
শেখ রাসেল একটি
আবেগের নাম। একটি অতি প্রিয় আদুরে নাম। শেখ রাসেল নামটিও বাংলার ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য
অংশ। শিশুদের বিকাশ ও সম্ভাবনার মাঝে চিরঞ্জীব শেখ রাসেল। বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গমাতার সর্ব
কনিষ্ঠ পুত্র এবং মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সর্ব কনিষ্ঠ স্নেহের ভ্রাতা শেখ
রাসেলকে নিয়ে কিছু লিখতে গেলে বুক ফেটে কান্না আসে। দম বন্ধ হয়ে আসে। সাদা কাগজের উপর
কলম আর সামনের দিকে চলতে চায় না। বাংলা উইকিপিডিয়ায় শেখ রাসেল সম্পর্কে উল্লেখ করা
হয়েছে, “১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট প্রত্যূষে একদল তরুণ সেনা কর্মকর্তা ট্যাঙ্ক দিয়ে
শেখ মুজিবুর রহমানের ধানমন্ডিস্থ ৩২ নম্বর বাসভবন ঘিরে ফেলে শেখ মুজিব, তাঁর পরিবার
এবং তাঁর ব্যক্তিগত কর্মচারীদের সাথে শেখ রাসেলকেও হত্যা করা হয়। শিশু রাসেল কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেছিলেন, ‘আমি মায়ের কাছে যাব’ পরবর্তীতে মায়ের লাশ দেখার পর অশ্রুসিক্ত কণ্ঠে মিনতি করেছিলেন, ‘আমাকে হাসু আপার (শেখ হাসিনা) কাছে
পাঠিয়ে দাও।’ ব্যক্তিগত কর্মচারী এএফএম মহিতুল ইসলামের ভাষ্যমতে, রাসেল দৌঁড়ে এসে
আমাকে জাপটে ধরে। আমাকে বললো, ভাইয়া আমাকে মারবে না তো? ওর সে কন্ঠ শুনে আমার চোখ ফেটে পানি এসেছিল। এক
ঘাতক এসে আমাকে রাইফেলের বাট দিয়ে ভীষণ মারলো। আমাকে মারতে দেখে রাসেল আমাকে ছেড়ে দিল। শেখ রাসেল কান্নাকাটি করছিল যে, ‘আমি মায়ের কাছে যাব, আমি মায়ের
কাছে যাব।’ এক ঘাতক এসে ওকে বললো, চল তোর মায়ের কাছে দিয়ে আসি। বিশ্বাস করতে পারিনি
যে, ঘাতকরা এতো নির্মমভাবে ছোট্ট সে শিশুটাকেও হত্যা করবে। রাসেলকে ভিতরে নিয়ে গেল
এবং তারপর ব্রাশ ফায়ার।” শেখ রাসেলের গৃহ শিক্ষক এবং ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরী স্কুলের শিক্ষক
গিতালি দাস গুপ্তা শেখ রাসেল সম্পর্কে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেছেন, “অতীতের সুখস্মৃতি আজ দুঃখের আঁধারের
অবগুন্ঠনে ঢাকা। সে স্মৃতি আজ, আমার ভারী বোঝা। চিৎকার করে যাচ্ছি, এ বোঝা আমার নামাও
বন্ধু নামও কিন্তু কারোই যে এ বোঝা নামাবার ক্ষমতা নেই, তা আমি জানি। যতদিন বেঁচে আছি,
রক্তে সিক্ত এ বেদনার বোঝা আমার সঙ্গী হয়েই আমাকে জড়িয়ে থাকবে। বুকের গভীরে যে দগদগে
ঘায়ের সৃষ্টি হয়েছে, তা আমৃত্যু আমায় পুড়িয়ে খাবে। লিখতে যে বেশ কষ্ট হচ্ছে! আমি এগুবো
কী করে? অতীত যে বর্তমান হয়ে সামনে দাঁড়িয়ে আছে, সেই অতীতকে পাশ কাটিয়ে চালে যাওয়া
যাচ্ছে না তো! ছোট্ট একটি হাসিমাখা মুখ আমার সামনে দাঁড়িয়ে, অথচ সেই মিষ্টি মুখখানা
