কুয়াশার খোলস সরিয়ে ফর্সা হতে শুরু করেছে ভোরের সকাল। আলো ছড়াতে শুরু করেছে পথ-ঘাট-খেত সবখানে। সেই আলোতে স্পষ্ট হয়ে ওঠে বাঁধের (জলকপাট) পানিতে শত শত মানুষের মুখরতা। তাঁরা সবাই বাঁধের ওপর দাঁড়িয়ে একের পর এক পানিতে জাল ফেলছেন। কখনো কখনো একজনের জাল অন্যের জালের ওপর পড়ছে। এতে কিঞ্চিৎ বিড়ম্বনায় ফেললেও মাছশিকারিদের দমাতে পারেনি।
মঙ্গলবার (১৭ অক্টোবর) ভোর পাঁচটার দিকে ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার সুক নদের ওপরের বুড়ির বাঁধ এলাকার চিত্র এটি। খেতখামারে সেচের চাহিদা না থাকায় বছরের পয়লা কার্তিক খুলে দেওয়া হয় বাঁধের দরজা। ধীরে ধীরে পানি কমতে থাকে। আর এ সময়টায় শুরু হয় মাছ ধরার উৎসব। আশে পাশের গ্রামের মানুষ ফিকা জাল, খইয়া জাল নিয়ে মেতে ওঠেন উৎসবে। তাঁদের সঙ্গে যোগ দেন শহরের মানুষজনও। উৎসব চলে তিন থেকে চার দিন।
ঠাকুরগাঁও জেলা মৎস্য অধিদপ্তরের সিনিয়র সহকারী পরিচালক সুনীল মন্ডল জানান, ৫০ একর এলাকাজুড়ে সুক নদীর ওপর নির্মিত বুড়ির বাঁধ মৎস্য অভয়াশ্রম। প্রতিবারই বুড়ির বাঁধ এলাকায় পোনা ছাড়া হয়। এটি আমরা জুলাই মাসের দিকে দিয়ে থাকি এবং শীতের শুরুতেই আবার বাঁধের পানি ছেড়ে দেওয়ার পর মাছ ধরার জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। এভাবেই প্রতিবছর চলে বুড়ির বাঁধে মাছ ধরার উৎসব।
এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শুষ্ক মৌসুমে কৃষি জমিতে সেচ সুবিধার জন্য ১৯৫১-১৯৫২ অর্থ বছরে সদর উপজেলার সুক নদের ওপর বুড়ির বাঁধ নামে একটি জলকপাট নির্মাণ করা হয়। ১৯৭৭-১৯৭৮ অর্থবছরে বাঁধের আশেপাশে সেচ খাল নির্মাণ করা হয়।
নির্মাণের পর সেই জলকপাটে আটকে থাকা পানিতে মৎস্য অধিদপ্তর বিভিন্ন জাতের মাছের পোনা ছাড়ে। আর পরে বাংলা কার্তিক মাসের শুরুর দিনে সেসব মাছ সবার জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। সেই থেকে বাঁধের জলে মাছ ধরার উৎসবের এ রেওয়াজ চলে আসছে। আর সেই রেওয়াজে যোগ দেন হাজারো মানুষ।
বুড়ির বাঁধ এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে, অসংখ্য মানুষের ভিড়। বাঁধের ওপর দাঁড়িয়ে আবার কেউ পানিতে দাঁড়িয়ে জাল ফেলে মাছ ধরছেন। ভিড়ের কারণে একজনের জাল অন্যজনের জালের ওপরে পড়ছে। আর তা নিয়ে চলছে হাসিঠাট্টা আর খুনসুটি। তা দেখে সদর উপজেলার আখানগর গ্রামের সুমন বললেন, ‘পড়িবে নাতে কী, এইঠে যতলা লোক মাছ মারছে, বাঁধের পানি ফাঁকা পাওয়া যাসেনি। জাল ফেলাবা গেলেই অন্যের জালের ওপরত পড়ছে।
সদর উপজেলার বরুনাগাঁও গ্রামের কৃষক রুবেল হোসেন (৪০) বাঁধের হাঁটুপানিতে দাঁড়িয়ে জাল ফেলছিলেন। তাঁর জাল পানিতে লুকিয়ে থাকা গাছের একটি ডালে আটকে যায়। জাল ছাড়াতে গিয়ে পানিতে নেমে পড়েন তিনি। এমন সময় একটি জাল তাঁর ওপর এসে পড়ে। কোনোরকমে সেটা ছাড়িয়ে উঠে আসেন তিনি। পরে বললেন, ‘ভোর বেলায় এসেছি। কিছু ছোট পুঁটি মাছ পেয়েছি। তবে মানুষ বেশি থাকায় জাল ফেলতে সমস্যা হচ্ছে। সমস্যা হলেও আমরা সেটা উপভোগ করছি।
পুরাতন ঠাকুরগাঁওয়ের বাসিন্দা মো. আলী (৫০) জানালেন, এই বাঁধের পানিতে বোয়াল, বাইম, গুতুম, শোল, ট্যাংরা, খলসে, পুঁটি, টাকি, মলা, চিংড়িসহ বিভিন্ন দেশি মাছ বেশি পাওয়া যায়। তবে অনেকের জালে আবার রুই, কাতলা, বিগহেডসহ নানা জাতের মাছও ধরা পড়ে।
বাঁধের ওপরে বসেছে খাবারের হোটেল, ফলের দোকান, খেলনার দোকান। এলাকার লোকজন বিভিন্ন এলাকা থেকে উৎসবে যোগ দেওয়া মানুষজনের মোটর সাইকেল-বাইসাইকেল নিরাপদে রাখার জন্য তৈরি করেছেন অস্থায়ী গ্যারেজ। খাবার দোকানি আলেকা বেগম বললেন, ‘প্রতিবছর এইঠে খাবারের দোকান নিয়ে বসি। লাভ হয়।’
অনেক মাছশিকারি আবার মাছ বিক্রি করতে বাঁধের ওপর পসরা সাজিয়ে বসেছেন। আর সেসব মাছ দরাদরি করে কিনে নিচ্ছেন দেখতে আসা অনেকেই। তবে পুঁটি আর পাঁচমিশালিসহ ছোট মাছের চাহিদা সেখানে বেশি। প্রতি কেজি পুঁটি বিক্রি হচ্ছে ২৫০ টাকায়। আর বিক্রেতা পাঁচমিশালি মাছের দাম যাঁর কাছে যেমন পাচ্ছেন, নিচ্ছেন।
তবে উল্লাসের পাশাপাশি অনেকের মধ্যে হতাশাটাও দেখা গেছে। মাছ ধরতে এসে ফিরে যাচ্ছিলেন শিক্ষক আমিনুর ইসলাম। তাঁর মতে, বাঁধে আগে যেভাবে মাছ পাওয়া যেত, এখন সেটা দিন দিন কমে আসছে। এভাবে চললে এই মাছ ধরার উৎসবে একদিন ভাটা পড়বে।
ঠাকুরগাঁও আকচা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান সুব্রত কুমার বর্মণ জানান, মাছ ধরার উৎসবকে কেন্দ্র করে প্রতিবছরের মতো এবারও মানুষের ঢল নেমেছে। এখানে কেউ মাছ ধরতে আসেন, কেউ বা আসেন মাছ ধরা দেখতে আবার কেউ আসেন কম দামে মাছ কিনতে। সেই যাই হোক এ সময় পুরো এলাকা উৎসবমুখর হয়ে উঠে।