
শিক্ষা একজন ব্যক্তিকে অজ্ঞতার অন্ধকার থেকে আলোতে নিয়ে আসে। আর নৈতিকতা মানুষের জীবনকে সুন্দর ও সমৃদ্ধ করে তোলে। এ দুটির সমন্বয় হলে একজন মানুষ সৎ, চরিত্রবান, আল্লাহভীরু, দেশপ্রেমিক ও দায়ত্বিশীল হয়ে উঠে। যার ফলে বর্তমান সমাজের জন্য নৈতিক শিক্ষা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। বিভিন্ন যুগে বিভিন্ন দেশে শিক্ষাবিদ ও দার্শনিকরা নিজস্ব চিন্তা-চেতনার আলোকে শিক্ষার বিভিন্ন ব্যাখ্যা ও সংজ্ঞা দিয়েছেন যেমনঃ দার্শনিক সক্রেটিসের মতে, ‘‘শিক্ষা হল মিথ্যার অপনোদন ও সত্যের আবিষ্কার’’ দার্শনিক প্লেটোর মতে, ‘‘শিক্ষা হচ্ছে সেই শক্তি, যার দ্বারা সঠিক সময়ে আনন্দ ও বেদনার অনুভূতিবোধ জন্মায়। এটি শিক্ষার্থীর দেহে ও মনে সকল সুন্দর ও অন্তর্নিহিত শক্তিকে বিকশিত করে তোলে’।
দার্শনিক এরিস্টটলের মতে, ‘‘সুস্থ দেহে সুস্থ মন তৈরি করাই হচ্ছে শিক্ষা। শিক্ষা দেহ-মনের সুষম এবং পরিপূর্ণ বিকাশের মাধ্যমে ব্যক্তির জীবনের প্রকৃত মাধুর্য ও পরম সত্য উপলব্ধিতে সহায়তা করে’’। শিক্ষাবিদ কমেনিয়াসের মতে, ‘‘শিক্ষা হচ্ছে মানুষের নৈতিক উন্নতির সাহায্যে ইহলোক ও পরলোকের জন্য পূর্ণ প্রস্তুতি। শিক্ষার সাহায্যে মানুষ নিজকে ও বিশ্বকে জানতে পারে’’।
শিক্ষা ও নৈতিকতা, মুদ্রার এপিঠ ওপিঠের মত। মানবিক নৈতিকতা ছাড়া শিক্ষা কুশিক্ষার নামান্তর, যা মানুষকে পশুর চেয়েও নিম্নস্তরে নামিয়ে ফেলে। আর মানবিক নৈতিকতাপূর্ণ শিক্ষা মানুষকে সৃষ্টির শ্রেষ্ঠত্বের মযার্দায় অধিষ্ঠিত রাখে। শিল্পের জন্য শিল্প যেমন জীবনের কোন প্রয়োজন মেটায় না তেমনি শিক্ষার জন্য শিক্ষা মানুষকে মনুষ্যত্ব নিয়ে গড়ে উঠতে সহায়তা করে না। স্তর ভিত্তিক জীবনের বিকাশে এ শিক্ষা কোন কাজে আসে না।
যে শিক্ষা মানুষকে অন্যের পাশে দাঁড়াতে উদ্বুদ্ধ করেনা, যে শিক্ষা মানুষকে ভীরুতাকে জয় করতে শিখায় না, যে শিক্ষা জীবনে ও মরণে আলো দিতে পারে না, যে শিক্ষা মানুষকে মূল্যবোধ বিসর্জন দিয়ে স্বার্থপরতায় অন্ধ করে তোলে, যে শিক্ষা মানুষকে উগ্র ইন্দ্রিয়সুখের জন্য হত্যার কারণ তৈরি করে, যে শিক্ষা সতীর্থকে নির্মমভাবে খুন করতে উদ্বুদ্ধ করে, যে শিক্ষা ভালবাসার কবর রচনা করে ঘৃণাকে উসকে দিয়ে হিংসা হানাহানির প্রসার ঘটায়, যে শিক্ষা ঐক্যের পরিবর্তে শুধু বিভেদই বাড়ায়, আজ সর্বত্র সে শিক্ষার প্রচার ও প্রসার। এই হচ্ছে বস্তুবাদী শিক্ষার দৃষ্টান্ত।