ছুঁতে পারছি না, পারছি না আগের মতো করে আদর করতে! খুনসুটির খেলাটাও তো বন্ধ! দম আটকে
আসছে, চোখ বুজে অনুভব করছি, আমার সামনেই অতীত বর্তমান রূপে জাগরূক! এ যন্ত্রণা বোঝাই
কী করে? কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ বলেছেন-‘অলৌকিক আনন্দের ভার বিধাতা যাহারে দেন/ তার বক্ষে বেদনা অপার’।” শেখ রাসেল সম্পর্কে বিশিষ্ট লেখক,
সাংবাদিক ও রাজনীতিবিদ বেবী মওদুদ লিখেছেন, “১৫ আগস্ট ১৯৭৫। ১০ বছরের রাসেল ঢাকা ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরি হাইস্কুলের
চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্র ছিল। চঞ্চল প্রকৃতির হলেও কখনো কখনো হঠাৎ সে শান্ত হয়ে নির্জনে
প্রিয়সঙ্গী সাইকেল নিয়ে খেলা করতে পছন্দ করত। তার আরো প্রিয় সঙ্গী ছিল ভাগ্নে জয়। তার
সঙ্গে খুনসটিও করত, আবার জয় না হলে তার চকোলেট খাওয়া হত না, খেলা করা হত না। আনন্দকে
ভাগ করে নেয়ার উদারতায় রাসেল তার ক্লাসের বন্ধুদের খুব প্রিয় ছিল। সেই রাসেলের ঘুম
ভেঙ্গে যায় সেদিন গুলির শব্দে, হইচইতে মা তাকে পেছনের দরজা দিয়ে কাজের লোকজনের হাতে
নিচে পাঠিয়ে দেন। ১০ বছরের রাসেল হঠাৎ ঘুমভাঙ্গা চোখ নিয়ে সব দেখেছে, আর আতঙ্কভরা মন
নিয়ে সবকটা গুলির শব্দ শুনেছে। তারপর ঘাতকরা তার হাত ধরে, অস্ত্র তাক করে। রাসেল কাঁদতে
কাঁদতে বলেছে, আমি মায়ের কাছে যাব। আমি মায়ের কাছে যাব। ঘাতক ওয়ারলেসে অনুমতি নিয়েছে
তাকে হত্যা করার। শেখ রাসেল বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কনিষ্ঠ
পুত্র এই ছিল তার অপরাধ। ঘাতকরা তার হাত ধরে বড়ভাই শেখ কামাল, চাচা শেখ আবু নাসের,
স্নেহময় পিতা শেখ মুজিব, মমতাময়ী মা, ভাই শেখ জামাল, সদ্যপরিণীতা ভাবী সুলতানা ও রোজী-সবার
রক্তাক্ত দেহ দেখাল। রাসেল কেমন করে দেখেছিল সেই প্রাণহীন প্রিয়জনদের? সেই রক্তভেজা
মেঝেতে হাঁটতে তার বুক ফেটে যাচ্ছিল কি হাহাকারে? রাসেলকে ঘাতকরা কেন এই রক্তাক্ত দেহগুলো
দেখিয়েছিল? তার শুদ্ধতম ছোট্ট হৃদয়কে তারা কেন কষ্ট দিয়েছিল? কেন যন্ত্রণায় ক্ষতবিক্ষত
করেছিল? ছোট্ট রাসেল ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাদঁতে কাদঁতে শেষবার উচ্চারণ করেছিল, ‘আমাকে আমার হাসু আপার কাছে পাঠিয়ে
দিন’। ঘাতক-নরপিশাচ
ঘাতকরা ছোট্ট রাসেলের সে কান্নাভেজা কথা শোনেনি, হৃদয়ের আকুতি শোনেনি। তারা বুলেটে
বুলেটে শিশু রাসেলকে হত্যা করেছে। ছোট্ট রাসেল কাঁদতে কাঁদতে চিরদিনের জন্য ঘুমিয়ে
গেছে। উপরের বর্ণনায় এটা স্পষ্ট যে, শেখ রাসেলকে নিয়ে কিছু লিখতে গেলে কেন আমাদের বুক
ফেটে কান্না আসে। ঘাতকরা যে কত বড় নিষ্ঠুর ছিল তা সহজেয় বোঝা যায়।
