পিরোজপুর-১ আসনে টানা দ্বিতীয়বারের মতো
ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী শ ম রেজাউল
করিম। কিন্তু আসনটিতে সাবেক সমালোচিত সংসদ সদস্য ও জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এ কে এম
এ আউয়াল সম্পূর্ণ পারিবারিক সিদ্ধান্তে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন। এরপর থেকেই উত্তপ্ত
হয়ে উঠেছে রাজনীতির মাঠ। সংসদ সদস্য শ ম রেজাউল করিম সমর্থকদের প্রকাশ্যে হুমকি ধমকির
মাধ্যমে ভোটের মাঠে অবৈধ প্রভাব বিস্তারে মরিয়া হয়ে উঠেছে আউয়ালের লোকজন। এমনকি নৌকা
প্রতীকের পক্ষে মাঠে নামলে হাত পা কেটে ফেলা হবে বলেও নানাভাবে ভয়ভীতি প্রদর্শন করা
হচ্ছে বলেও বলাবলি হচ্ছে।
শুধু তাই নয়, ভাঙচুর করার পাশাপাশি তান্ডব
চালানো হয়েছে পিরোজপুরের শাড়ির তলা ডুমরিতলা নামক ইউনিয়নে নৌকা প্রতীকের প্রার্থীর
অফিস। বাদ যায়নি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও নৌকা প্রতীকের
প্রার্থী শ ম রেজাউল করিমের ছবিও।
সন্ত্রাসী কায়দায় এসব অপকর্ম করেছেন আউয়ালের
অনুসারী স্বেচ্ছাসেবক দলের শ্রম বিষয়ক সম্পাদক লালন ফকির, এমন অভিযোগ উঠেছে। এ ঘটনায়
ক্ষুব্ধ নৌকা সমর্থকদের সঙ্গে সংঘর্ষে প্রাণ হারিয়েছেন স্বেচ্ছাসেবক দল নেতা লালন ফকির।
আলাপচারিতা চলছে, মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিমকে ‘বিতর্কিত’ করতে স্বেচ্ছাসেবক
দলের নেতার মৃত্যুকে আওয়ামী লীগ কর্মী হিসেবে অপপ্রচারের মাধ্যমে ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের
অপচেষ্টা চলছে পুরোদমে। স্থানীয়ভাবে ‘পিস্তল লালন’ হিসেবে পরিচিত
বিএনপির একজন ক্যাডারের জন্য মহল বিশেষের বাড়বাড়ন্ত অপকৌশল জনমনে ঘৃণা-ক্ষোভ ও তীব্র
অসন্তোষ তৈরি করেছে। সেই ক্ষোভের অনল ছড়িয়ে পড়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও।
পিরোজপুর প্রেসক্লাবের সদ্য সাবেক সাধারণ
সম্পাদক ও চ্যানেল আই’র প্রতিনিধি ফসিউল ইসলাম বাচ্চু এক ফেসবুক
স্ট্যাটাসে স্বেচ্ছাসেবক দল নেতা লালন ফকিরের জন্য আওয়ামী লীগের মিছিল নিয়ে প্রশ্ন
তুলেছেন। সামাজিক মাধ্যমে এমন আরো স্ট্যাটাস ছড়িয়ে পড়েছে।
শ
ম রেজাউল করিম ও আউয়ালের বিরোধের সূত্রপাত যেভাবে:
দীর্ঘদিন পিরোজপুরের আওয়ামী লীগের রাজনীতির
একক নিয়ন্ত্রক ছিলেন স্থানীয় জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এ কে এম এ আউয়াল ওরফে সাইদুর
রহমান। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে তিনি পিরোজপুর-১ আসনের সংসদ সদস্য ছিলেন। কিন্তু
নানা অনিয়ম-দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির কারণে গত সংসদ নির্বাচনে তিনি দলীয় মনোনয়ন হারান।
নৌকা প্রতীক নিয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন সাবেক কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ নেতা শ ম রেজাউল
