অতিরিক্ত ব্যয় ও বিলম্বের জন্য দায়ী। ষড়যন্ত্রকারীরা ২০১৩ খ্রিষ্টাব্দের
ডিসেম্বরে আওয়ামী লীগ সরকার যাতে পদ্মা সেতু নির্মাণ শেষ করতে না পারে এবং পদ্মা সেতু
বাস্তবায়নের ‘বিজয় নিশান’ প্রধানমন্ত্রী
শেখ হাসিনার হাতে না ওড়ে- সেই ব্যবস্থাই পাকাপোক্ত করতে চেয়েছিল।
রাখে আল্লাহ মারে কে ?
সকল ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করে নিজস্ব অর্থায়নে
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদ্মা সেতু বাস্তবায়নের ঘোষণা দেন। পদ্মা সেতু নির্মাণের
পরবর্তী ইতিহাস সবার জানা। পদ্মা সেতুতে সরকার এবং যোগাযোগমন্ত্রী হিসেবে আমার যে,
কোনো অনিয়ম ছিল না, কোনো দুর্নীতি ছিল না এবং কোনো স্তরে যে, কোনো দুর্নীতি হয়নি তা
দুদকের তদন্ত ও কানাডার আদালতের রায়ে প্রমাণিত হয়েছে। পরবর্তীকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ
হাসিনার সাহসী পদক্ষেপ এবং সততা বিশ্বব্যাংককে বাংলাদেশের বিপক্ষে কোনো কিছু করার বা
বলার বিষয়ে চিন্তা করতে হবে- এমন সতর্কবার্তা দিতে সক্ষম হয়। পদ্মা সেতু বাস্তবায়নে
বিশ্বব্যাংক-সহ অন্যান্য দাতাগোষ্ঠী ঋণচুক্তি স্বাক্ষরের পরও সরে যাওয়ায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী
সাহসিকতার সঙ্গে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন- নিজেদের টাকায় পদ্মা সেতু বাস্তবায়ন করবেন। এই
সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের ক্ষেত্রেও বিশ্বব্যাংক-প্রীতির কারণে তৎকালীন অর্থমন্ত্রী ধীরগতিতে
অগ্রসর হন। এমনকি বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে দেন-দরবার করে কালক্ষেপণ করেন। এই কালক্ষেপণ
করাটিও সমীচীন ছিল না। অন্যদিকে মালয়েশিয়াকে দিয়ে পদ্মা সেতু বাস্তবায়নের যে অযৌক্তিক
প্রচেষ্টা নেওয়া হয়েছিল- সেটাও ছিল একটি ভুল সিদ্ধান্ত। এসব বিষয় নিয়ে অযথা সময় নষ্ট
করা হয়। কিছুটা বিলম্ব হলেও নিজস্ব অর্থায়নে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর পদ্মা সেতু বাস্তবায়নের
সিদ্ধান্ত বাংলাদেশকে ঘুরে দাঁড়াতে সাহায্য করে। এটা বাংলাদেশের সক্ষমতার নতুন অগ্রযাত্রা।
এতে করে বর্হিবিশ্বে দেশের ভাবমুর্তি উজ্জ্বল হয়েছে। নজির সৃষ্টি হয়েছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী
শেখ হাসিনার জনকল্যাণমুখী সিদ্ধান্ত, জাদুকরি নেতৃত্ব, বিরল সাহস ও অনাবিল ব্যক্তিত্বের
অনুশীলনে বিলম্বে হলেও আমরা পদ্মা সেতু বাস্তবায়ন করার অঙ্গীকার পূরণ করতে সক্ষম হয়েছি।
এজন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর প্রতি রইল সীমাহীন কৃতজ্ঞতা।
পদ্মা সেতু: দেশীয় ষড়যন্ত্র এবং মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর হিউমার
বিশ্বব্যাংক এবং দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র
