২০০৮ এর নির্বাচনে জোটবদ্ধ আওয়ামী লীগের ভূমিধ্বস বিজয়ের পর দলটি টানা তিনটি মেয়াদে রাষ্ট্র পরিচালনা করছে। বাংলাদেশের ইতিহাসে এতটা দীর্ঘ সময় কোন ব্যক্তি বা দল রাষ্ট্র পরিচালনা করে নাই
১৩ অক্টোবর তারিখে বাংলা ট্রিবিউনের একটি খবরে চোখ আটকে গেল। শিরোনাম: নৌকা পেল ‘বিতর্কিত’ অনেকে, তৃণমূলের ক্ষোভ।এই বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করার এটাই মোক্ষম সময়। ২০২৩ সালে অনুষ্ঠিত হবে দ্বাদশ সাধারণ নির্বাচন। এখন চলছে বিভিন্ন স্থানীয় সরকার নির্বাচনের প্রস্তুতি। নির্বাচনকেন্দ্রিক রাজনীতিতে দলীয় প্রার্থী মনোনয়ন একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। যেহেতু এখন স্থানীয় সরকার নির্বাচনেও দলীয় প্রতীকের ব্যবহার শুরু হয়েছে। তাই স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীর মনোনয়ন আগামী সাধারণ নির্বাচনে প্রভাব বিস্তার করবে।
সাধারণ দৃষ্টিতে ভোটের মাধ্যামে জয়ী হয়ে সরকার গঠনের মতো সাংগঠনিক সক্ষমতা আওয়ামী লীগ ও বিএনপি ব্যতীত আর কোন দলের নাই। ২০০৮ এর নির্বাচনের পর বিএনপিও তার সাংগঠনিক শক্তি অনেকাংশেই হারিয়ে ফেলেছে। ১৩ বছরে তাদের কর্মকাণ্ডই মূলত তাদের এই অবস্থার জন্য দায়ী। স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীদের মনোনয়ন দেওয়া বন্ধ রেখে তারা রক্ষণাত্মক রাজনীতির পথে হাঁটছে। তাই আমরা আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রক্রিয়া নিয়ে আলোচনা করতে পারি।
২০০৮ এর নির্বাচনে জোটবদ্ধ আওয়ামী লীগের ভূমিধ্বস বিজয়ের পর দলটি টানা তিনটি মেয়াদে রাষ্ট্র পরিচালনা করছে। বাংলাদেশের ইতিহাসে এতটা দীর্ঘ সময় কোন ব্যক্তি বা দল রাষ্ট্র পরিচালনা করে নাই। আগামী নির্বাচনেও জয়ী হয়ে দলটি আবার রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব নিতে চাইছে, এতে কোন সন্দেহ নাই। কিন্তু বর্তমান স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলীয় প্রার্থী মনোনয়নে দলটির ভূল, আগামী সাধারণ নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সক্ষমতায় হয়তো কোন চিড় ধরাতে পারে।
টানা তের বছর ক্ষমতায় থাকায় তৃণমূলের নেতৃত্বে একটা ঢিলেমী ভাব এসে যাওয়া স্বাভাবিক। বৃহৎ দল হিসাবে দলটির ভেতরে সাংগঠনিক গ্রুপিং তো রয়েছেই। এছাড়াও যুক্ত হয়েছে সুবিধালোভী ব্যক্তিদের অণুপ্রবেশ। এই সুবিধালোভী ব্যক্তিরা নিজেদের আখের গোছাতেই আওয়ামী লীগের নির্বাচনী রাজনীতিতে যুক্ত হয়ে দলটির সাংগঠনিক সক্ষমতায় চিড় ধরাচ্ছে বলে প্রতীয়মান হয়। আগামী সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ যদি সংগঠন ও জনগনের ওপর নির্ভর করে জয়ী হতে চায়, তবে বর্তমানের স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলটির উচিত হবে যোগ্য সাংগঠনিক ব্যক্তিদের মনোনয়ন দেওয়া। কিন্তু অনেকাংশেই সেই কাজটি হচ্ছে বলে মনে হচ্ছে না।