করিম। এরপর তিনি প্রথমে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রী ও পরবর্তীতে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ
মন্ত্রীর দায়িত্ব পান। বিষয়টিকে স্বাভাবিকভাবে নিতে পারেননি এ কে এম এ আউয়াল। সেই থেকে
শুরু বিরোধের। কিন্তু সংসদ সদস্য হিসেবে গত ৫ বছর এলাকায় ব্যাপক উন্নয়ন কর্মযজ্ঞ চালিয়ে
যান শ ম রেজাউল করিম। অমায়িক বিনয়ী আচরণ ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি নিয়ে স্থানীয়
ভোটারদের মন জয় করেন। এক সময় আউয়ালের ভাই পৌর মেয়র হাবিবুর রহমান মালেক মন্ত্রীর বলয়ে
চলে আসেন। যদিও পরবর্তীতে তাদের পারিবারিক বিরোধ নিষ্পত্তি হয়ে যায়।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে শ ম রেজাউল
করিমের নৌকার মনোনয়ন ঠেকাতে আদাজল খেয়ে মাঠে নামে আউয়াল পরিবার। কিন্তু দলীয় প্রধান
শেখ হাসিনা পুনরায় তাঁর ওপর আস্থা রাখায় মাথায় হাত পড়ে তাদের। দুর্নীতিসহ নানা অভিযোগে
ভাবমূর্তি তলানিতে থাকা আউয়াল এবারও আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাননি। ২০২১ সালের বুধবার
(২০ জানুয়ারি) সরকারি খাস জমি দখলের অভিযোগে সাবেক সংসদ সদস্য এ কে এম এ আউয়াল এবং
তার স্ত্রী লায়লা পারভীনের বিরুদ্ধে করা তিন মামলায় অভিযোগপত্র দায়ের করেছিল দুর্নীতি
দমন কমিশন (দুদক)। এসব মামলার বিচারও চলছে।
জানা যায়, দলীয় মনোনয়ন না পেয়ে পারিবারিক
সিদ্ধান্তেই সাবেক সংসদ সদস্য এ কে এম এ আউয়াল এবার স্বতন্ত্র প্রার্থী হন। এ সময় স্থানীয়
চিহ্নিত সন্ত্রাসী ও মাদকসহ বিভিন্ন মামলা আসামিদের জার্সি বদলের মাধ্যমে রাতারাতি
আওয়ামী লীগ বনে যাওয়ার সুযোগ করে দেন বলেও মাঠে নানান কথা শোনা যাচ্ছে। বেপরোয়া পক্ষটি
উস্কানিমূলক কথাবার্তার মাধ্যমে ভোটের মাঠকে অশান্ত করে তুলেছেন।
মনোনয়নপত্র দাখিলের দিন গত ৩০ নভেম্বর
নাজিরপুরে সমর্থকদের উদ্দেশ্যে বক্তৃতায় এ কে এম এ আউয়ালের ভাই পৌর মেয়র হাবিবুর রহমান
মালেক প্রকাশ্যে হুমকি দিয়ে বলেন, তাদের কর্মীদের দিকে কেউ গরম চোখে তাকালে তিনি তাদের
চোখ উপড়ে ফেলবেন। তাঁর আক্রমণাত্মক বক্তব্যে তীব্র উত্তেজনা তৈরি হয়। পিরোজপুর পৌর
এলাকায় আউয়ালের সমর্থনে একটি সভায় জেলা পরিষদের সাবেক সদস্য রফিকুল ইসলাম সুমন প্রকাশ্যে
ঘোষণা দেন- ‘নৌকার কোন অফিস এবং কোন এজেন্ট পিরোজপুরে দিতে দেয়া
হবে না।’ ইন্দুরকানী উপজেলায়
আউয়াল সমর্থক কর্মী সাঈদ মহরি প্রকাশ্যে বলেন, ইন্দুরকানি উপজেলায় আউয়াল পরিবারের বাইরে
কাউকে নির্বাচনে আসতে বা ভোট নিতে অথবা দিতে দেয়া হবে না। এছাড়া শহরে বিভিন্ন স্থানের
জনসভায় আউয়াল পরিবারের সমর্থক পৌর কাউন্সিলর সাদুল্লাহ লিটন, রাজু, রেজাউল করিম মন্টু,
শ্রমিক লীগ কর্মী সাঈদ নৌকার প্রার্থী শ ম রেজাউল করিমকে বিভিন্নভাবে অশ্লীল আশ্রাব্য
ভাষায় গালিগালাজ করে হুমকি দেন। এসব বক্তব্যের ভিডিও ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে। এ নিয়ে নৌকা
