বয়স হলে অনেকেই স্মৃতিভ্রম রোগে ভুগে থাকেন। জরুরি অনেক কিছুই মনে রাখতে পারেন না। আবার কেউ কেউ কিছু সময় পর সবকিছু ভুলে যান। ডিমেনসিয়ার সঠিক বাংলা প্রতিশব্দ কি হবে বলা মুশকিল। সচরাচর আমরা এটাকে স্মৃতিভ্রংশতা বা বুদ্ধিভ্রংশতা বলে থাকি। এর সাহায্যে ডিমেনসিয়ার পুরো অর্থ প্রকাশ পায় না।
ডিমেনসিয়া একক
কোন নির্দিষ্ট রোগ নয়। মস্তিষ্কের অন্যান্য রোগের কারণে ডিমেনসিয়া হলে নানাবিধ লক্ষণ-উপসর্গ
সৃষ্টি হয়। এর ফলে চিন্তা, আচরণ এবং দৈনন্দিন কার্যক্রম ব্যাহত হয়। মস্তিষ্কের কাজ
বিঘ্নিত হওয়ার ফলে আক্রান্ত ব্যক্তির সামাজিক এবং কর্মজীবন ব্যাহত হয়। ডিমেনসিয়ার প্রধান
লক্ষণ হচ্ছে বোধ-শক্তি বা চৈতন্য শক্তি (কগনিশন) কমে যাওয়ার ফলে প্রাত্যহিক কাজকর্ম
বিঘ্নিত হওয়া।
এ বিষয়ে বিস্তারিত
জানিয়েছেন রাজশাহী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের প্রাক্তন অধ্যাপক ডা. সাইফুদ্দীন একরাম।
বোধশক্তি সংক্রান্ত
দুই বা ততধিক কাজ বিঘ্নিত হলে ডিমেনসিয়া হয়েছে বলে সন্দেহ করা হয়। বোধশক্তি সংক্রান্ত
কার্যক্রমের মধ্যে রয়েছে। স্মৃতি ধারণ ক্ষমতা বা মনে রাখার শক্তি, ভাষা ব্যবহার করার
ক্ষমতা, তথ্য উপলব্ধি করার ক্ষমতা, বিশেষ কোনো কাজ করার দক্ষতা, বিচার-বিবেচনাবোধ এবং
মনোসংযোগ করার ক্ষমতা। ডিমেনসিয়াগ্রস্থ ব্যক্তি সাধারণ কোনো সমস্যার সমাধান করতে পারেন
না এবং মনের আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন না। তাদের ব্যক্তিত্বের পরিবর্তন ঘটে। কারও
ডিমেনসিয়া হওয়ার পর আসলে কী কী লক্ষণ প্রকাশ পাবে তা নির্ভর করে মস্তিষ্কের কোনো কোনো
স্থান বিনষ্ট হচ্ছে তার ওপর।
ডিমেনসিয়া হলে
মস্তিষ্কের আক্রান্ত স্থানের স্নায়ু কাজ করে না, অন্য স্নায়ুর সঙ্গে সংযোগ বিনষ্ট হয়ে
যায় এবং স্নায়ু কোষ মরে যায়। এটি ক্রমশ অগ্রসরমান একটি রোগ। অর্থাৎ এটা ধীরে ধীরে মস্তিষ্কের
মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে এবং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাদের লক্ষণ-উপসর্গের তীব্রতা বাড়তে থাকে।
কাদের ডিমেনসিয়া হয়
যে কোনো ব্যক্তির
ডিমেনসিয়া হতে পারে। তবে বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ডিমেনসিয়া হওয়ার ঝুঁকি বাড়ে। অধিকাংশ
ক্ষেত্রে ডিমেনসিয়া আক্রান্ত ব্যক্তিগণ বয়স্ক, কিন্তু সব বয়স্ক ব্যক্তির ডিমেনসিয়া
হয় না। স্বাভাবিক বয়স বাড়ার সঙ্গে ডিমেনসিয়া হওয়ার কোনো সম্পর্ক নেই। মস্তিষ্কের কিছু
নির্দিষ্ট রোগের কারণে ডিমেনসিয়া হয়। ডিমেনসিয়া মস্তিষ্কের কিছু রোগের প্রকাশ, বয়স
বাড়ার স্বাভাবিক প্রকাশ নয়। সাধারণত যাদের বয়স ৬৫ বছরের ওপরে তাদের ডিমেনসিয়া হয়। এর
আগে ডিমেনসিয়া যদিও বিরল, কিন্তু হতে পারে।
কতগুলো ক্ষেত্রে
বংশগত কারণে ডিমেনসিয়া হতে পারে। জিনের সঙ্গে ডিমেনসিয়ার সম্পর্ক ক্ষীণ, তারপরেও পরিবারে
কারও এটা থাকলে পরবর্তী বংশধরদের ডিমেনসিয়া হওয়ার আশঙ্কা বেড়ে যায়।
স্বাস্থ্যগত