পদ্মা সেতু বাস্তবায়নের অন্তরায় ছিল। দেশের ভেতরে কতিপয় ব্যক্তি ও জাতীয় দৈনিকের প্রতিদিনকার
অসত্য খবর এ ষড়যন্ত্রের হাতকে শক্তি যোগায়। কথায় আছে, “অপরিচিত লোক বা বাইরের লোক অপেক্ষা দেশের ভেতরকার শত্রু
অধিক ভয়ংকর”। পদ্মা সেতুর
ক্ষেত্রে আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব এবং সুশীল সমাজ পরিচয়ে কিছু ব্যক্তি জ্ঞানীর পরিচয়ে
পদ্মা সেতু নির্মাণের পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তাদের সেসময়কার কথাবার্তা পদ্মা সেতু
নির্মাণের অনুকূলে ছিল না। তারা চায়নি পদ্মা সেতু আওয়ামী লীগের হাত ধরে বাস্তবায়িত
হোক। তাদের এমন ঘৃণ্য কর্মকাÐ পদ্মা সেতুর অর্থায়ন থেকে বিশ্বব্যাংকের সরে পড়ার অন্যতম
ইন্ধন ছিল- এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।
গত ২০২২ খ্রিষ্টাব্দের ১৮ই মে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে “দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস” উপলক্ষ্যে আওয়ামী লীগের ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ উপকমিটি আয়োজিত অনুষ্ঠানে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভার্চুয়াল মিটিঙে যুক্ত হন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ অনুষ্ঠানে বলেন, “আজ পদ্মা সেতু বাস্তবায়ন অবয়বে দাঁড়িয়ে আছে। অচিরেই যান চালাচলে পদ্মা সেতু খুলে দেওয়া হবে। কিন্তু এ পদ্মা সেতু নির্মাণে দেশীয় আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র সক্রিয় ছিল। যার কারণে পদ্মা সেতু বাস্তবায়ন বিলম্বিত হয়েছে। সে সময় কতিপয় রাজনৈতিক দল ও সুশীল সমাজ বিশ্বব্যাংক দ্বারা অর্থায়ন স্থগিত করেছে।” এ অনুষ্ঠানে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদ্মা সেতু নির্মাণের সফলতা প্রসঙ্গে বলেন- “সে সময় বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া বলেছিল- জোড়াতালি দিয়ে পদ্মা সেতু বানাচ্ছে, ওটায় চড়া যাবে না। চড়লে ভেঙে পড়বে। আবার তার সঙ্গে কিছু দোসরও ছিল। তাদের এখন কী করা উচিত? পদ্মা সেতুতে নিয়ে গিয়ে ওখান থেকে টুস করে পদ্মায় ফেলে দেওয়া উচিত”। এ প্রসঙ্গে তিনি আরও উল্লেখ করেন, “এক ব্যক্তি একটি ব্যাংকের এমডি পদের জন্য পদ্মা সেতুর মতো সেতুর টাকা বন্ধ করেছে, তাকে পদ্মা নদীতে দুইটা চুবানি দিয়ে সেতুতে তোলা উচিত। তাতে যদি শিক্ষা হয়।” প্রধানমন্ত্রীর সহজ, সরল ও সত্য কথাকে অনেকে নেতিবাচক হিসেবে দেখেছেন।অথচ কথাগুলো ছিল তাঁর স্বভাবজাত ব্যক্তিত্বময় রসবোধের প্রাণময় উচ্ছ্বাসে ভরপুর বাক্য বিন্যাস। তিনি চোরকে চোর না বলে নিশিকুটুম্ব বলেছেন। এতে তার বক্তব্যের শোভনীয় রূপটাই পরিস্ফুট হয়েছে। যারা সমালোচনা করছেন, তাদের বিষয়টা অনুধাবন করা উচিত।