মানবিক নৈতিকতাপূর্ণ শিক্ষাও বস্তবাদী শিক্ষায় পরিণত হতে পারে যদি সে নৈতিকতার প্রয়োগকে পাশ কাটিয়ে চলা হয়, স্বার্থের দ্বন্দ্বে মানবিক নৈতিকতাকে বিসর্জন দেয়া হয়। মানবিক নৈতিকতাপূর্ণ শিক্ষাও অর্থহীন হয়ে পড়ে যদি তা বাস্তবে অনুসৃত না হয়। আর মানবিক নৈতিকতার শিকড় হচ্ছে ‘‘কথা ও কাজে মিল’’ রাখা। কথা ও কাজে মিল থাকা ঈমানের অন্যতম প্রকাশ। কথা ও কাজে যার মিল নেই, তার ভেতরে সত্যিকার অর্থে কোন মানবিক নৈতিকতাই নেই। শিক্ষা ও নৈতিকতা উভয়টির জন্যই শিক্ষক এক অনিবার্য প্রয়োজন।
শিক্ষক ব্যতীত শিক্ষা ও নৈতিকতা উভয়টিই অচল। তাই শিক্ষা ও নৈতিকতার প্রশ্নে শিক্ষকের ভূমিকাই মুখ্য। শিক্ষক, শিক্ষা ও নৈতিকতা এই ত্রিভুজ দিয়েই গড়ে ওঠে কোন জাতির সভ্যতার চূড়া। পৃথিবীর সকল সমাজেই এই তিন উপাদানই ছিল সভ্যতা গড়ার মূল হাতিয়ার। শিক্ষক, শিক্ষা ও নৈতিকতা নিয়ে দৃষ্টিভংগি গত ভিন্নতার কারণে ভিন্ন ভিন্ন মতামত বিকশিত হয়েছে।
নৈতিকতা শব্দটির ইংরেজি Morality। যার অর্থ হলো ভদ্রতা, চরিত্র, উত্তম আচরণ। এটি মূলতঃ ভালো-মন্দ,উচিত-অনুচিত, ন্যায় অন্যায়, ঠিক – বেঠিক, আসল – নকল এর পার্থক্যকারী। নৈতিকতার উদাহরণ হলোঃ “আমার উচিত অন্যের সাথে সেভাবেই আচরণ করা যেমনটা আমি নিজে আরেকজনের নিকট থেকে আশা করি।”
নৈতিকতাকে ন্যায্যতা কিংবা সঠিকতাও বলা যেতে পারে। ন্যায় কে ন্যায় , অন্যায় কে অন্যায়, সাদা কে সাদা, কালো কে কালো বলাও নৈতিকতা। অপরদিকে, অনৈতিকতা হলো নৈতিকতারই সম্পূর্ণ বিপরীত। ন্যায় কে ন্যায়, অন্যায় কে অন্যায়, সাদা কে সাদা কিংবা কালো কে কালো বলতে না পারা। যা অসচেতনতা, অবিশ্বাস, উদাসীনতারই বহিঃপ্রকাশ
নৈতিকতার অভাবে দেশ ও জাতির উন্নতি ব্যাহত হয়। যোগ্য ব্যাক্তিরা যোগ্য স্থানে পৌঁছাতে পারে না।অযোগ্যদের আস্ফালন বৃদ্ধি পায়। যোগ্য ব্যাক্তিরা হীনমন্যতায় ভোগে। সমাজ তথা দেশে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। নৈতিক শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা বা গুরুত্ব অপরিসীম।
নৈতিক শিক্ষা হতে হবে পরিবার থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ পর্যন্ত। শিশুদের কে ভবিষ্যতের সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার দায়িত্ব আমাদের সবার। এই নৈতিক শিক্ষার মধ্যে রয়েছে সৌজন্যতাবোধ, গুণাবলীর বিকাশ, নম্রতা, শৃঙ্খলতা, আত্মনিয়ন্ত্রণ, সহানুভূতি, দয়া-মায়া, সাহসিকতা, দেশপ্রেম, মানবপ্রেম, কঠোর পরিশ্রম, ধৈর্য ও আরও অন্যান্য।
একমাত্র নৈতিক শিক্ষাই মানুষের মধ্যে দেশপ্রেমের গভীর অনুভূতি তৈরি করতে পারে। দেশের প্রতি ভালোবাসা গড়ে তুলতে গেলে প্রত্যেকের মধ্যে ব্যক্তিগত মূল্যবোধ গড়ে তোলাও জরুরি।
