সংক্রমণের এই ঊর্ধ্বগতি ঠেকানো না গেলে জুনের প্রথম সপ্তাহ নাগাদ ভারতে করোনা আক্রান্ত হয়ে দৈনিক মৃত্যু দুই হাজার ৩০০ ছাড়াবে। ভারতে করোনার সুবিশাল টিকা কর্মসূচিও এখন বেশ কসরত করে এগোচ্ছে
প্রাণঘাতী করোনার বিরুদ্ধে 'বিজয় উল্লাস' প্রকাশের দুই মাস যেতে না যেতেই মহামারির দ্বিতীয় ঢেউয়ে নাজুক হয়ে পড়েছে ভারত। ক্রম ঊর্ধ্বমুখী সংক্রমণের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে মৃত্যু। কিন্তু কেন? গতকাল সোমবার প্রকাশিত বিবিসির এক বিশ্নেষণে বলা হয়েছে, করোনা নিয়ন্ত্রণে 'দম্ভ' প্রকাশ করে ভারতের নীতিনির্ধারকদের নানা 'অবাস্তব' সিদ্ধান্তই এমন পরিণতি এনেছে।
ভারতে ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি থেকে দৈনিক আক্রান্তের গড় ১০ হাজার ছাড়িয়ে এপ্রিলে এসে লাফিয়ে পার হয়ে যায় দুই লাখের ঘর। গতকাল যা ছিল পৌনে তিন লাখ। স্বজনদের স্তব্ধ করে দিয়ে দৈনিক মৃত্যুর সংখ্যা ছাড়িয়ে গেছে দেড় হাজার। পরিসংখ্যান আর ঘটনাপ্রবাহের তুলনা করে ভারতে করোনাভাইরাস সংক্রমণের এমন উল্লম্ম্ফনের পেছনের কারণগুলো অনুসন্ধান করেছে বিবিসি।
মার্চের শুরুতেই ভারতের স্বাস্থ্যমন্ত্রী হর্ষবর্ধন করোনা মহামারির বিরুদ্ধে 'শেষ খেলা' চলছে বলে ঘোষণা করেন। শুধু তাই নয়, গত বছরের শেষ দিকে দেশটির রাজনৈতিক নেতা, নীতিনির্ধারক ও গণমাধ্যমের একটা অংশ ধরেই নিয়েছিল করোনাভাইরাস মহামারি থেকে বেরিয়ে এসেছে ভারত। ডিসেম্বরে ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংক কর্মকর্তারা ঘোষণা দিয়েছিলেন, 'করোনা সংক্রমণের ঢেউকে অবনমিত করছে ভারত।' এরপর ফেব্রুয়ারির শেষে ভারতের নির্বাচন কমিশন পাঁচটি রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন ঘোষণা করে। এই নির্বাচনে ৮২৪টি আসনে ভোটার সংখ্যা ১৮ কোটি ৬০ লাখ। ২৭ মার্চ শুরু হয়ে এক মাসের এই নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গে ভোট নেওয়া হচ্ছে আট ধাপে। কোনো ধরনের সতর্কতা ও সামাজিক দূরত্ব না মেনে এ সময় পূর্ণ মাত্রায় নির্বাচনী প্রচার শুরু হয়।
গুজরাটে নরেন্দ্র মোদি স্টেডিয়ামে ভারত-ইংল্যান্ড ক্রিকেট খেলা দেখতে এক লাখ ৭০ হাজার মানুষকে অনুমোদন দেওয়া হয়। কুম্ভ মেলায় অংশ নিয়েছে প্রায় অর্ধকোটি মানুষ। মাস্কহীন ও সামাজিক দূরত্ব না মেনে উল্লাসের এ চিত্র এক মাসেরও কম সময়ের মধ্যে পাল্টে যায়। এপ্রিলের মাঝামাঝি থেকে করোনার দৈনিক আক্রান্তের গড় সংখ্যা দাঁড়ায় এক লাখ ও মৃত্যু ছাড়া দেড় হাজার। এসব নিয়ে দেশটির সমাজতত্ত্বের অধ্যাপক শিব বিশ্বনাথন বলেন, 'যা ঘটছে তা যেন পরাবাস্তব।'
ল্যানসেট কভিড-১৯ কমিশনের প্রতিবেদন বলছে, সংক্রমণের এই ঊর্ধ্বগতি ঠেকানো না গেলে জুনের প্রথম সপ্তাহ নাগাদ ভারতে করোনা আক্রান্ত হয়ে দৈনিক মৃত্যু দুই হাজার ৩০০ ছাড়াবে। ভারতে করোনার সুবিশাল টিকা কর্মসূচিও এখন বেশ কসরত করে এগোচ্ছে। গত সপ্তাহের মধ্যে এক কোটি টিকা দেওয়া সম্পন্ন হলেও এরই মধ্যে টিকার ঘাটতির খবর পাওয়া গেছে। টিকা উৎপাদন সক্ষমতা বাড়াতে বাড়তি অর্থ চেয়েছে সেরাম ইনস্টিটিউট। যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ের জীব পরিসংখ্যানবিদ ভ্রমর মুখোপাধ্যায় টুইটারে বলেন, 'যখন সংক্রমণের মাত্রা কম ছিল তখনই টিকা কর্মসূচি বাড়ানো দরকার ছিল।' কিন্তু যথাসময়ে এসব পরামর্শ আমলে নেওয়া হয়নি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তরুণ জনসংখ্যা, স্থানীয় রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা, বড় গ্রামীণ জনগোষ্ঠী এই ধারণাগুলোর ওপর ভিত্তি করে করোনার বিরুদ্ধে বিজয় ঘোষণা ছিল নির্মমভাবে একটি অপরিপকস্ফ সিদ্ধান্ত।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গণমাধ্যম ব্লুমবার্গের কলামিস্ট মিহির শর্মা বলেন, 'ভারতে যে বিষয়গুলো সচরাচর দেখা যায়, কর্মকর্তাদের ঔদ্ধত্য, উগ্র জাতীয়তাবাদ, জনপ্রিয়তার জন্য মুখিয়ে থাকা এবং অনেক বেশি আমলাতান্ত্রিক অযোগ্যতা- এসব মিলেই এই সংকট তৈরি করেছে।'