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর এ বক্তব্য ছিল মূলত সত্যের প্রতিফলন, কষ্ট ও দুঃখের প্রতিচ্ছবি। সহজ ভাষায় তিনি জনগণের দুঃখ ও বেদনাকে তাঁর বক্তব্যে তুলে ধরেছেন। তিনি বাবা-মা ও ভাইদের হারিয়ে হাজারো কষ্ট বুকে চেপে রেখে এদেশের মানুষের কল্যাণে রাজনীতি করছেন। দেশের উন্নয়নে কাজ করছেন। দেশকে এগিয়ে নিচ্ছেন। বিদ্যুৎ, শিক্ষা, যোগাযোগ ও সামাজিক খাতের উন্নয়নে ব্যাপক কাজ করেছেন। পদ্মা সেতুকে নিজস্ব অর্থায়নে বাস্তবায়ন করে বিশ্বে বাংলাদেশের সক্ষমতা তুলে ধরেছেন। শেখ হাসিনার সততা ও সাহসের সোনালি ফসল পদ্মা সেতু। বাংলাদেশের সামর্থ্যরে স্মারক পদ্মা সেতু। তাই পদ্মা সেতু চালুর প্রাক্কালে পদ্মা সেতুর বাস্তবায়নের তীব্র বাধাগুলো সম্পর্কে বলতে গিয়ে এসব কথা তিনি খোলাখুলি বলেছেন- কিছু সূক্ষ্ম রসবোধের মাধ্যমে। যাকে সাহিত্যের ভাষায় বলা যায় “হিউমার” বা হাস্যরস বলা যায়। এসব বক্তব্যকে কারো অশালীন বলা কিংবা কাউকে হত্যার হুমকি হিসেবে দেখা কিংবা রাজনৈতিক শিষ্টাচার বর্হিভূত বলার কোনোযুক্তি নেই। এটা রাজনৈতিকভাবে নেওয়াও কাম্য নয়। পদ্মা সেতুর বিরুদ্ধে তাদের কথা বিবেচনা করে বাস্তবতার দৃষ্টিতে দেখাই উচিত। উল্লেখ্য, আওয়ামী লীগ সরকার পূর্বের দুই মেয়াদ সরকারে না এলে পদ্মা সেতু নির্মিত হতো না। দেশের মানুষের কাছে ‘স্বপ্নের পদ্মা সেতু’ অধরাই থেকে যেত।
পদ্মা সেতু ঋণদান স্থগিত: বিশ্বব্যাংকের তৎকালীন প্রেসিডেন্টের দুঃখপ্রকাশ
বোয়াও ফোরাম ফর এশিয়ার এক সম্মেলনে বিশ্বব্যাংকের
তৎকালীন প্রেসিডেন্ট রবার্ট জোয়েলিকের সঙ্গে আমার দেখা হয়। তিনি নিজ ক্ষমতাবলে পদ্মা
সেতুর ঋণচুক্তিটি বাতিল করেছিলেন। তিনি ওই সম্মেলনে আমাকে জানান, “ঋণচুক্তি বাতিলের
জন্য আমি দুঃখিত। বাংলাদেশি কতিপয় পত্রিকার রিপোর্টে বিভ্রান্ত হয়ে এমন ভুল সিদ্ধান্ত
নিয়েছিলাম।” তার মনের কথা আমি জানি না, কিন্তু মুখের কথা শুনে
মনের কষ্ট অনেকটা দুরীভ‚ত হয়ে গিয়েছিল।
পদ্মা সেতু: আমার প্রতি অন্যায় আচরণে অর্থমন্ত্রীর দুঃখ প্রকাশ
বিশ্বব্যাংকের মিথ্যা অভিযোগ এবং দেশীয় পত্র-পত্রিকার ভুয়া অভিযোগে সরকারের মন্ত্রিসভার কতিপয় প্রভাবশালী সদস্য সেসময় প্রভাবিত হয়ে আমার বিরুদ্ধাচরণ করতেও দ্বিধা করেননি। বিশেষ করে, বিশ্বব্যাংকের প্রাক্তন যেসব কর্মকর্তা তখন মন্ত্রী বা সমপর্যায়ের দায়িত্বে ছিলেন তারা বিশ্বব্যাংকের পক্ষ নিয়ে পদে পদে আমার বিরুদ্ধাচরণে করেছেন। তন্মধ্যে অর্থমন্ত্রী এম এ মুহিত এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ক উপদেষ্টা ড. গওহর রিজভী ছিলেন অন্যতম। বিশ্বব্যাংক চতুরতার সঙ্গে এমন সব শর্ত জুড়ে দেয় যে, আমি যদি পদত্যাগ করি বা আমাকে যদি যোগাযোগ মন্ত্রণালয় থেকে অন্য মন্ত্রণালয়ে নিয়ে যাওয়া হয় তাহলে বিশ্বব্যাংক অর্থায়নে ফিরে আসবে। আমাকে অন্য মন্ত্রণালয়ে সরিয়ে দেওয়ার পর বিশ্বব্যাংক আবার নতুন শর্ত জুড়ে দিল- আমাকে মন্ত্রিসভা থেকে বাদ দিতে হবে। আমাকে মন্ত্রিসভা থেকে বাদ দিলে বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতুতে অর্থায়ন অব্যাহত রাখবে। শুনেছি এ বিষয়ে অর্থমন্ত্রী এমএ মুহিত এবং ড. গওহর রিজভী মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলেছিলেন।