মানুষকে সৃষ্টির সেরা জীব বা আশরাফুল মাখলুকাত
বলা হয়। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘অবশ্যই আমি সৃষ্টি
করেছি মানুষকে সুন্দরতম অবয়বে।’ (সুরা তিন, আয়াত :৪)।
মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব কিভাবে- এ বিষয়ে
বিখ্যাত সুফী আল্লামা ইবনে আরবি বলেন, আল্লাহ তায়ালার সৃষ্টির মধ্যে মানুষের থেকে সুন্দর
আর কেউ নেই। কারণ, আল্লাহ তায়ালা তাকে জ্ঞান ও শক্তি দিয়েছেন, এবং তাকে কথা বলা, কথা
শোনা, দৃষ্টি শক্তি দিয়েছেন। এবং তাকে কৌশল অবলম্বন ও প্রজ্ঞা দান করেছেন। এগুলো প্রকৃতপক্ষে
আল্লাহ তায়ালার গুণাবলী।
আরও পড়ুন: জুমার নামাজের ইতিহাস ও ফজিলত
বুখারী মুসলিমের এক হাদিসে বর্ণিত হয়েছে,
আল্লাহ তায়ালা আদম আ.-কে নিজের আকারে সৃষ্টি করেছেন। এর অর্থ এটাই হতে পারে যে, আল্লাহ
তায়ালার কিছু গুণ কোনও কোনও পর্যায় তাকেও দেওয়া হয়েছে। তবে আল্লাহ তায়ালার কোনও আকার
নেই। ( কুরতুবী, তাফসিরে মাআরিফুল কোরআন, ৮ম খণ্ড, ৮১৩)
কোরআন সুন্নাহর আলোকে মানুষ ও পশুর মধ্যে
মৌলিক পাঁচটি পার্থক্য রয়েছে। নিম্নে ধারাবাহিকভাবে এর সংক্ষিপ্ত বিবরণ তুলে ধরা হলো।
আল্লাহর কুদরতি হাতে মানুষের সৃষ্টি
যখন ইবলিস শয়তান হজরত আদম (আ.)-কে সিজদা
করতে অস্বীকার করল তখন মহান আল্লাহ বললেন, ‘হে ইবলিস! যাকে
আমার নিজ হাতে সৃষ্টি করেছি তাকে সিজদা করতে তোকে কিসে বাধা দিল?’ (সুরা : সদ,
আয়াত : ৭৫)
এই আয়াত দ্বারা প্রমাণিত হয়, মানুষের সৃষ্টি
মহান আল্লাহর স্বহস্তে সম্পাদিত হয়েছে। নতুবা আল্লাহ তাআলার সাধারণ সৃষ্টির প্রক্রিয়া
হলো, যখন তিনি কোনো কিছু সৃষ্টির ইচ্ছা করেন তখন আদেশ করেন হও। আর অমনি তা হয়ে যায়।
(সুরা : নাহল, আয়াত : ৪০)
সুষ্ঠু বিবেক ও শুদ্ধ জ্ঞান
দুটি পৃথক বিষয় হলেও একটি অপরটির সঙ্গে
অঙ্গাঙ্গিভাবে সম্পর্কিত। কারণ শুদ্ধ জ্ঞান ছাড়া বিবেক সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত হতে পারে
না। যেমন—রোগাগ্রস্ত কাউকে
দেখে বিবেকতাড়িত হয়ে তার জন্য অনেক কিছুই করতে ইচ্ছা হয়। কিন্তু চিকিৎসা জ্ঞান না থাকলে
এই তাড়না নিষ্ফল। অন্যদিকে সুষ্ঠু বিবেক ছাড়া শুধু শুদ্ধ জ্ঞানও ফলদায়ক নয়। যেমন—ধূমপান স্বাস্থ্যের
জন্য ক্ষতিকর জানা সত্ত্বেও সুষ্ঠু বিবেকের অভাবে এ জ্ঞানের কোনো মূল্যায়ন হয় না। সুতরাং
একটি অপরটির সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত।
বিবেক হলো তাই, যা মানুষকে স্বীয় জ্ঞানের
আলোকে তার জন্য সবচেয়ে হিতকর বিষয়টির সিদ্ধান্ত গ্রহণে সহায়তা করে। বিবেকবান বলতে মেধাবী
বা বুদ্ধিমান নয়, বরং মেধা ও বুদ্ধি মানুষের ব্রেইনের সঙ্গে সম্পর্কিত। এর উদাহরণ মেমোরি