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে র্যাগিং একটি অলিখিত বিষয়। র্যাগিং এর বিধান কোথাও নেই তথাপি নতুন ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীদের অধিকাংশই এই টার্মের সাথে পরিচিত হয়েছে।ভর্তি পরীক্ষার সময় থেকে শুরু হয়ে ক্লাস শুরর পরেও অর্থাৎ ১ম সেমিস্টার পর্যন্ত র্যাগিং নামক অপসংস্কৃতির চর্চা দেখা যায় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে।বিশ্ববিদ্যালয়ে র্যাগিং একটি অলিখিত বাধ্যতামূলক বিধান। এবং এটাও উল্লেখ্য, গ্রামের সহজ সরল ছেলেরা অধিক পরিমাণে র্যাগিং এর শিকার হয়ে থাকে।বিশ্ববিদ্যালয়ে র্যাগিং একটি অলিখিত বাধ্যতামূলক বিধান। এবং এটাও উল্লেখ্য, গ্রামের সহজ সরল ছেলেরা অধিক পরিমাণে র্যাগিং এর শিকার হয়ে থাকে।র্যাগিং কে কিভাবে প্রতিরোধ করা যায়, কিভাবে এ অপসংস্কৃতির মোড়ক থেকে নতুন ছেলেমেয়েদের দূরে রাখা যায় সে ব্যাপারে প্রত্যেককেই নিজ নিজ জায়গা থেকে সচেতন ও মানবিক গুণসম্পন্ন হতে হবে।
সদা সত্য কথা বলা, সাহসী হওয়া, সম্পত্তির অপচয় বন্ধ করা, প্রতারণা না করা, আমি যেমন ব্যবহার পেতে চাই,অন্যদের সাথেও তেমন ব্যবহার করা, কাউকে অযথা বিচার না করা, অঙ্গিকার রক্ষা করা, উদার হওয়া, নম্র হওয়া, ভিন্নতার প্রতি সহনশীল হওয়া, নিজের ও অন্যদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া, ক্ষমাশীল হওয়া, সৎ হওয়া ইত্যাদি।
শিক্ষা ক্ষেত্রে নৈতিক শিক্ষাকে এমনভাবে যোগ করতে হবে যাতে এই নৈতিক মূল্যবোধের বার্তা শিক্ষার্থীদের নিকট আরও সহজ, সরল ও আকর্ষণীয় উপায়ে পৌঁছানো যেতে পারেএর জন্যে ভালো বই, নৈতিকতা সম্পন্ন শিক্ষক নিয়োগ, সাহিত্য, চলচ্চিত্র, ও অন্যান্য মাধ্যমও ব্যবহার করা যেতে পারে। মানুষের জীবনে নৈতিকতা, শৃঙ্খলা, ও মর্যাদা প্রদানের জ্ঞান থাকলে তার ব্যক্তিগত জীবন থেকে শুরু করে সমাজ এমনকি দেশের শান্তিও বিরাজমান থাকবে।
বর্তমান সমাজে ছাত্রছাত্রীদের নৈতিক শিক্ষা একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। যা, তাদের মনে মূল্যবোধ স্থাপন করার সাথে সাথে কীভাবে অন্যের সাথে আচরণ করতে হয় তাও শেখাতে সাহায্য করে। তাছাড়াও, তাদের নৈতিক শিক্ষার মানে জানা ও বুঝতে পারাটাও কিন্তু ততটাই জরুরি।
ভোগবাদী বিশ্বে নৈতিকতার অবক্ষয় ঘটছে প্রতিনিয়ত অথচ অনাগত ভবিষ্যৎকে সফল ও সুন্দর করে তুলতে নৈতিকতার চর্চা ছাড়া কোন উপায় নেই কেবল শিক্ষায় পারে যথার্থ নৈতিকতা সম্পন্ন মানুষ তৈরি করতে শিক্ষার সাহায্যে মূল্যবোধের ভিত্তিকে সুদ্রিয় করার মধ্যে দিয়ে ব্যক্তি দেশ ও সমাজের কল্যাণ সাধন সম্ভব হলে আমাদের শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে এবং সুশিক্ষা সম্পূর্ণ নৈতিকতার সাহায্যে মানবিকতার উদ্বোধন ঘটিয়ে নিষ্কলুষ বিশ্ব নির্মাণে পথে অগ্রসর হতে হবে।
লেখক: উপাচার্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়