দিলীপ কুমার দেব, সাতক্ষীরা থেকে:
মাছে ভাতে বাঙালী। বাঙালীর প্রধানতম খাদ্য মাছ ভাত। নদী মাতৃক বাংলাদেশের সাগর, নদ-নদী, খাল-বিল-নালা, হাওড়-বাওড়, ধান ক্ষেত, জলাবদ্ধ বিলগুলো হচ্ছে দেশীয় প্রজাতির মাছের প্রধানতম উৎস। শ্রেণিভাগে বাংলাদেশের মাছকে মূলত দুই ভাগে ভাগ করা হয়, মিষ্টি বা সাদুপানির মাছ ও লবন পানির মাছ। এই সাদুপানির মাছ হচ্ছে মাগুর, শিং, কৈ, টাকী, শৈল, গজাল, পাবদা, টেংরা, পুঁটি, সরপুঁটি, খলিসা, মলা, বাইন, বোয়াল, গলদা চিংড়ি মাছ এবং লবন পানির দেশীয় প্রজাতির মাছের মধ্যে ভেটকি, ভাঙ্গান, পারশে, খোরকুল্যা, খয়রা, টেংরা, তপশ্যি, সেলোট, আমাদী, ঢেলা, বাগদা চিংড়ি, চাকা চিংড়ি, হরিণা চিংড়ি প্রভৃতি। বাংলাদেশের সাগরবেষ্টিত লবনাক্ত উপকুলীয় কয়েকটি জেলা বা অঞ্চল লবন পানির দেশীয় প্রজাতির মাছ এবং এই লবনাক্ত উপকুলীয় অঞ্চল ছাড়া দেশের অধিকাংশ জেলা বা অঞ্চলসমূহে সাদুপানির দেশীয় প্রজাতির মাছের প্রধানতম প্রজনন ক্ষেত্র রয়েছে।
এসব সাদুপানির মাছের সাধারণত: জৈষ্ঠ মাসের মধ্য থেকে শ্রাবণ মাসের মধ্য পর্যন্ত সকল প্রকার দেশীয় প্রজাতির মাছের প্রজনন মৌসুম। জৈষ্ঠ মাসের মধ্যকালে প্রথম বৃষ্টির পর থেকেই এসকল সাদুপানির মাছ ডিম ছাড়া শুরু করে। যা চলে শ্রাবণ মাসের মধ্য পর্যন্ত। বৃষ্টির পরপরই যখন বিভিন্ন জলাশয়গুলো পানিতে ভরে যায়, তখন নদ-নদী, খাল-বিল-নালা, হাওড়-বাওড়, ধান ক্ষেতসহ জলাবদ্ধ বিলগুলো জলাজমির সাথে মিশে যায় এবং তখন মুক্ত জলায়শয়ে থেকে ছড়িয়ে যায় মাগুর, শিং, কৈ, টাকী, শৈল, গজাল, পাবদা, টেংরা, পুঁটি, সরপুঁটি, খলিসা, মলা, বাইন, বোয়াল, গলদা চিংড়ি মাছ। আর তখনই স্থানীয় জনগণ অনুমোদিত ঝাকি জাল, চর পাটা জাল, বেবদি জাল, কারেন্ট জাল, চাইঁ, বরশি, টোটা, কোচ, বর্সাসহ বিভিন্ন রকম হাতে বানানো ফাঁদ পেতে মাগুর, শিং, কৈ, টাকী, শৈল, গজাল, পাবদা, টৈংরা, পুঁটি, সরপুঁটি, খলিসা, মলা, বাইন, বোয়াল, গলদা চিংড়ি এসকল প্রজাতির মাছ নিধন করতে থাকে। যার মধ্যে অধিকাংশ থাকে ডিম ছাড়ার পর্যায়ের ‘মা মাছ’।
বাংলাদেশের দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের জেলা বা অঞ্চলসমূহের মধ্যে বলিশাল, পিরোজপুর, ঝালকাঠী, গোপালগঞ্জ, মাদারীপুর, ফরিদপুর, মাগুরা, রাজবাড়ী, ঝিনাইদহ, কুষ্টিয়া, নড়াইল, মেহেরপুর, খুলনা, বাগেরহাট, যশোর, সাতক্ষীরা প্রভৃতি জেলা বা অঞ্চলসমূহের মিষ্টি পানি বেষ্টিত নদ-নদী, খাল-বিল-নালা, পুকুর-ডোবা, ধান ক্ষেত, জলাবদ্ধ বিলগুলো এই বর্ষা মৌসুমে দেশীয় প্রজাতির মাছের বংশ বিস্তার শুরু হয়। এছাড়া দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের জেলা বা অঞ্চলসমূহের নদ-নদী, হাওড়-বাওড়, খাল-বিল-নালা, ধান ক্ষেত, জলাবদ্ধ বিলগুলো সাদুপানির দেশীয় প্রজাতির মাছের প্রজনন ক্ষেত্র রয়েছে। সেসব অঞ্চলেও এই বর্ষা মৌসুমে ব্যাপকতা ঘটে দেশীয় মাছের বংশ বিস্তার।
অপর দিকে বাংলাদেশের সাতক্ষীরা, বাগরহাট, বরগুনা, বরিশাল, পিরোজপুর, ভোলা, পটুয়াখালী, লক্ষীপুর, নোয়াখালী, চট্রগ্রাম, কক্সবাজার, রাঙ্গামাটি, জেলা বা অঞ্চলসমূহের সাগরবেষ্টিত লবনাক্ত উপকুলীয় কিছু কিছু জেলা ও উপজেলা বা অঞ্চলসমূহ লবন পানির দেশীয় প্রজাতির মাছের প্রজনন ক্ষেত্র রয়েছে। লবন পানির দেশীয় প্রজাতির মাছের মধ্যে ভেটকি, ভাঙ্গান, পারশে, খোরকুল্যা, খয়রা, টেংরা, তপশ্যি, সেলোট, আমাদী, ঢেলা, বাগদা চিংড়ি, চাকা চিংড়ি, হরিণা চিংড়ি প্রভৃতি। লবন পানির দেশীয় প্রজাতির মাছ এসব অঞ্চলের লবন পানি বেষ্টিত নদীতে বংশ বিস্তার লাভ করে। কিন্তু এক শ্রেণির অসাধু জেলেরা নদীতে বেবদি জাল, পাটা জাল, কারেন্ট জাল, বাগদা চিংড়ি রেণু পোনা ধরার টানা জাল, বেড় জালসহ প্রভৃতি জাল দিয়ে ওই সব লবন পানির দেশীয় প্রজাতির মাছের ডিম ও রেণু পোনা ধ্বংস করছে। যার ফলে বংশ বিস্তার লাভ ব্যাহত হচ্ছে। বৃষ্টির মৌসুম শুরুর পর থেকেই স্থানীয় মানুষ কোনো কিছু চিন্তা ভাবনা না করেই নিজের খেয়াল খুশিমত দেশীয় প্রজাতির মাছ নিধনে নেমে পড়েছে।
এই অপরিকল্পিত মৎস্য আহরণের জন্য হুমকির মুখে পড়েছে দেশীয় প্রজাতির মাছের অস্তিত্ব। এই অপরিকল্পিত মৎস্য নিধনের হাত থেকে এলাকার দেশীয় প্রজাতির মাছ রক্ষা এবং তার বংশ বিস্তারের জন্য স্থানীয় সুশীল ও সচেতন সমাজ যথাযথ কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপ কামনা করে।