ইউক্রেনে ২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি শুরু হয় রাশিয়ার আগ্রাসন। এরপর থেকেই সামরিক সহায়তা হিসেবে দেশটিতে শত শত কোটি ডলারের অস্ত্র, গোলাবারুদ পাঠিয়েছে পশ্চিমা দেশগুলো। মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএন এখন বলছে, এক বছরে ইউক্রেনের যুদ্ধের ময়দান পরিণত হয়েছে অস্ত্রের গবেষণাগারে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে মার্কিন সমরাস্ত্রের সঙ্গে নিজস্ব উদ্ভাবনী কৌশলও প্রয়োগ করছে ইউক্রেনের বাহিনী। সেগুলো মুগ্ধ করছে পশ্চিমা কর্তাব্যক্তিদের।
যেমন- অভিনব এক সফটওয়্যার তৈরি করেছে ইউক্রেন। সে সফটওয়্যারটি আশপাশে বিদ্যমান কম্পিউটার, ট্যাবলেট এবং স্মার্টফোনকে লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করে। রিয়েলটাইমে খুঁজে দেয় শত্রুপক্ষকে। এখন গোটা ইউক্রেনের সামরিক বাহিনী এর সুফল ভোগ করছে। মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে তারা খুঁজে বের করছে শত্রুদের। মার্কিন কর্মকর্তারাও বলছেন, সফটওয়্যারটিকে কাজে লাগিয়ে রুশ লক্ষ্যে সুনিপুণভাবে আঘাত হানতে পারছে ইউক্রেনের সেনারা। শুধু এই সফটওয়্যার নয়। আরও অনেক কিছু নিজেদের প্রয়োজন মাফিক তৈরি করে নিয়েছে ইউক্রেনের সেনারা। এ রকম সামগ্রীর মধ্যে রয়েছে- ছোট প্লাস্টিক ড্রোন। যা মাথার ওপর শব্দ করে উড়ে বেড়ায় এবং রাশিয়ার ওপর গ্রেনেড ফেলে আসে।
এ ছাড়াও ভারী যন্ত্রাংশ মেরামতে সেনারা যুদ্ধক্ষেত্রে বসেই বাড়তি যন্ত্রাংশ তৈরি করে নিচ্ছে থ্রিডি প্রিন্টারের সহায়তায়। তারা সাধারণ পিকআপ ট্রাককে পরিণত করেছে ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণ বাহনে। এমনকি মার্কিন ক্ষেপণাস্ত্র কীভাবে পুরোনো সোভিয়েত যুদ্ধবিমান মিগ-২৯ এর সঙ্গে জুড়ে নেওয়া যায়, সে উপায়ও বের করেছেন ইউক্রেনীয় প্রকৌশলীরা। এরই বদৌলতে যুদ্ধের ৯ মাস পরেও আকাশে দাপটের সঙ্গে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে ইউক্রেনের বাহিনী। জলেও থেমে নেই ইউক্রেন। সেখানেও নিজস্ব জাহাজ-ধংসকারী অস্ত্র নেপচুন তৈরি করে নিয়েছে দেশটির বাহিনী। এই অস্ত্রগুলো রাশিয়ার রণতরিতে প্রায় দুইশ মাইল দূর থেকে আঘাত হানতে পারে। ইউক্রেনের এই অভিনব প্রচেষ্টা মার্কিন কর্মকর্তাদের আকৃষ্ট করেছে। তারা কিয়েভের এ সক্ষমতাকে দেখছেন যুদ্ধক্ষেত্রের ‘ম্যাকগাইভার সমাধান’ হিসেবে। এগুলো একদিক থেকে ইউক্রেনকে যুদ্ধক্ষেত্রে সহায়তা করছে। আরেক দিক থেকে পশ্চিমা অস্ত্রসম্ভারের যে ফাঁকফোকর আছে, তা ঘুচিয়ে দিচ্ছে।
মার্কিন কর্মকর্তা এবং বিশ্লেষকরা এখন বলছেন, ইউক্রেন যুদ্ধক্ষেত্রের গবেষণাগারে পরিণত হয়েছে। যেখানে সস্তা এবং কার্যকরী সমাধানের নমুনা দেখা যাচ্ছে হরহামেশাই। সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের আন্তর্জাতিক সুরক্ষা কর্মসূচির পরিচালক সেথ জোনস বলছেন, ‘তাদের উদ্ভাবন অবিশ্বাস্যভাবে আকর্ষণীয়।’
আরও একটি দিক থেকে পুরো বিষয়টি মনোযোগ কাড়ছে বিশেষজ্ঞদের। তা হলো- ইউক্রেনের বদৌলতেই প্রথমবারের মতো অনেক অস্ত্র হাতেনাতে ব্যবহার হতে দেখা যাচ্ছে। অনেক ত্রুটি-বিচ্যুতিও ধরা পড়ছে। পশ্চিমা গোয়েন্দা বাহিনীর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এক সূত্র এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘এটি বাস্তব বিশ্বের যুদ্ধপরীক্ষা।’ ইউক্রেন যুদ্ধের বরাতে নিজেদের বিভিন্ন অস্ত্র ও ব্যবস্থা সম্পর্কে প্রচুর তথ্য-উপাত্ত পাচ্ছে মার্কিন সামরিক বাহিনী। এসব তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে অনেক কিছুই নতুন আলোতে দেখছে তারা। যেমন- ইউক্রেনকে সুইচব্লেড ৩০০ ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র দিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। যার মূল কাজ- শত্রুর রাডার ব্যবস্থায় আঘাত হানা। কিন্তু পরে দেখা গেল, যতটা ভাবা হয়েছিল, ততটা কার্যকরী নয় এটি।
অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি এম১৪২ রকেট লঞ্চার বা হিমারস ইউক্রেনের সফলতায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। এসব অস্ত্র ব্যাপকভাবে ব্যবহারে কী পরিমাণ সারাইয়ের প্রয়োজন পড়ে, সে সম্পর্কে পোক্ত একটি ধারণা পেয়েছেন মার্কিন কর্তাব্যক্তিরা। যুক্তরাষ্ট্রের এক প্রতিরক্ষা কর্মকর্তা বলছেন, ইউক্রেন নিজেদের স্বল্পসংখ্যক হিমারস ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করে যেভাবে রুশ সেনাদের ওপর ধ্বংসলীলা চালিয়েছে, তা নিয়ে সামরিক নেতারা বছরের পর বছর গবেষণা করবেন।
ঠিক একইভাবে এম৭৭৭ হাওয়িটজারের কার্যকারিতা সম্পর্কেও ভালো ধারণা পেয়েছেন প্রতিরক্ষা কর্মকর্তারা। স্বল্প সময়ের মধ্যে বেশি গোলা ছুড়ে ফেললে নিজের রাইফেলিং ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে অস্ত্রটি। ইউক্রেন যুদ্ধকে কাজে লাগিয়েছেন মার্কিন প্রতিরক্ষা ঠিকাদাররাও। তারা এ সুযোগে নিজেদের অস্ত্র নিয়ে গবেষণা করছেন। পাশাপাশি চলছে সেগুলোর প্রচারণাও। অস্ত্র নির্মাতা প্রতিষ্ঠান বিএই সিস্টেমস বলছে, রাশিয়ার সেনাদের সফলভাবে কামিকাজে ড্রোনের ব্যবহার তাদেরকে নতুন ঘরানার সাজোয়াঁ যান তৈরির ব্যাপারে উদ্বুদ্ধ করেছে। যা সেনাদেরকে মাথার ওপরের এ ধরনের আক্রমণ থেকে বাঁচাতে পারবে।