আজ সোমবার রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে অমর একুশে ফেব্রুয়ারি ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস যথাযোগ্য মর্যাদায় পালিত হয়েছে। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা নিবেদন করতে আসা মানুষ বাংলাকে জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষার মর্যাদা দেয়ার পাশাপাশি সর্বস্তরে বাংলা ভাষা প্রচলনের দাবী জানায়।
রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে পাকিস্তানি শাসকের বুলেটের সামনে দাঁড়িয়ে যারা জীবন উৎসর্গ করেছিল, যাদের আত্মত্যাগে বাঙালি পেয়েছিল ভাষার অধিকার। ফুল আর শ্রদ্ধায় তাদের স্মরণ করছে জাতি।
মহান একুশে
ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন উপলক্ষে ভাষা শহীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে
একুশের প্রথম প্রহরেই হাজার হাজার মানুষ কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে আসেন। ফুলে ফুলে ভরে
উঠে বাঙালির শোক আর অহংকারের এই মিনার। তবে করোনা ভাইরাসের কারণে এই বছর আইন শৃঙ্খলা
বাহিনীর কিছু বিধি নিষেধ থাকায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে মানুষের উপস্থিত কিছুটা কম ছিল।
মহামারীর বাস্তবতায়
গত বছরের মতো এবারও শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদনের পর্বটি হয়েছে সীমিত পরিসরে। প্রতি বছর একুশের
প্রথম প্রহর রাত ১২ টা ১ মিনিটে রাষ্ট্রপ্রধান ও সরকার প্রধানের তরফ থেকে শ্রদ্ধা নিবেদনের
মধ্য দিয়েই শুরু হয় শ্রদ্ধা জানানোর পর্ব। মহামারীর মধ্যে গতবছরের মত এবারও তাদের পক্ষে
পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন তাদের সামরিক সচিবরা।
রাষ্ট্রপতির
পক্ষে ফুল দেন তার সামরিক সচিব মেজর জেনারেল এস এম সালাহউদ্দিন ইসলাম। আর প্রধানমন্ত্রীর
পক্ষে তার সামরিক সচিব মেজর জেনারেল নকিব আহমদ চৌধুরী শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।
জাতীয় সংসদের
স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীর পক্ষে শ্রদ্ধা জানান সংসদ সচিবালয়ের সার্জেন্ট আ্যট আর্মস।
ডেপুটি স্পিকার ফজলে রাব্বি মিয়ার পক্ষে সহকারী সার্জেন্ট অ্যাট আর্মস গোলাম শাহরিয়ার
তালুকদার পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করেন।
এরপর তিন বাহিনীর
প্রধানদের মধ্যে সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল এস এম শফিউদ্দিন আহমেদের পক্ষে সেনাবাহিনীর
ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। নৌবাহিনী প্রধান অ্যাডমিরাল মোহাম্মদ শাহীন
ইকবাল এবং বিমান বাহিনী প্রধান এয়ার চিফ মার্শাল শেখ আব্দুল হান্নান এরপর শ্রদ্ধা নিবেদন
করেন।
এ সময় অমর একুশের
কালজয়ী গান ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ বাজানো হয়। তারা কিছুক্ষণ নিরবে
দাঁড়িয়ে থেকে ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।
আওয়ামী লীগ
সভাপতির পক্ষে দলের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য বেগম মতিয়া চৌধুরীর নেতৃত্বে শহীদ মিনারের
বেদীতে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে ভাষা শহীদদের শ্রতি শ্রদ্ধা জানান হয়। আওয়ামী লীগের প্রতিনিধি
দলে সভাপতিমন্ডলীর নুরুল ইসলাম নাহিদ, শাহজাহান খান ও মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া,
যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এবং তথ্য
ও সম্প্রচার মন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ, দফতর সম্পাদক বিপ্লব বড়ুয়া, বন ও পরিবেশ বিষয়ক
সম্পাদক দেলোয়ার হোসেন, উপ-দপ্তর সম্পাদক সায়েম খান প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
জাতীয় সংসদের
বিরোধী দল জাতীয় পার্টির পক্ষে দলের মহাসচিব মজিবুল হক চুন্নু ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান।
১৪ দলের পক্ষে ডা. দীপু মনি ও হাসানুল হক ইনু ফুল দেন শহীদ বেদীতে।
বাংলাদেশ পুলিশের
পক্ষে আইজিপি বেনজীর আহমেদ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে উপাচার্য ড. মো. আখতারুজ্জামান
শ্রদ্ধা জানান ভাষা শহীদদের স্মৃতির প্রতি। বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূতরা শ্রদ্ধা জানান।
যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা,
সেক্টর কমান্ডার্স ফোরাম, অ্যাটর্নি জেনারেল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি, স্বরাষ্ট্র
মন্ত্রণালয়, র্যাবের মহাপরিচালক চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন, ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক
ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সাজ্জাদ হোসেন শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন প্রথম প্রহরে।
বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দও একুশের প্রথম প্রহরে শহীদ বেদীতে পুষ্পস্তবক অর্পণ
করে ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।
এর আগে মধ্য
রাতে ঘড়ির কাঁটা ১২টা ছোঁয়ার আগেই বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক সংগঠনের
নেতাকর্মীসহ সর্বস্তরের মানুষ স্বাস্থ্যবিধি মেনে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার এলাকায় উপস্থিত
হন।
এসময় হাজার
হাজার মানুষ খালি পায়ে বুকে শোকের প্রতীক কালো ব্যাজ ধারণ করে হাতে ফুলের তোড়া নিয়ে
‘আমার
ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি আমি কি ভুলিতে পারি’- গানে কণ্ঠ মিলিয়ে কেন্দ্রীয় শহীদ
মিনারের দিকে এগিয়ে যান। একই সাথে তারা সর্বস্তরে বাংলা প্রচলনের এবং অন্যান্য জাতিসত্তার
ভাষা ও বর্ণমালা সংরক্ষণের দাবি জানান।
রাজনৈতিক দলগুলোর
মধ্য ওয়ার্কার্স পার্টি, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি, বাসদ,
সাম্যবাদী দল, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় প্রথম প্রহরে শহীদ মিনারে
পুষ্পস্তবক অর্পণ করে শ্রদ্ধা জানায়।
এছাড়াও বিএনপি,
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ও সিনেট সদস্যবৃন্দ, সেক্টরস কমান্ডার্স ফোরাম, গণফোরাম,
ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগ উত্তর ও দক্ষিণ, ছাত্রলীগ, আওয়ামী যুব লীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ,
মহিলা আওয়ামী লীগ, যুব মহিলা লীগ, বাংলা একাডেমি, ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি, শিল্পকলা
একাডেমী, উদীচী শিল্পী গোষ্ঠী, কেন্দ্রীয় খেলাঘর আসর, ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্র ফ্রন্ট,
ছাত্র ফেডারেশন, বঙ্গবন্ধু পরিষদ, বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোট, বঙ্গবন্ধু গবেষণা পরিষদ,
গণতন্ত্রী পার্টি, আমরা মুক্তিযোদ্ধার সন্তান ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতিসহ
বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠন ভাষা শহীদদের ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানায়।
এদিকে সকালে
আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে প্রভাতফেরী সহকারে আজিমপুর কবরস্থানে শহীদদের কবরে ও কেন্দ্রীয়
শহীদ মিনারে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করা হয়।
এ সময়ে আওয়ামী
লীগের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য শাজাহান খান ও আবদুর রহমান, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এবং তথ্য
ও সম্প্রচার মন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহা উদ্দিন নাছিম,
সাংগঠনিক সম্পাদক আহমদ হোসেন ও আফজাল হোসেন, নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী,
প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক ড. আবদুস সোবহান গোলাপ, ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক সুজিত
রায় নন্দী, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক সম্পাদক আবদুস সবুর, সংস্কৃতি সম্পাদক অসীম কুমার
উকিল, দপ্তর সম্পাদক ও প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী ব্যারিস্টার বিপ্লব বড়ুয়া, উপপ্রচার
সম্পাদক আমিনুল ইসলাম আমিন, উপদপ্তর সম্পাদক সায়েম খান প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
দিবসটি উপলক্ষে
রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পৃথক বাণী দিয়েছেন। সোমবার
ছিল সরকারী ছুটির দিন।
১৯৫২ সালের
একুশে ফেব্রুয়ারিতে বাংলা ভাষার দাবীতে রাস্তায় নেমে আসে মানুষ। জারি করা হয় ১৪৪ ধারা,
ভেঙে ফেলা হয় শোষকের শৃঙ্খল। রক্তে ভেসে যায় রাজপথ। গুলিতে বিদীর্ণ হয় বুক। শহীদ হন
রফিক, শফিক, সালাম, বরকত, জব্বারসহ নাম না জানা আরো অনেকে। ভাষার জন্য প্রাণ দিয়ে ইতিহাস
গড়েন তারা। বাংলা পায় রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের
নেতৃত্বে একাত্তরে জন্ম নেয় স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ।
মাতৃভাষার জন্য
প্রাণ উৎসর্গের এই দিনটিকে জাতিসংঘ স্বীকৃতি দেয় ১৯৯৯ সালে। অমর একুশে এখন আন্তর্জাতিক
মাতৃভাষা দিবস। একুশের চেতনার প্রতীক ‘শহীদ মিনার’ এখন এশিয়া, ইউরোপ, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়াসহ সব কটি মহাদেশের বহুভাষিক
চেতনার স্মারক।
এদিকে বেলা
১১ টায় ভাষা শহীদদের রূহের মাগফিরাত এবং দেশের শান্তি, সমৃদ্ধি ও উন্নতি কামনা করে
বায়তুল মুকাররম জাতীয় মসজিদে কুরআনখানি, দোয়া ও মিলাদ মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়।