কালিয়াকৈর (গাজীপুর) প্রতিনিধি:
কৃষি প্রধান বাংলাদেশে খাদ্যে সয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনে আধুনিক পদ্ধতিতে চাষাবাদ করে অধিক ফলন পাওয়ার প্রচেষ্টা বহুদিনের। কিন্তু গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলার ভাউমান টালাবহ এলাকায় বিলের অংশটুকু নিম্নাঞ্চল হওয়ায় বছরের প্রায় সময়ই জলাবদ্ধতায় আবদ্ধ থাকে। ইচ্ছে থাকলেও উপজেলার এ অঞ্চলের সব জমিতে বছরের পুরো সময় সবজি চাষ করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। উপজেলার এ অঞ্চলে বেশিরভাগ জমিতে পানি নিষ্কাশনের সু-ব্যবস্থা না থাকায় বছরের ছয় মাস এ অঞ্চলের জমিতে পানি জমা থাকে। তাই বছরে একবারই তারা জমিতে ফসল ফলাতে পারছেন। বাকি সময় পানি জমে থাকার কারণে জমি থাকে অনাবাদি। বদ্ধ পানিতে আগাছা ও কচুরিপানায় ভরে যায় জমি।
তবে এই এলাকারই সন্তান মালেক মাস্টার নতুন এক পদ্ধতি ব্যবহার করে এসব জলামগ্ন অনাবাদি ও পতিত জমিতে ভাসমান (ধাপ) পদ্ধতিতে বেডে সবজি চাষ করে সফলতার অপার সম্ভাবনা দেখিয়েছেন এলাকার সকল মানুষকে। মালেক মাস্টার পেশায় একজন শিক্ষক। তিনি ভাউবান টালবাহ মডেল উচ্চ বিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক হিসেবে কর্মরত আছেন। ছোট সময় থেকে পড়ালেখার পাশাপাশি তার কৃষি কাজে ব্যাপক জোক ছিল, তাই তিনি শিক্ষকতার পাশাপাশি কৃষি কাজে বাকি সময় ব্যয় করে থাকেন। তার ফসলের ব্যাপক সম্ভাবনা দেখে এলাকার অনেকেই ভাসমান পদ্ধতিতে সবজি চাষাবাদ শুরু করেছেন।
প্রথম পর্যায়ে তাদের এই কাজকে অনেকেই ভালো চোখে না দেখলেও পরে স্বল্প সময়ে, স্বল্প ব্যয়ে অধিক মুনাফা অর্জনের কারণে এলাকার অনেকেই এখন মালেক মাস্টারের দেখাদেখি ধাপের ওপর সবজি চাষ করছেন।
কোনো ধরনের রাসায়নিক সার ব্যবহার ছাড়াই জৈব সার ব্যবহার করে এ পদ্ধতিতে চারা উৎপাদন ও সবজি চাষ ক্রমান্বয়ে গোটা দেশের কৃষক ও কৃষি গবেষকদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। দেশের নিম্নাঞ্চলের যেসব এলাকার জমি বেশিরভাগ সময় পানিতে ডুবে থাকে তারা এ পদ্ধতিতে শাক-সবজির চারা উৎপাদন ও বাণিজ্যিক চাষাবাদ করে সফলতা অর্জন করতে পারে। ভাসমান বেডে শীত ও বর্ষাকালীন শাক-সবজি চাষ করা সম্ভব। এতে খরচ কম। রোগ-বালাই, পোকা-মাকড়ের উপদ্রবও কম। কীটনাশক ও সার তেমন একটা দিতে হয় না।
বেড তৈরির পদ্ধতিঃ
কচুরিপানা আটকে স্তর স্তর করে ৫ ফুট উচু, প্রস্থ সারে ৪ ফুট ও ৪০ থেকে ৪৫ ফুট দৈর্ঘের একটি ধাপ তৈরি করা হয়। চারজন লোক দুদিনে একটি ধাপ তৈরি করতে পারেন। তবে অনেক সময় ধাপের দৈর্ঘ্য জমি অনুযায়ী কম-বেশী হতে পারে। ধাপ তৈরির কয়েকদিন পর যখন ধাপটি নরম হয় তখন তার উপর ‘দৌল্লা’ বসানো হয়। টোপাপানা দুলালি লতা দিয়ে পেচিয়ে ছোট বল আকৃতিতে তৈরি করা হয় দৌল্লা। দলা দলা করে এগুলো বানানো হয় বলেই এগুলোকে স্থানীয় ভাবে ট্যামা বা দৌলা বলা হয়। বলের মাঝ খানে অংকুরোদগম বীজ বসিয়ে ছায়াতে রাখা হয় তা। বীজ ভিজিয়ে রাখলে ৫ থেকে ৭ দিনে অংকুরোদগম হয়। পাতা বের হওয়ার পর দৌল্লাগুলো ধাপের উপর রাখা হয়। একটি বেডে তিন থেকে চারবার চাষ করা যায়। ভাসমান সবজি চাষের একেকটি বেড এক মৌসুমের জন্য করা হয়। সবজি চাষ শেষ হলে ওই পচা ধাপ বোরো চাষের আগে জমিতে জৈব সার হিসেবে ব্যবহার করেন। ২০ মিটার লম্বা ২ থেকে আড়াই মিটার প্রস্থ একটি বেড তৈরি করতে সাড়ে ৩ হাজার থেকে ৪ হাজার টাকা খরচ হয়। এক মৌসুমে একেক বেড থেকে ৯ হাজার থেকে ১০ হাজার টাকার সবজি বিক্রি হয়।