তারা বিশ্বব্যাংকের মিথ্যা আশ্বাসে প্রভাবিত হয়ে আমাকে পদত্যাগ করানোর জন্য বিভিন্ন জায়গায় দৌড়ঝাঁপ করেন। পরিস্থিতি অনুধাবন করতে পেরে পদ্মা সেতু নির্মাণ, নিরপেক্ষ তদন্ত এবং জাতীয় স্বার্থে আমি স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করি। তারপরও বিশ্বব্যাংক স্থগিত অর্থায়ন অবমুক্ত করেনি। এর অর্থ দাঁড়ায়, পদ্মা সেতু, সরকার ও আমার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ ছিল ভুয়া; মূল্য উদ্দেশ্য ছিল পদ্মা সেতু নির্মাণ ব্যাহত করা।
আমি মনে করি, বিশ্বব্যাংকের ইতিহাসে এই ঋণচুক্তি বাতিল ছিল মারাত্মক একটি ভুল। পরবর্তীকালে যা তাদের চরম লজ্জায় ফেলে দিয়েছিল। যেখানে ঋণের অর্থ ছাড় হয়নি, ঠিকাদার নিয়োগ হয়নি, কনসালটেন্ট নিয়োগ হয়নি- সেখানে দুর্নীতির আশঙ্কা বা দুর্নীতি সংগঠিত হয় কীভাবে। অথচ এই মিথ্যা ও অনুমেয় দুর্নীতির তদন্ত করার জন্য বিশ্বব্যাংক ল-ইয়ার প্যানেল নিয়োগ করে লুইস ওকাম্পোর নেতৃত্বে। ওকাম্পো বাংলাদেশে এসে যুক্তি বা উপাত্ত ছাড়া বাংলাদেশের দুর্নীতি নিয়ে লম্পজম্প করলেন। কারণ ছাড়া, যুক্তি ছাড়া, প্রমাণ ছাড়া প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা মশিউর রহমান, সেতু সচিব মোশাররফ হোসেন ভুঁইয়া এবং আমাকে এ্যারেষ্ট করানোর চেষ্টা করলেন- যা ছিল অমার্জনীয় অপরাধ। পরবর্তীকালে আমি শুনেছি, অর্থমন্ত্রী বাসায় বিশ্বব্যাংক ল-প্যানেলের এক বৈঠক হয়। এ সময় গওহর রিজভী, দুদক চেয়ারম্যান ও দুদকের কমিশনারগণ উপস্থিত ছিলেন।
এ বৈঠকে বিশ্বব্যাংক ল-প্যানেল, বিশ্বব্যাংকের রেফারেল তালিকার ভিত্তিতে আমাদের বিরুদ্ধে মামলা করে এ্যারেষ্ট করতে বলেন। তাদের এ দাবির প্রতিক‚লে অর্থমন্ত্রী ও গওহর রিজভী তেমন জোরালো আপত্তি জানাননি। বিশ্বব্যাংক ও বিশ্বব্যাংকের ইনট্রিগ্রিটি নিয়েও তাঁরা কোনো কথা বলেননি। বাংলাদেশের প্রতি যে এটা অবিচার- তাও তাঁরা তাদের কথায় উল্লেখ করেননি। তবে, দুদকের কমিশনার জনাব সাহাবুদ্দিন চুপ্পু বলেছিলেন, “আমি দীর্ঘকাল বিচারক ছিলাম। বিশ্বব্যাংকের রেফারেল তালিকার ভিত্তিতে প্রমাণ ছাড়া কারো বিরুদ্ধে মামলা কিংবা গ্রেফতার করা যায় না”। একথা তিনি মিডিয়ায় বলেছিলেন। পরবর্তীকালে বিশ্বব্যাংকের চাপে সেতু সচিব মোশাররফ হোসেন ভঁইয়াকে গ্রেফতার করা হয়।
এ সময় বিশ্বব্যাংকের আস্ফালন এবং পদ্মা
সেতু নির্মাণের স্বার্থে পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে আমি অনুরোধ