বিভিন্ন গণমাধ্যমের প্রতিদিনের খবর দেখলেই বোঝা যায় সুবিধালোভী বিতর্কিত ব্যক্তিরা অনেক জায়গাতেই মনোনয়ন পেয়ে যাচ্ছে। বঞ্চিত হচ্ছে আওয়ামী লীগের রাজপথের কর্মীরা। যারা শুধু রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন আওয়ামী লীগের কর্মী নয়, বরং আওয়ামী লীগের বিপদের দিনে রাজপথের কর্মী। পাঠক, আসুন, কিছু খবরের শিরোনামে চোখ বোলানো যাক।“বিএনপির বহিষ্কৃত নেতা নৌকার প্রার্থী, নেতা-কর্মীদের ক্ষোভ” (প্রথম আলো-১১.১১.২০২১), “নাটোরে আওয়ামী লীগ প্রার্থীর মনোনয়ন বাতিলের দাবিতে পদত্যাগের হুমকি” (প্রথম আলো-১০.১১.২০২১), “ঘোড়াশালে তৃণমূলের তালিকায় নাম না থাকা মুজাহিদ পেলেন আওয়ামী লীগের মনোনয়ন” (প্রথম আলো-৮-১০-২০২১), “কেন্দ্রে প্রার্থীর নাম পাঠানোয় অনিয়ম করলে ব্যবস্থা: কাদের” (বাংলা ট্রিবিউন-৮-১০-২০২১)। এইসব খবরে আশংকা জাগে সাধারণ নির্বাচনের দুই বছর আগের এই স্থানীয় সরকার নির্বাচনের মনোনয়ন ঘিরে আওয়ামী লীগের তৃণমূলের শক্তি দুর্বল করে দেয় কিনা।
দেশজুড়ে ইউপি নির্বাচনের পাশাপাশি কিছু পৌরসভার নির্বাচনও অনুষ্ঠিত হচ্ছে। গত ৭ অক্টোবর দশটি পৌরসভার দলীয় প্রার্থীর মনোনয়ন দেয় আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় মনোনয়ন বোর্ড, যার মধ্যে নীলফামারী জেলার ডোমার পৌরসভাও রয়েছে। ডোমার পৌরসভায় মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে গনেশ কুমার আগরওয়ালকে, যার নাম তৃণমূল থেকে পাঠানো প্রার্থী তালিকায় ছিল না। ডোমারের আওয়ামী লীগ সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলো এই মনোনয়নে বিষ্মিত। গনেশ কুমার আগরওয়ালা তার দলীয় পরিচয়ে উল্লেখ করেছেন তিনি উপজেলা যুবলীগের নেতা এবং উপজেলা ছাত্রলীগের প্রাক্তন সহ-সভাপতি। কিন্তু তার সময়ের ডোমার ছাত্রলীগের কোন নেতাকর্মীই তাকে ছাত্রলীগের কর্মী হিসাবে চেনেন না। ডোমারের রাজনৈতিক ইতিহাসে তার কিংবা তার পরিবারের কারোরই আওয়ামী লীগের সাথে কোন রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা কখনোই ছিল না। বরং বরাবরই তার পরিবার আওয়ামী লীগের বিরোধীপক্ষ হিসাবেই পরিচিত। গণেশ কুমার আগরওয়ালার পিতা বানোয়ারি লাল আগরওয়ালা ডোমারের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী বিএনপির রাজনীতির সাথে যুক্ত।