জাতির পিতা
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কনিষ্ঠ পুত্র শেখ রাসেল ১৯৬৪ সালের ১৮ অক্টোবর ঢাকায়
ঐতিহাসিক বঙ্গবন্ধু ভবনে জন্মগ্রহণ করেন। বঙ্গবন্ধু তাঁর প্রিয় লেখক খ্যাতিমান দার্শনিক
ও নোবেল বিজয়ী ব্যক্তিত্ব বার্ট্রান্ড রাসেলের নামানুসারের পরিবারের এই নতুন সদস্যের
নাম রাখেন রাসেল। শেখ রাসেলের জন্মের আগমূহুর্ত এবং জন্মের সময় সম্পর্কে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী
শেখ হাসিনা লিখেছেন, “রাসেলের জন্মের আগের মুহূর্তগুলো ছিল ভীষণ উৎকন্ঠার। আমি, কামাল, জামাল,
রেহানা ও খোকা চাচা বাসায়। বড় ফুফু ও মেজো ফুফু মার সাথে। একজন ডাক্তার ও নার্সও এসেছেন।
সময় যেন আর কাটে না। জামাল আর রেহানা কিছুক্ষণ ঘুমায় আবার জেগে ওঠে। আমরা ঘুমে ঢুলুঢুলু
চোখে জেগে আছি নতুন অতিথির আগমন বার্তা শোনার অপেক্ষায়। মেজো ফুফু ঘর থেকে বের হয়ে
এসে খবর দিলেন আমাদের ভাই হয়েছে। খুশিতে আমরা আত্মহারা। কতক্ষণে দেখব। ফুফু বললেন,
তিনি ডাকবেন। কিছুক্ষণ পর ডাক এলো। বড় ফুফু আমার কোলে তুলে দিলেন রাসেলকে। মাথাভরা
ঘন কালো চুল। তুলতুলে নরম গাল। বেশ বড় সড় হয়েছিল রাসেল।”
শেখ রাসেলের
বেড়ে ওঠা সহজ ছিল না। তার জন্মের দিন পিতা (বঙ্গবন্ধু) চট্টগ্রামের এক জনসভায় ছিলেন।
পরবর্তীতে মাঝে মাঝে বঙ্গবন্ধুকে জেলেও যেতে হয়েছে। পরিবারের সদস্যদের অতি আদরের শেখ
রাসেলের মাত্র দেড় বছর বয়সেই প্রিয় পিতার সঙ্গে তার সাক্ষাতের একমাত্র স্থান হয়ে উঠে
কেন্দ্রীয় কারাগার ও ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট। কারাগারের রোজনামচায় ১৯৬৬ সালের ১৫ই জুনের
দিনলিপিতে রাসেলকে নিয়ে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, “১৮ মাসের রাসেল জেল অফিসে এসে একটুও হাসে না- যে পর্যন্ত আমাকে না দেখে।
দেখলাম দূর থেকে পূর্বের মতোই ‘আব্বা আব্বা’ বলে চিৎকার করছে। জেল গেট দিয়ে একটা মাল বোঝাই ট্রাক ঢুকেছিল। আমি তাই
জানালায় দাঁড়াইয়া ওকে আদর করলাম। একটু পরেই ভিতরে যেতেই রাসেল আমার গলা ধরে হেসে দিল।
ওরা বলল আমি না আসা পর্যন্ত শুধু জানালার দিকে চেয়ে থাকে, বলে ‘আব্বার বাড়ি’। এখন ধারণা হয়েছে এটা ওর আব্বার
বাড়ি। যাবার সময় হলে ওকে ফাঁকি দিতে হয়।” মাত্র সাত বছর বয়সে ১৯৭১ সালে শেখ রাসেল নিজেই বন্দী হয়ে যান। ধানমন্ডি
২৮ নম্বর সড়কে পরিবারের সদস্যদের সাথে তিনিও বন্দী জীবন কাটিয়েছেন। সে সময় বঙ্গবন্ধু
পাকিস্তানের কারাগারে বন্দী ছিলেন। দেশ স্বাধীনের পর, ১৯৭১ সালের ১৭ই ডিসেম্বর বঙ্গমাতা ও পরিবারের অন্য সদস্যদের সাথে শেখ রাসেলও