করেছিলাম- সেতু বিভাগকে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অধীনে নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক
উপদেষ্টা মশিউর রহমানকে সেতু বিভাগের দায়িত্ব দিতে। এর আগে সেতু বিভাগ রাষ্ট্রপতির
কার্যালয়ের অধীন ছিল। এ বিষয়টি আমি গওহর রিজভীকেও জানিয়েছিলাম। সে সময় গওহর রিজভীর
বাসায় বাংলাদেশ ব্যাংকের তৎকালীন গর্ভনর আতিউর রহমান ছিলেন। তাঁর উপস্থিতিতে আমি বলি,
যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ে থাকতে আমি আগ্রহী নই। আমি চাই, পদ্মা সেতু বাস্তবায়ন হোক- প্রধানমন্ত্রীর
অঙ্গীকার ও দেশের মানুষের আকাক্সক্ষা পূরণ হোক। গওহর রিজভী বিষয়টি ইতিবাচকভাবে গ্রহণ
করে এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলবেন মর্মে আমাকে আশ্বস্ত করেন। পরে আমাকে আইসিটি
মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়। কিন্তু এরপরও বিশ্বব্যাংক অর্থায়নে ফিরে আসেনি।
পদ্মা সেতুর অর্থায়ন থেকে বিশ্বব্যাংক সরে গেলে তৎকালীন অর্থমন্ত্রী এম এ মুহিত বিশ্বব্যাংকের চতুরতা, পদ্মা সেতু বাস্তবায়নে বিশ্বব্যাংকের বিলম্বের কারণ এবং তাদের ষড়যন্ত্র বুঝতে পেরেছিলেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন বিশ্বব্যাংককে লিড ডোনার এবং পাকিস্তানি বংশদ্ভুত জনাব মাসুদ আহমদকে কো-অর্ডিনেটর নিয়োগ করা ঠিক হয়নি। এসময় তিনি বিশ্বব্যাংকের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট রবার্ট জোয়েলিককে ‘Worthless’ আখ্যায়িত করেন। আমার প্রতি অর্থমন্ত্রী যে অন্যায় করেছেন, আমার সততার প্রতি সন্দেহ পোষণ করে বিশ্বব্যাংকের মিথ্যা অভিযোগ বিশ্বাস করেছেন- তা বুঝতে পারলেন। আমি মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করার পর তিনিই মন্ত্রিসভার একমাত্র সদস্য যিনি আমাকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য, নিজের ভুল কার্যক্রম স্বীকার করার জন্য আমার গুলশানস্থ বাসায় ছুটে এসেছিলেন। কেন তিনি আমার বাসায় এসেছিলেন জানি না। তবে অপরাধ বোধ থেকেই তিনি আমার বাসায় এসেছিলেন বলে অনুমেয়। মন্ত্রিসভার অন্য কোনো সদস্য তখন আমার বাসায় যাননি বা টেলিফোন করে সহমর্মিতা পর্যন্ত দেখাননি। আমি নির্দোষ- এ সত্য উপলব্ধি করতে পেরে সাবেক অর্থমন্ত্রী আমার বাসায় গিয়ে উদারতার পরিচয় দিয়েছেন। পরবর্তীকালে যখনই তাঁর সঙ্গে দেখা হয়েছে, তিনি নিজের ভুল স্বীকার এবং আমার প্রতি অবিচারের বিষয় উল্লেখ করে আমাকে সান্ত্বনা দিতেন । বর্ষসেরা করদাতা হিসেবে এনবিআর আমার হাতে পুরস্কার তুলে দিতে গিয়ে তিনি আমার সততার ভূয়সী প্রশংসা করেছেন।