২৩.০৬.১৯৯২ সালে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মতিন চৌধুরী ডোমারে গেলে ডোমার বহুমুখি উচ্চ বিদ্যালয়ে উপজেলা বিএনপি আয়োজিত জনসভায় মন্ত্রীকে ফুলের তোড়া উপহার দিয়ে বওয়ারি লাল আগরওয়ালা বিএনপিতে যোগদান করেন এবং মন্ত্রী তার বাড়িতে আতিথ্য গ্রহণ করেন। পরবর্তীতে ২০০১-২০০৬ মেয়াদে বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট সরকারের মন্ত্রী, জামায়াত নেতা যুদ্ধাপরাধী মতিউর রহমান নিজামী ডোমার গেলে তার বাড়িতে আতিথ্য গ্রহণ করেন।
এছাড়াও ১৯৯৬ আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকার সময় তৎকালীন ডোমার ছাত্রদল নেতা আসাদুজ্জামান চয়ন ও আবুল কালাম আজাদের নেতৃত্বে বিএনপির সমর্থকরা আওয়ামী লীগের অফিস ভাংচুর করে এবং বঙ্গবন্ধু ও মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ছবির অবমাননা করে। এই ঘটনায় আওয়ামী লীগ নেতা তোফায়েল আহমেদ (বর্তমান ডোমার উপজেলা চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক) বাদী হয়ে থানায় মামলা দায়ের করেন (মামলা নং-০৬, তারিখ: ২৯.০৭.১৯৯৬, জি আর নং- ৪৬/৯৬)। এই মামলার অন্যতম আসামী গণেশ কুমার আগরওয়ারের বড় ভাই গোবিন্দ কুমার আগরওয়ালা। কথিত আছে, গণেশ কুমার আগরওয়ালা টাকার বিনিময়ে ডোমার উপজেলা যুবলীগের কমিটিতে নিজের নাম লেখান।
ডোমার পৌরসভার মেয়র পদে দলীয় মনোনয়ের জন্য আবেদন করেছিলেন ডোমার আওয়ামীলীগের দুইজন ত্যাগী নেতা। এনায়েত হোসেন রতন নীলফামারী জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য এবং ময়নুল হক মনু ডোমার পৌর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। দুইজনই ৮৯’র স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন, ৯৫’র সারের দাবিতে আন্দোলন, ৯৬’র অসহযোগ আন্দোলন সহ গত ৩৫ বছরে আওয়ামী লীগের সকল আন্দোলন-সংগ্রামের প্রথম সারির কর্মী। ১৯৯৫ সালে সারের দাবিতে কৃষকদের সাথে আন্দোলন করতে গিয়ে তৎকালীন বিএনপি সরকারের রোষানলে পড়ে ময়নুল কারাবরণও করেন। এমন ত্যাগী নেতাদের বাদ দিয়ে আওয়ামীবিরোধী হিসাবে পরিচিত ও অবাঙালি সংস্কৃতির পরিবারের সদস্য একজন বিতর্কিত ব্যক্তিকে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন দেওয়ার পুরো উপজেলাজুড়ে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে।
স্থানীয় সরকার নির্বাচন হলো সাধারণ নির্বাচনের পূর্বপ্রস্তুতি। আওয়ামী লীগ যদি দ্বাদশ সাধারণ নির্বাচনে সত্যিকার অর্থেই জয়ী হয়ে আবার সরকার গঠন করতে চায়, তবে তাদের উচিত হবে এইসব বিতর্কিত ব্যক্তিদের মনোনয়ন বাতিল করে দল থেকেও বহিষ্কার করা। নইলে পরবর্তীতে রাষ্ট্রের রাজনৈতিক রূপ অনেকবেশি লুপ্ত হবে। রাজনৈতিক ক্ষমতা রাজনীতিবিদের চেয়ে আমলা ও ব্যবসায়ীদের হাতে বেশি চলে যাবে। যা কোনভাবেই দেশ ও জাতির জন্য মঙ্গলজনক হবে না।
লেখকঃ সৈয়দ এরশাদুল হক মিলন
লিটলম্যাগ সম্পাদক ও
সাবেক যুগ্ম আহবায়ক
ডোমার উপজেলা ছাত্রলীগ।