মুক্ত হন। সেদিন শেখ রাসেল ‘জয় বাংলা’ বলে ঘর থেকে বেরিয়ে আসেন। বাইরে তখন বিজয়ের উৎসব চলছে। বঙ্গবন্ধু ১০
জানুয়ারি পাকিস্তানের কারাগার থেকে ফিরে এলে সেদিন রাসেল পিতাকে বিস্ময়ভরা তৃপ্তির
দু’ চোখে
দেখেছে, তাঁর স্নেহচুম্বনে সিক্ত হয়েছেন। এরপর থেকে সে খুব একটা পিতার সান্নিধ্য ছাড়া
থাকতে চাইতেন না। যথক্ষণ পিতা কাছে থাকতেন, ততক্ষণ রাসেল তাঁর কাছাকাছি থাকতে চাইতেন।
শেখ রাসেল চিরঞ্জীব। কারণ শহীদের মৃত্যু নাই। বঙ্গবন্ধুর সন্তান হওয়ার কারণে তাকে নরপিশাচ ঘাতকদের হতে নির্মমভাবে জীবন দিতে হয়েছে। বঙ্গবন্ধুকে তাঁর দর্শন চিন্তার কারণেই তাঁকে পরিবারের সদস্যসহ নিজের জীবন দিতে হয়েছে। বঙ্গবন্ধু দেশ ও বিশ্বের মানুষকে ভীষণ ভালোবাসতেন। ছিলেন বিশ্বের শোষিত মানুষের এক মহান নেতা। অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে ধারণ করতেন। যে কারণেই বঙ্গবন্ধুর পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের সাথে সাথে শেখ রাসেলকেও জীবন দিতে হয়েছে। কিন্তু ঘাতকরা জানত না যে, মানুষকে হত্যা করা গেলেও তার আদর্শকে হত্যা করা যায় না। মানুষের আদর্শের মৃত্যু নাই। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যু নাই, শেখ রাসেলেরও মৃত্যু নাই। শেখ রাসেল আমাদের কাছে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন চিরকাল। বিশ্বের সকল শিশুর মাঝে শেখ রাসেল অমর হয়ে থাকবেন। ১৮ই অক্টোবর ২০২২ খ্রিস্টাব্দ শেখ রাসেলের ৫৯তম জন্মদিন ও ৫৮তম জন্মবার্ষিকী। তাঁর জন্মদিনে আমাদের প্রতিজ্ঞা বিশ্বের সকল শিশুর বিকাশ, সকল শিশুর সুন্দর ভবিষ্যৎ গড়াসহ শিশুদের নিয়ে সকল সম্ভবনাকে বাস্তবে রূপদানের লক্ষ্যে আমরা ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করব। আর সেটাই হবে শেখ রাসেলের প্রতি যথার্থ শ্রদ্ধা নিবেদন ও তাকে সঠিকভাবে স্মরণ করা। সাথে সাথে আজকের আমাদের দাবি, শেখ রাসেলের সকল খুনিদের অবশ্যই বিচার কার্যকর হতে হবে। আমাদের স্মরণে রাখতে হবে, যে নিষ্ঠুর ঘাতক খুনিচক্র ষড়যন্ত্রকারীরা বর্তমানেও বাংলাদেশ ও বঙ্গবন্ধুর পরিবারের বেঁচে থাকা সদস্য বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পরিবার ও কনিষ্ট কন্যা শেখ রেহানার পরিবারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে চলছে তাদেরকে ঘৃণা ভরে প্রত্যাখানসহ রুখে দাঁড়াতে হবে। পরিশেষে বলব, বিশ্বের সকল শিশুর অধিকার নিশ্চিত হোক, সকল শিশুর বেড়ে উঠার জন্য নিরাপদ দেশ ও একটি নিরাপদ পৃথিবী গড়ে উঠুক- এই হোক আমাদের আজকের অঙ্গীকার। শেখ রাসেলের স্মৃতি হোক চির অম্লান। বঙ্গবন্ধুর আদর্শে এগিয়ে যাক বাংলাদেশ।
লেখক: অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ আতিকুর রহমান