ভাসমান বেড়ে যেসব ফসল উৎপাদন সম্ভবঃ
পানির ওপর ভাসমান বেডে প্রায় সব ধরনের সবজি চাষ করা সম্ভব। তবে উপজেলার ভাউমান টালাবহ এলাকায় সরে জমিনে দেখা গেছে, শসা, কাঁকরোল, করলা, মিষ্টিকুমড়া, লাউ, বেগুন, লালশাক, পালংশাকসহ নানা প্রকার সবজি চাষের সমারোহ। বিলের পানি ছাড়াও এই পদ্ধতিতে বাড়ির পাশে জলাশয়ে সবজি চাষ করা সম্ভব।
ভাসমান পদ্ধতির সবজি চাষী মালেক মাস্টার বলেন, পড়ালেখার পাশাপাশি ছোট থেকেই কৃষি কাজের প্রতি আমার জোক ছিল। আমাদের এলাকায় এসব জমিতে বেশির ভাগ সময় পানি থাকে বলে আমি ইউটিউব দেখে এভাবে সবজি চাষ সম্পর্কে জানি। তারপর প্রথমে ২৫ শতাংশ জমির উপর পাইলট প্রকল্প হিসাবে দশটি বেড করে লাউ সহ আরো কয়েক প্রকার সবজি চাষ করেছিলাম। প্রথম প্রকল্প থেকেই আমি প্রায় ৫০০ টি লাউ তুলেছিলাম। এতে আমার পরিবারের চাহিদা মিটিয়েও যে খরচ হয়েছে তার কয়েকগুন লাভ পেয়েছি। প্রথমে আমি চিন্তাও করতে পারিনি যে এতো পরিমান সবজি পাবো। আমার এই সবজির ফলন দেখে প্রতিদিন এর দৃশ্য দেখতে অনেক লোক এখানে জড়ো হতো।
ভাসমান পদ্ধতির সবজি চাষী মালেক মাস্টারের চাচা বলেন, প্রথমে আমার ভাতিজা মালেক আমাকে ইউটিউবে ভাসমান পদ্ধতিতে সবজি চাষের বিষয়টি দেখায়। পরে আমি তাকে এভাবে সবজি চাষ করতে উৎসাহিত করি। তাকে বলি যে, অন্য মানুষ এভাবে সবজি চাষ করতে পারলে তুমিও পারবে। ভাসমান পদ্ধতিতে সবজি চাষ দেখে আমাদের এলাকায় প্রথমে অনেকেই হাসাহাসি করত কিন্তু এখন এর সফলতা দেখে অন্যরাও এভাবে চাষ শুরু করেছে।
মালেক মাস্টারের পাশাপাশি ভাসমান পদ্ধতিতে সবজি চাষী অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তা আতাউর রহমান বলেন, আমি ইউটিউব দেখে এই পদ্ধতিতে ভাসমান সবজি চাষের বিষয়টি পেয়েছি। এ বছর এখন একটি বেডে নিজের জন্য চারা লাগিয়েছি আরেকটি বেড প্রস্তুত আছে আরো কিছু সবজির চারা লাগাব।
একজন স্থানীয় বাসিন্দা বলেন, আমরা দেখেছি এবার মালেক মাষ্টারের বেডের উপর অনেক লাউ হয়েছিল। সরকারি সহযোগিতা পেলে এই পদ্ধতিতে আরো অনেক ফসল পাওয়া সম্ভব।
কালিয়াকৈর উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা সাইফুল ইসলাম বলেন, ভাসমান বেড তৈরির জন্য প্রশিক্ষণের পাশাপাশি প্রয়োজনীয় বীজ, ফেরোমন ফাঁদ ও অন্যান্য উপকরণ সরবরাহ করা হয়। এলাকার উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা সার্বক্ষনিক সবজি দেখাশুনা করেছেন এবং প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিয়ে থাকে। পরবর্তিতে উপজেলার আরো অনেকেই এই বিষয়ে আগ্রহ হলে প্রতেককেই কৃষি অফিস থেকে সকল প্রকার সহযোগিতা প্রদান করা হবে। বিষমুক্ত সবুজ সবজিতে পরিপূর্ণ দেখে কৃষক পরিবার ও আমরা কৃষিবিভাগ আনন্দিত। আশা করছি আগামীতে কালিয়াকৈর উপজেলা বিভিন্ন এলাকায় আরো ব্যাপক সংখ্যক ভাসমান বেডে সবজি চাষ করবেন কৃষকরা।