পাবনা প্রতিনিধি:
চিকিৎসা শেষে সুস্থ হয়েও বাড়ি যেতে পারছে না ৯ জন অনেক বছর ধরেই আছেন পাবনার মানসিক হাসপাতালে। এদের মধ্যে কেউ ৩১ বছর কেউ ২১ বছর কেউ এক যুগেরও বেশি সময় ধরে মানসিক হাসপাতালে আছে। ভুল ঠিকানায় ভর্তি করার পর এসব রোগীদের আর কোন খোঁজ রাখেনি পরিবার। তাই তাদের কোথাও যাওয়ার জায়গা না থাকায় হাসপাতালেই রয়ে গেছেন তারা ।
পাবনার মানসিক হাসপাতালের কর্মকর্তা ডা. রতন কুমার রায় এমন তথ্যে নিশ্চিত করেছেন। এসব রোগীকে যখন ভর্তি করা হয়েছিল সে সময় জাতীয় পরিচয়পত্র ছিল না। ফলে রোগীর স্বজনদের দেয়া তথ্যের উপর ভরসা করেই রোগী ভর্তি করা হতো যার কারণে কিছু রোগীর স্বজন প্রতারণা করে ভুল ঠিকানা দিয়েছে হাসপাতালকে। যদিও এখন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছে বর্তমানে রোগী এবং রোগীর স্বজনদের জাতীয় পরিচয়পত্র ছাড়া কোন ভর্তি নেওয়া হয় না। এদিকে সুস্থ হয়ে ওঠা ৯ জনের স্বজনরা মুখ ফিরিয়ে নেওয়ায় হতাশায় ভুগছেন তারা। বর্তমানে আবারও মানসিক চাপের সম্মুখীন হচ্ছেন তারা। স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এদের বেশিরভাগই এখন বাড়ি ফিরতে চান। সুস্থ হয়েও হাসপাতালে অনেকটা বন্দি জীবন কাটাতে হচ্ছে এসব নারী ও পুরুষদের। কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই তাদের। এদের মধ্যে অনেকেই এখন বয়সের ভাড়ে নুয়ে পড়েছেন। শেষ জীবনে পরিবারের সদস্য ছাড়া একাকিত্ব জীবন তাদের কাছে দুর্বিষহ হয়ে উঠছে।
এদের একজন বদিউল আলম। মানসিক সমস্যার চিকিৎসার জন্য স্বজনরা ২০০৫ সালে মানসিক হাসপাতালে ভর্তি করে। প্রথম দিকে পরিবারের লোকজন খোঁজ খবর রাখলেও পরে আর কোন খবর রাখেনি। দীর্ঘদিন ডাক্তারের নিয়মিত চিকিৎসায় এক সময় বদিউল আলম সুস্থ হয়ে ওঠেন। ভর্তির সময় তার বাড়ির ঠিকানা অনুযায়ী হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ যোগাযোগ করলে সেই ঠিকানা অনুযায়ী বদিউল আলমের পরিবারের কাউকে পাওয়া যায়নি। ভর্তির সময় বদিউল আলম এর পরিবার থেকে ভুল ঠিকানা দেওয়া হয়েছিল। ভর্তির সময় বদিউল আলমের বয়স ছিলো ৩০ বছর। এখন তার বয়স চলছে ৪৪ বছর। পাবনা মেডিকেল বোর্ডের সুপারিশে বদিউল আলম অনেক আগেই ছাড়পত্রের জন্য উপযুক্ত ঘোষিত হয়েছে। স্বজনরা কেউ না আসায় তিনি এখন হাসপাতালেই জীবনের শেষ সময় পার করছেন। হাসপাতালের রেজিষ্ট্রেশন বই অনুযায়ী ভর্তির সময় পিতার নাম দেয়া ছিল, মৃত আঃ ওয়াদুদ সিকদার, ভাইয়ের নাম মো. জিয়াউল আলম (উজ্জল)। ২৪৩ মধ্য বাসাব সবুজবাগ ঢাকা। বর্তমানে তিনি হাসপাতালের ৫নং ওর্য়াডে আছেন।