সমর্থকদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি হয়।
অভিযোগ রয়েছে, শ ম রেজাউল করিমের সমর্থকদেরকে
পিরোজপুরের পৌর মেয়র হাবিবুর রহমান মালেক এবং এ কে এম এ আউয়াল ফোন করে নৌকা প্রতীকের
পক্ষে মাঠে নামলে হাত পা কেটে ফেলা ও প্রাণনাশের হুমকি দেন। এ বিষয়ে নৌকা প্রতীকের
সংগঠক ইন্দুরকানি উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মনিরুজ্জামান মৃধা এবং
বীর মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আব্দুল লতিফ নির্বাচন অনুসন্ধান কমিটি, পিরোজপুরে রিটার্নিং
অফিসারসহ বিভিন্ন পর্যায়ে লিখিত আবেদন করে জীবনের নিরাপত্তা চান। তাদের এই অভিযোগের
তদন্ত করেন অনুসন্ধানের দায়িত্বপ্রাপ্ত পিরোজপুরের যুগ্ম জেলা জজ। সাক্ষ্য প্রমাণে
এই অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যায়। অপরদিকে নৌকা প্রতীকের প্রার্থী শ ম রেজাউল করিম বিভিন্ন
স্থানে লিখিত অভিযোগ করে তার কর্মীদের বিরুদ্ধে স্বতন্ত্র প্রার্থীর সহিংস হুমকি, মারধরসহ
বিভিন্ন রকম নির্বাচনী আচরণ বিধি পরিপন্থী কর্মকান্ড অবহিত করেন। প্রতিকার দাবি করেন
তিনি। তবে এ বিষয়ে স্থানীয় প্রশাসনের রহস্যময় নীরবতা জনমনে প্রশ্নবোধক।
একাধিক
মামলার আসামি ছিলেন ‘পিস্তল লালন’:
পিরোজপুর জেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের শ্রম
বিষয়ক সম্পাদক ছিলেন লালন ফকির। এই কমিটির কাগজ ঘুরছে ফেসবুকের ওয়ালে ওয়ালে। গত ১০
ডিসেম্বর নৌকার অফিস ভাঙচুরের ঘটনায় দু’পক্ষের সংঘর্ষে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা
যান লালন।
স্থানীয়ভাবে
‘পিস্তল লালন’ নামে পরিচিত লালন ফকির:
অবরোধকালীন সময়ে গত ১৯ জুলাই পিরোজপুরে
বিএনপির সহিংসতার ঘটনায় দায়ের করা বিস্ফোরক দ্রব্য আইনের ১৩/১৬৪ নং মামলার এজাহারভুক্ত
৭৪ নম্বর আসামি। এই মামলার বাদি পিরোজপুর সদর থানার এসআই মাকসুদুর রহমান। ২০১৪ সালের
নির্বাচনের আগে বিভিন্ন স্থানে অগ্নিসংযোগ ও সন্ত্রাসী ঘটনায় লালন ফকির ও নিজাম ফকিরের
নেতৃত্বে শারিকতলা ডুমুরিতলা এলাকায় ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি করা হয়েছিল বলে বিশেষ
রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়। ২০২২ সালের ৫ এপ্রিল পিরোজপুরে ক্রিস্টাল মেথ আইসসহ গ্রেফতার
হয়েছিল লালন। দীর্ঘদিন কারাগারে থেকে জামিনে মুক্তির পর তিনি দলীয় জার্সি বদল করে স্বতন্ত্র
প্রার্থী এ কে এম এ আওয়ালের ভাই পিরোজপুরের পৌর মেয়র হাবিবুর রহমান মালেকের ‘অনুসারী’ বনে যান। লালন
ডাইং ডিক্লারেশন/মৃত্যুকালীন জবানবন্দিতে ৩ থেকে ৪ জন ব্যক্তি দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার
কথা উল্লেখ করেছেন। তবে তাকে আওয়ামী লীগের কর্মী হিসেবে চালিয়ে দেয়ার মাধ্যমে মন্ত্রী
শ ম রেজাউল করিমকে নতুন করে হেনস্থা করার অপপ্রয়াসের মাধ্যমে ঘৃণ্য রাজনীতির ধারাবাহিকতা
চলছে বলেও অভিযোগ করেছেন মন্ত্রীর অনুসারীরা।