কারণে এবং জীবনাচরণের জন্যও ডিমেনসিয়া হওয়ার আশঙ্কা বেড়ে যায়। যেমন যাদের রক্তনালির
রোগ বিশেষত উচ্চ রক্তচাপ থাকে, যারা শারীরিক এবং মানসিকভাবে তেমন সক্রিয় নন তাদের ডিমেনসিয়া
হওয়ার আশঙ্কা বেশি।
ডিমেনসিয়া কেন হয়
অনেক রোগের
কারণে ডিমেনসিয়া হয়। কিন্তু কি কারণে এটা হয় তা অনেক ক্ষেত্রেই জানা নেই। ডিমেনসিয়ার
কতগুলো সাধারণ কারণের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে-
* আলঝিমারের
রোগ
* রক্তনালির
রোগজনিত ডিমেনসিয়া
* লিউই বডি
ডিমেনসিয়া
* ফ্রন্টো-টেমপোরাল
ডিমেনসিয়া
* অন্যান্য
কারণে সৃষ্ট ডিমেনসিয়া
আলঝিমারের রোগ
পৃথিবীব্যাপী
ডিমেনসিয়ার প্রধান কারণ আলঝিমারের রোগ। ডিমেনসিয়ার প্রতি তিন জনের মধ্যে দুই জনই আলঝিমারের
রোগে আক্রান্ত। এর ফলে ধীরে ধীরে বোধশক্তি বা চৈতন্যগত কার্যকলাপ ক্ষীণ হতে থাকে। প্রাথমিক
পর্যায়ে স্মৃতিশক্তি কমে যায়।
রক্তনালির রোগজনিত ডিমেনসিয়া
মস্তিষ্কের
রক্তনালি বিনষ্ট হওয়ার কারণে ধীরে ধীরে মস্তিষ্কের বোধশক্তি ক্ষীণ হয়ে ডিমেনসিয়া হতে
পারে। মস্তিষ্কে একবার স্ট্রোক হলেই এটা ঘটে যেতে পারে। আবার অনেকের বিভিন্ন সময়ে ছোট
ছোট স্ট্রোক বা মিনি স্ট্রোক হওয়ার ফলে এমন হতে পারে। অনেক ক্ষেত্রে স্ট্রোক ছাড়াও
মস্তিষ্কের রক্তনালি বিনষ্ট হয়ে ডিমেনসিয়া হতে পারে।
আলঝিমারের রোগ
এবং রক্তনালির রোগজনিত ডিমেনসিয়া এক সঙ্গেও থাকতে পারে।
ডিমেনসিয়া একটি
জটিল রোগ। অন্যান্য স্নায়ুরোগজনিত ডিমেনসিয়ার কারণ এবং প্রকাশ আরও জটিল।
কিছু রোগের
ক্ষেত্রে ডিমেনসিয়ার মতো লক্ষণ-উপসর্গ প্রকাশ পেলেও তা আসলে ডিমেনসিয়া নয় এবং কিছু
কিছু ক্ষেত্রে এগুলো চিকিৎসা করলে নিরাময় সম্ভব। যেমন- ভিটামিনের অভাব, থাইরয়েড হরমোনের
সমস্যা, বিষণ্ণতাজনিত রোগ, ওষুধের প্রতিক্রিয়া, মস্তিষ্কের জীবাণু সংক্রমণ, মস্তিষ্কের
টিউমার ইত্যাদি। এজন্য রোগের বিস্তারিত বর্ণনা এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে প্রকৃত ডিমেনসিয়া
শনাক্ত করা জরুরি।
কখন ডিমেনসিয়া সন্দেহ করব
অনেক সময় ডিমেনসিয়া
খুব ধীরে ধীরে প্রকাশ পায় এবং খুব মনোযোগ দিয়ে লক্ষ্য না করলে ধরা পড়ে না। তবে কতগুলোর
সাধারণ লক্ষণ হচ্ছে-
* ক্রমাগত কিংবা
মাঝে মাঝে স্মৃতিলোপ পাওয়া বা ভুলে যাওয়া
* মানসিক প্রমাদ
বা এলোমেলো অবস্থা
* ব্যক্তিত্বের
পরিবর্তন
* উদাসীনতা
এবং স্বাভাবিক কাজকর্ম থেকে নিজেকে সরিয়ে নেয়া
* প্রাত্যহিক
কাজকর্ম করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলা।
ডিমেনসিয়ার সমাধান
এক কথায় ডিমেনসিয়ার
সহজ সমাধান নেই। ওষুধ ব্যবহার করে এর লক্ষণ-উপসর্গের সাময়িক উপশম করা যায় বটে, একেবারে
নিরাময় হয় না, এ রোগের ক্রম অগ্রগতি প্রতিরোধও করা যায় না। এজন্য ডিমেনসিয়ার মূল চিকিৎসা
রোগীকে সাহায্য-সহযোগিতা করা। পরিবার, বন্ধুবান্ধব এবং সেবাদানকারীরা রোগীকে দৈনন্দিন
কাজকর্ম করার জন্য সাহায্য করলে অনেকে কিছুটা স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারে। সহজেই
অনুমেয় এটা অত্যন্ত কষ্টদায়ক জীবন যাপন।