সাঈদ হোসেন ১৯৯৬ সালের ২২ জুলাই পরিবারের সদস্যদের মাধ্যমে পাবনা মানসিক হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। ভর্তির সময় তার বাবার নাম লেখা ছিল আবুল হাসেম মিয়া। মায়ের নাম লেখা ছিল হেলেনা বেগম। স্থানীয় ঠিকানা ছিল পাবনার দক্ষিণ রাঘবপুর এলাকা। ভর্তির সময় সাঈদের বয়স ছিল ৩৬ বছর। বর্তমান তার বয়স হয়েছে ৫৯ বছর। দীর্ঘদিন চিকিৎসা শেষে মেডিকেল বোর্ড তাকেও ছাড়পত্রের জন্য উপযুক্ত বলে সুপারিশ করেছে। কিন্তু পরিবারের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী ওই ঠিকানায় পরিবারের কাউকে পাওয়া যায়নি। পরিবারের পক্ষ থেকেও কেউ আর যোগাযোগ করেনি। ফলে তিনিও অনেকদিন যাবত হাসপাতালের ৯ নং ওর্য়াডের বাসিন্দা হয়ে আছেন।
জাকিয়া সুলতানা মাত্র ২১ বছর বয়সে ২০০৯ সালের ১৭ জুলাই মানসিক রোগী হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। বাবার নাম দেয়া ছিল মৃত বজলুর রশিদ, মায়ের নাম শাহনাজ। ঠিকানা দেওয়া হয়েছিল পাবনার রাধানগর এলাকার। জাকিয়া সুলতানার পরিবার প্রথম দিকে খোঁজ নিলেও পরে আর কোন খোঁজ খবর নেয়নি। সময়ের ব্যবধানে তার পরিবার খোঁজ নেওয়া বন্ধ করে দেয়। এখন ভালো হয়ে গেলেও পরিবারের কাছে ফিরে যেতে পারছেন না তিনি। বর্তমানে তার বয়স ৩১ বছর। বর্তমান হাসপাতালের ১৩ নং ওয়ার্ডে আছেন। একই পরিণতি সিপ্রা রাণী রায়, নাজমা নিলুফার, নাইমা চৌধুরী, গোলজার বিবি, শাহানারা আক্তার, অনামিকা (বুবি)। এদের মধ্যে সিপ্রা রাণী রায় ছাড়া বাকি সবাই পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়ে উঠেছেন। মেডিকেল বোর্ড তাদেরকে সুস্থ বলে ছাড় পত্রের জন্য সুপারিশ করেছে। শিপ্রা রাণী রায় এখনও সুস্থ হয়ে ওঠেনি। তার চিকিৎসা এখনও চলমান। এখন তারা কোথায় যাবে কোন ঠিকানা জানা নেই। চিকিৎসায় সেরে ওঠার পর যখন বুঝতে পারছে যে তাদের পরিবার তাদেরকে নিতে চাচ্ছে না তখন তাড়া হতাশ হয়ে পড়ছে। মানসিক রোগীর সাথেই জীবন কাটছে সেরে ওঠা এসব মানুষের। মানসিক কষ্ট বুকে চেপেই তারা চুপচাপ অন্যর স্বজনদের আসা যাওয়ার দৃশ্য দেখে। প্রতিনিয়তই তারা তাদের পরিবারের সদস্যদের অপেক্ষায় থাকে। এই বন্দি পরিবেশ থেকে মুক্তি পেতে চায় তারা।
পাবনা মানসিক হাসপাতালের (ভারপ্রাপ্ত) পরিচালক ডা. রতন কুমার রায় আজকের দর্পণকে বলেন, আগে একসময় জাতীয় পরিচয়পত্র ছিল না। ফলে রোগীর স্বজনদের দেয়া তথ্যের উপর ভিত্তি করেই রোগী ভর্তি করা হতো। পরবর্তীতে দেখা গেছে কিছু রোগীর ঠিকানায় ভুল তথ্যে দিয়েছে স্বজনরা। সুস্থ হয়ে ওঠা এসব রোগীদের ঠিকানা অনুযায়ী আমরা খোঁজ নিয়ে তাদের কোন আত্মীয় স্বজনকে পাইনি। ফলে তারা এখন হাসপাতালেই রয়েছে। পরিবার থেকে খোঁজ খবর নেয় না এমন রোগীদের বেশির ভাগই নারী। রোগীদের কেউ চিনতে পারলে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে অবহিত করার অনুরোধ জানান ডা. রতন কুমার রায়।