সংসদ নির্বাচনে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলো একই আসনে একাধিক প্রার্থী দিয়ে প্রার্থিতা প্রত্যাহারের দিন বা তার আগে একজন প্রার্থীকে চূড়ান্ত করতে পারে। এক্ষেত্রে দলীয় মনোনয়ন পেয়েও যারা বাদ পড়বেন তারা দলের বিদ্রোহী বা স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে থাকতে পারবেন না।
প্রার্থী নির্বাচনে দলের বিদ্রোহ ঠেকাতেই ১০ বছর আগে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে (আরপিও) নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোকে এই ক্ষমতা দেওয়া হয়। বিদ্যমান এই আইনের কারণে এবারের নির্বাচনে দলের বিদ্রোহী প্রার্থীদের ছাড় দেওয়ার সুযোগ কম। এ ছাড়া কারা দলের চূড়ান্ত প্রার্থী হচ্ছেন, তা জানতে ১৮ ডিসেম্বর প্রার্থিতা প্রত্যাহারের শেষ দিন পর্যন্ত অপেক্ষায় থাকতে হবে।
সাবেক নির্বাচন কমিশনার মো. রফিকুল ইসলাম এ বিষয়ে বলেন, আরপিওর ১৬(২) অনুচ্ছেদে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের প্রার্থী নির্বাচনে যে ব্যাপক ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে তাতে দলের নেতারা দলীয় মনোনয়ন বঞ্চিত হওয়ার পর স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার সুযোগ হারিয়েছেন। বলতে গেলে দলে থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার সুযোগটাই কমে গেছে। এ বিধান রাজনৈতিক দলের শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের প্রার্থী নির্বাচনে একচ্ছত্র ক্ষমতা দিলেও দলের অভ্যন্তরে গণতান্ত্রিক চর্চার পথে অন্তরায় সৃষ্টি করেছে।
সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী বাছাইয়ে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোকে অগাধ ক্ষমতা দিয়েছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। দলগুলো একাধিক প্রার্থী মনোনয়ন দিতে পারবে। প্রত্যাহারের আগে একজনকে চূড়ান্ত করে চিঠি দিলে অন্যদের মনোনয়ন বাতিল বলে গণ্য হবে। এর আগে সংসদ নির্বাচনে মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের ক্ষমতা প্রার্থী বা তার এজেন্টের হাতেই ছিল। দল বা জোট কাউকে চূড়ান্ত মনোনয়ন না দিলেও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারতেন। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ সংশোধন করে ১২ ধারা ৩এ(বি) এবং ১৬ ধারা (২)-তে এই ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে।
আরপিওর ১৩(৩) অনুচ্ছেদে বলা আছে, কোনো নিবন্ধিত দলের পক্ষ থেকে প্রাথমিকভাবে একাধিক প্রার্থীকে মনোনয়ন দেওয়া যাবে এবং তা ১৬ (২) ধারা অনুযায়ী কার্যকর হবে। ১৬ (২) অনুচ্ছেদে বলা আছে, যদি কোনো আসনে একের অধিক প্রার্থীকে মনোনয়ন দেওয়া হয়, তার মধ্যে থেকে একজনকে মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের দিন বা তার আগে চূড়ান্ত করতে হবে। তা নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক বা সমপর্যায়ের কেউ লিখিতভাবে রিটার্নিং অফিসারকে জানাবেন। দলের অন্য মনোনীত প্রার্থীদের প্রার্থিতা স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাতিল হয়ে যাবে।
এ বিধানের ফলে নিজ দলের প্রার্থীর ইচ্ছার বিরুদ্ধে তার প্রার্থিতা প্রত্যাহার করে নিয়ে জোটের কোনো প্রার্থীকে নির্বাচনে জিতিয়ে আনার সুযোগ সৃষ্টি হয়। আগের দুটি নির্বাচনে এ ধরনের ঘটনার নজির রয়েছে।
তবে নবম সংসদ নির্বাচনে রাজনৈতিক দলগুলোর এই ক্ষমতা ছিল না। ১২ ৩এ(বি) অনুচ্ছেদে আগে ছিল, নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের পক্ষে সভাপতি/সাধারণ সম্পাদক বা সমপর্যায়ের পদাধিকারী স্বাক্ষরিত এই মর্মে একটি প্রত্যয়নপত্র দেওয়া হবে যে, প্রার্থীকে দলের পক্ষ থেকে মনোনয়ন প্রদান করা হয়েছে। কোনো নিবন্ধিত দলের পক্ষ থেকে প্রাথমিকভাবে একাধিক প্রার্থীকে মনোনয়ন প্রদান করা যাবে। একের অধিক প্রার্থীকে মনোনয়ন করা হলে মনোনয়নপত্র বাছাইয়ের আগেই চূড়ান্তভাবে একজন মনোনীত প্রার্থীর নাম রিটার্নিং অফিসারকে লিখিতভাবে জানাতে হবে।
কিন্তু ২০১৩ সালে তৎকালীন নির্বাচন কমিশনের সুপারিশে এই ধারায় সংশোধনী এনে প্রার্থী চূড়ান্ত করার সময় প্রার্থিতা প্রত্যাহারের দিন পর্যন্ত বাড়ানো হয়।
অনিবন্ধিত দলও দলীয় প্রতীকে নির্বাচন করতে পারবে : আইনগত দুর্বলতার কারণে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অনিবন্ধিত বা নিবন্ধন অবৈধ ঘোষিত হয়েছে এমন দলের নেতাদেরও জোটভুক্ত হয়ে নিবিন্ধত কোনো দলের প্রতীকে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সুযোগ রয়েছে। তবে জোটের যে দলের প্রতীকে তারা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন সে দলের প্রার্থী হিসেবেই গণ্য হবেন তারা। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জামায়াতের প্রার্থীরা এ বিধানের কারণেই বিএনপির ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে প্রার্থী হন।
নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশের মাধ্যমে এই বিধান যোগ করা হয় যে, কোনো অনিবন্ধিত দলের সঙ্গে জোট করা যাবে না এবং জোটের প্রার্থীরা যে দলের প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করবেন তারা সেই দলের প্রার্থী হিসেবে গণ্য হবেন। কিন্তু প্রভাবশালী রাজনৈতিক দলগুলোর বিরোধিতার কারণে ওই বছর দ্বিতীয় অধ্যাদেশের মাধ্যমে বিধানটি (৯০-খ-৩ অনুচ্ছেদ) বাদ দেওয়া হয়। তবে সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হতে হলে পুরোনো দলগুলোর ক্ষেত্রে নিরবচ্ছিন্নভাবে তিন বছরের বেশি সময় দলের সদস্য থাকার বাধ্যবাধকতা বহাল থাকে। কিন্তু ১০ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ২০১৩ সালে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের ১২ (১) ঞ অনুচ্ছেদের ওই বিধান বাদ দেওয়া হয়। নির্বাচন কর্মকর্তাদের মতে, এর ফলে বর্তমানে নিবন্ধন নেই এমন দলগুলোর নেতারা কোনো নিবিন্ধত দলের সঙ্গে জোটভুক্ত হয়ে দলীয় প্রতীকে অংশ নিতে পারবেন। স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে নির্বাচনী এলাকার এক শতাংশ ভোটারের সমর্থনসূচক স্বাক্ষর নেওয়ার চেয়ে এটি সহজ হবে।