
বিশ্বের ১৮০ জনেরও বেশি বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ এবং উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ শ্রীলঙ্কার আর্থিক ঋণদাতাদের কাছে দেশটির ঋণ মওকুফের জন্য আবেদন জানিয়েছেন। তবে, অনেক অর্থনীতি বিশেষজ্ঞ নিশ্চিত নন যে, এই পন্থাটি দ্বীপরাষ্ট্রটির এগিয়ে যাওয়ার সর্বোত্তম উপায়। কিন্তু আপাতত শ্রীলঙ্কার জন্য অন্য কিছু ভাবাও যাচ্ছে না।
বিশ্বব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত শ্রীলঙ্কার বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ ৫২ বিলিয়ন মার্কিন ডলারেরও বেশি। এর মধ্যে চীনের কাছ থেকে পেয়েছে ৫২ শতাংশ, জাপানের কাছ থেকে ১৯ শতাংশ এবং ভারত দিয়েছে ১২ শতাংশ। কলম্বো গত বছরের এপ্রিলে নিজেকে দেউলিয়া ঘোষণা করে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) সঙ্গে ২ দশমিক ৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের ঋণ প্রাপ্তি নিয়ে আলোচনা শুরু করে। তবে আইএমএফ ততক্ষণ ঋণ দেবে না, যতক্ষণ না তারা মনে করছে যে, দ্বীপদেশটির ঋণ শোধ করার সক্ষমতা রয়েছে।
বহুল বিক্রীত বই ‘ক্যাপিটাল’-এর লেখক থমাস পিকেটি জানিয়েছেন, হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতিবিদ দানি রডরিক, ভারতীয় অর্থনীতিবিদ জয়তি ঘোষসহ বেশ কয়েকজন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ এবং অর্থনীতিবিদ এক বিবৃতিতে সমস্ত বৈদেশিক ঋণদাতাদের দ্বারা শ্রীলঙ্কার ঋণ মওকুফ করার আহ্বান জানিয়েছেন। ‘অন্যায্য ঋণ এবং দারিদ্র্য ও বৈষম্যের অবসান’ ঘটনোর লক্ষ্যে বিশ্বব্যাপী আন্দোলন-‘ডেট জাস্টিস’-এর ক্যাম্পেইনে ওই বিবৃতি প্রকাশ করেন তারা।
বিবৃতিতে অর্থনীতিবিদরা বলেছেন, যেহেতু বেসরকারি বিনিয়োগকারীরা দুর্নীতিবাজ রাজনীতিবিদদের উচ্চ সুদে ঋণ দিয়েছে, তাই ঋণ মওকুফ করে বিনিয়োগকারীদের পরিণতি ভোগ করতে হবে। বিশেষজ্ঞরা শ্রীলঙ্কার ঋণ খেলাপিতে অবদান রাখার জন্য প্রথমেই বেসরকারি ঋণদাতাদের অভিযুক্ত করেছেন। কারণ, তারা ঋণ দেওয়ার জন্য প্রিমিয়াম চার্জ করে ‘একটি বিশাল মুনাফা’ লাভ করেছে। বেসরকারি ঋণদাতারা যেহেতু উচ্চ রিটার্ন থেকে উপকৃত হয়েছে, তাই অবশ্যই তাদের কর্মের ‘পরিণাম মেনে নিতে ইচ্ছুক’ হতেই হবে। তাদের ঋণ বাতিল করা যেতে পারে বা বাজেয়াপ্ত করা যেতে পারে। তবে সবাই এই পরামর্শের সঙ্গে একমত নন।
শ্রীলঙ্কার সেন্ট্রাল ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর ডব্লিউএ উইজেবর্ধনে বলেছেন, ঋণ মওকুফের পরিকল্পনাটি বাস্তবিকভাবে চলতে থাকলে, এটি বর্তমান বৈশ্বিক আর্থিক ব্যবস্থাকে পতনের দিকে নিয়ে যেতে পারে। তিনি বলেছেন, এটিকে সমালোচনামূলকভাবে মূল্যায়ন করা দরকার। কারণ, যদি এই সুযোগ শ্রীলঙ্কার জন্য গৃহীত হয়, তবে তা মূলত একটি নতুন বিশ্ব অর্থনৈতিক ব্যবস্থার নীলনকশা প্রদান করবে। বর্তমান অর্থনৈতিক ব্যবস্থা পরস্পর নির্ভরশীল, আন্তঃসংযুক্ত। এটা ভেঙে পড়লে পৃথিবীর অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ধ্বংস হয়ে যাবে। আপনি ভাবতে পারবেন না এরপর কী হবে। ধার করা অর্থ শাসকদের দ্বারা নষ্ট হয়েছে। তা থেকে জনগণ উপকৃত হয়নি। সেই শাসকদের ক্ষতির জন্য জবাবদিহি করা উচিত। তাদের অপরাধের জন্য তাদের বিচার করা উচিত। ঋণ মওকুফ করলে জনগণের নয় বরং দুর্নীতিবাজ স্বৈরাচারী নেতাদের উপকার হবে।
দ্বিপক্ষীয় ঋণদাতাদের জন্য মেয়াদ বাড়ানোর আহ্বান: ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর, দুই দিনের সফরে শ্রীলঙ্কায় গিয়ে বলেছিলেন, নয়াদিল্লি শ্রীলঙ্কার এগিয়ে যাওয়ার পথ পরিষ্কার করার জন্য আইএমএফকে অর্থায়নের আশ্বাস বাড়িয়েছে।
তবে, সক্রিয় ঋণদাতা হিসেবে ঋণ মওকুফের অনুরোধ চীনের মেনে নেওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। কারণ, তাহলে একই ধরনের দাবি উন্নয়নশীল বিশ্বের অন্যান্য অংশ থেকে আসতে পারে। শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক নীতিবিষয়ক থিঙ্ক ট্যাংক অ্যাডভোকাটা ইনস্টিটিউটের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ধননাথ ফার্নান্দো বলেছেন, যখন আপনি একটি দেশকে ঋণ থেকে মুক্তির অফার করেন, তখন অন্য দেশগুলোও একই মুক্তি পেতে চাইবে। তদুপরি, যেকোনো দেশের করদাতারা অন্য কোনো দেশে দেওয়া ঋণ সম্পূর্ণভাবে মওকুফ করে দিলে খুশি হবেন না। এটাই বাস্তবতা।
আইএমএফের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ক্রিস্টালিনা জর্জিয়েভা ইঙ্গিত দিয়ে বলেছেন, চীন এখনও একটি উন্নয়নশীল দেশ, তাই তারা ঋণ ফেরত পাওয়ার আশা করে। তবে, চীন সুদের হার হ্রাস বা মওকুফ করে সাহায্যের হাত বাড়াতে পারে। ঋণ মওকুফের আহ্বানকে ‘অবাস্তব’ বলে প্রত্যাখ্যান করে ফার্নান্দো বলেছেন, পাওনাদারদের শেষ পর্যন্ত ঋণ পরিশোধের কিস্তির পরিমাণ কমানো, কুপন ক্লিপিং, ঋণ পরিশোধের মেয়াদ বাড়ানো- এই তিনটি পদক্ষেপের সমন্বয়কে ভাবতে হবে। তবে, ঋণ মওকুফের বিষয়ে এখনও কোনো মন্তব্য করেনি জাপান ও ভারত।