সর্বশেষ বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস পত্রিকা আমাকে শিক্ষায় অবদানের জন্য দেশের যুগশ্রেষ্ঠ শিক্ষা-উদ্যোক্তা হিসেবে স্বর্ণপদক ও সম্মাননা প্রদান করে। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ছিলেন অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি। প্রধান অতিথির ভাষণে অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন, “পদ্মা সেতু নিয়ে নানা ষড়যন্ত্রের পাশাপাশি সৈয়দ আবুল হোসেনের বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ তুলে যে অন্যায় করা হয়েছে, তজ্জন্য আমি সবার পক্ষ থেকে দুঃখ প্রকাশ করছি ও ক্ষমা চাইছি। সৈয়দ আবুল হোসেনের প্রতি আমিও ব্যক্তিগতভাবে অন্যায় করেছি। তাঁকে আমি ভুল বুঝেছি। সত্যিকারভাবে পদ্মা সেতুর কার্যক্রমে তাঁর কোনো অনিয়ম ছিল না। আমি বিশ্বব্যাংকের কথা শুনে ব্যক্তিগতভাবে আবুল হোসেনের সততার প্রতি অবিচার করেছি। আমি লজ্জিত এবং দুঃখিত”। আক্ষরিক অর্থে এ অনুষ্ঠানে সুধী সমাবেশে আমার কাছে তিনি ক্ষমা চেয়েছেন। তিনি আজ আমাদের মাঝে নেই। কিন্তু তাঁর এই অনুশোচনামূলক বক্তব্য বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের ভিডিওতে রেকর্ড হয়ে আছে।
মাননীয়
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্য: আমার জীবনের সেরাপ্রাপ্তি
সূচনালগ্নে পদ্মা সেতু নির্মাণ-বিষয়ক প্রয়োজনীয় সকল প্রস্তুতিমূলক কার্যক্রমে আমি সততার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছি। কোনো অনিয়ম বা দুর্নীতিকে বিন্দুবৎ প্রশ্রয় দেইনি। এমনটি আমার বোধেও কখনো আসেনি। পদ্মা সেতু সম্পন্ন করতে পারলে আমার যে সম্মান হবে, পদ্মা সেতুর মতো কলজয়ী স্থাপনার সঙ্গে সম্পৃক্ত থেকে সুচারুভাবে তা সম্পাদন করা সম্ভব হলে যে ইতিহাস সৃজন হবে তা পৃথিবীর সমগ্র ঐশ^র্যের চেয়েও আমার কাছে বেশি মূল্যবান ছিল। সেখানে আমি কয়েক লাখ ডলারের দুর্নীতি করব-এমন বোধ- বিশ্বাস অপবাদকারী কিংবা দেশীয় অপপ্রচারকারী বা বিশ্বাসকারীদের কীভাবে হলো তা ভাবলে আমার হাসি পায়।
২০১৩ খ্রিষ্টাব্দের ডিসেম্বরের মধ্যে পদ্মা সেতুর কাজ সমাপ্ত করার উদ্দেশ্যকে মনেপ্রাণে ধারণ করে দুই বছরের মধ্যে যাবতীয় প্রস্তুতিকাজ শেষ পর্যায়ে নিয়ে এসেছিলাম। কিন্তু বিশ্বব্যাংকের পরিকল্পিত ও অসত্য অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে দেশের স্বার্থে, পদ্মা সেতুর স্বার্থে এবং বিশ্বব্যাংকের অর্থপ্রাপ্তির প্রত্যাশায় মন্ত্রিসভা থেকে ২০১২ খ্রিষ্টাব্দের ২৩শে জুলাই পদত্যাগ করি। এরপরও বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতুর অর্থায়নে ফিরে আসেনি। পূর্বেই বলেছি, পুরো পৃথিবীর সমস্ত সম্পদ দিয়েও পদ্মা সেতু বিষয়ে আমাকে আমার সততা থেকে একবিন্দু নড়াতে পারত না। এটি কেউ বিশ্বাস করুক বা না করুক, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বিশ্বাস করেছিলেন। তাই এসময় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী লন্ডনে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে বলেছিলেন, “সৈয়দ আবুল হোসেন প্রকৃত দেশপ্রেমিক। তিনি দেশের স্বার্থেই মন্ত্রীত্ব ছেড়ে দিয়েছেন। বিশ্বব্যাংক ঋণ দিক আর না দিক- সরকার পদ্মা সেতু নির্মাণের কাজ পরিকল্পনা অনুযায়ী এগিয়ে নেবে।” আমার প্রতি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর এমন উঁচুমানের ইতিবাচক ধারণার প্রকাশ্য স্বীকৃতি আমার জীবনে পাওয়া সেরা উপহার এবং সেরাপ্রাপ্তি। এজন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর প্রতি আমি চিরঋণী। কথাটি মনে পড়লে আমি তাঁর মহানুভব স্বীকৃতির প্রতি কৃতজ্ঞতা-আপ্লুত অনুভাবনায় মিথ্যা অপবাদের সব কষ্ট ভুলে যাই।
পদ্মা
সেতু: মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সাহসী নেতৃত্বের ফসল
নানা বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করে পদ্মা সেতু এখন দৃশ্যমান বাস্তবতার বিদ্যমান অস্তিত্ব। এ সেতু নির্মাণ প্রক্রিয়ার সূচনায় আমি সম্পৃক্ত থেকে যেভাবে কাজ করেছি সে ধারা অব্যাহত রাখতে পারলে ২০১৩ খ্রিষ্টাব্দের ডিসেম্বরে পদ্মা সেতু দৃশ্যমান হতো। কিন্তু দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রের কারণে তা নয় বছর পিছিয়ে গেল। তবু মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অপরিসীম প্রজ্ঞা, বলিষ্ঠ সিদ্ধান্ত আর দূরদর্শী নেতৃত্বের কারণে পদ্মা সেতু নির্মাণ সম্পন্ন করা সম্ভব হয়েছে। প্রমাণ হয়েছে, বাংলাদেশ নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতুর মতো মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নে সক্ষম। পদ্মা সেতু আমাদের অহংকারের প্রতীক। পদ্মা সেতু আমাদের গৌরবের প্রতীক। পদ্মা সেতু আমাদের সক্ষমতা ও আত্মবিশ্বাসের প্রতীক। প্রকৌশলগত এক বিস্ময়ের প্রতীক। পদ্মা সেতু আমাদের সততার প্রতীক। পদ্মা সেতুর ফলে জাতির বেড়েছে আত্মবিশ্বাস, বিশ্বব্যাপী উদাহরণ হয়ে থাকবে বাংলাদেশ সরকারের এমন অভ‚তপূর্ব সক্ষমতার বিরল ইতিহাস। পদ্মা সেতুর এমন সফল বাস্তবায়ন হচ্ছে, মিথ্যা অজুহাতে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে বিশ্বব্যাংকের সরে যাওয়ার সমুচিত জবাব এবং আমাদের অপমানের প্রতিশোধ। তারা চেয়েছিল পদ্মা সেতু না হোক, কিন্তু হয়েছে। এর চেয়ে বড়ো শাস্তি আর কী হতে পারে বিশ্বব্যাংকের! পদ্মা সেতু মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সততা ও সাহসের সোনালি ইতিহাস। এটি শুধু ইটপাথরের স্থাপনা মাত্র নয়-বাংলাদেশের অপরিসীম আর্থিক-কারিগরি-রাজনীতি ও নেতৃত্বগত সমার্থ্যরে মহিমান্বিত স্মারক এবং আত্মমর্যাদার ইতিহাসে উদ্ভাসিত একটি বিরল সম্মানের প্রতীক। আন্তর্জাতিক ও দেশীয় ষড়যন্ত্র উপেক্ষা করে পদ্মা সেতুর মতো একটি কালজয়ী স্থাপনা আমাদের উপহার দেওয়ায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আমাদের প্রাণপ্রিয় নেত্রী শেখ হাসিনাকে অভিনন্দন জানাই।