কার্ড বা হার্ডডিক্সের সঙ্গে করা যেতে পারে, যা মানুষের জ্ঞান তথা জানা-অজানা তথ্য
সংরক্ষণ করে। পক্ষান্তরে বিবেক বা বুঝশক্তি মানুষের অন্তরের সঙ্গে সম্পর্কিত। হ্যাঁ,
আশ্চর্য মনে হলেও পবিত্র কোরআন ও আধুনিক বিজ্ঞানের আলোকে তা-ই প্রমাণিত হয়। এ কারণেই
তো হার্টের রোগীদের দুশ্চিন্তা পরিহার করে ভালো ভালো বিষয় ভাবতে পরামর্শ দেওয়া হয়।
এ বিষয়ে পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘তাদের অন্তর রয়েছে
অথচ তারা তা দ্বারা উপলব্ধি করে না।’ (সুরা : আরাফ,
আয়াত : ১৭৯)
পবিত্র কোরআনের বিষয়বস্তু নিয়ে চিন্তাভাবনা
করা।
এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ বলেন, ‘তারা কি কোরআন
সম্পর্কে মনোযোগসহ চিন্তাভাবনা করে না, নাকি তাদের অন্তর তালাবদ্ধ!’ (সুরা : মুহাম্মাদ,
আয়াত : ২৪)
লক্ষ করুন, ওপরে উল্লিখিত দুটি আয়াতে চিন্তাভাবনার
সম্পর্ক অন্তরের সঙ্গে করা হয়েছে এবং স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে মহান আল্লাহর সৃষ্টিজগৎ
ও পবিত্র কোরআনের গবেষণার মধ্যে সুষ্ঠু বিবেকবানদের জন্য চিন্তার খোরাক রয়েছে।
মানুষ পৃথিবীর দায়িত্বশীল
মহান আল্লাহ সৃষ্টিকুলের সব কিছু মানুষের
জন্য সৃষ্টি করেছেন। করেছেন মানুষের অনুগত। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘মহান আল্লাহ সেই
সত্তা, যিনি তোমাদের জন্য পৃথিবীর সব কিছু সৃষ্টি করেছেন।’ (সুরা : বাকারা,
আয়াত : ২৯)
সুতরাং আল্লাহ প্রদত্ত এই অধিকার যথাযথভাবে
ব্যবহারের মাধ্যমে পৃথিবীর সুন্দর পরিবেশ গড়ে তোলা মানুষের শ্রেষ্ঠত্বের অন্যতম বৈশিষ্ট্য।
আর যারা এই দায়িত্বের অবহেলা করে কিংবা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে পৃথিবীর সুন্দর পরিবেশ
কলুষিত করে, তারা মানবতার শত্রু। পশুর চেয়েও জঘন্য।
মহান আল্লাহর ইবাদত
এই বিষয়টিকে পূর্ববর্তী বিষয়ের সম্পূরক
বা পরিপূরক বলা যেতে পারে। কেননা মৌলিকভাবে পৃথিবীর সুন্দর পরিবেশ গঠনে একটি পরিকল্পিত
গঠনতন্ত্রের প্রয়োজন, যার আলোকে পৃথিবীর সব কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত হবে। অন্যথায়
যে যার মনমতো ব্যবস্থা গ্রহণ করতে গিয়ে পরিবেশ আরো অশান্ত করে ফেলতে পারে। এবং প্রত্যেকেই
মনে করবে আমি তো ঠিকই করছি। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ বলেন, ‘যখন তাদের বলা
হয়, তোমরা পৃথিবীতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি কোরো না তখন তারা বলে আমরা বরং শান্তি প্রতিষ্ঠা
করছি। শুনে রাখো, নিশ্চয়ই তারাই বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী অথচ তারা বুঝতেও পারে না।’ (সুরা : বাকারা,
আয়াত : ১১-১২)