১ ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হয়েছে বাঙালির প্রাণের ভাষার মাস। ১৯৫২ সালে ফেব্রুয়ারি মাসে ভাষা শহিদের আত্মদানের মধ্য দিয়ে আমরা অজর্ন করেছিলাম মায়ের মুখের ভাষা, রক্তদিয়ে কেনা আমার বর্ণমালা।
১৯৪৮ সালের ২১শে মার্চ, ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে - (যা এখন সোহরাওয়ার্দি উদ্যান)। এখানে এক ভাষণে পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল, গণপরিষদের সভাপতি এবং মুসলিম লিগে সভাপতি মোহাম্মদ আলি জিন্নাহ স্পষ্ট করে বলেছিলেন, পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় ভাষা হবে উর্দু - অন্য কোন ভাষা নয়। ইংরেজিতে দেয়া সেই বক্তৃতায় তিনি বলেছিলেন, ‘আমি খুব স্পষ্ট করেই আপনাদের বলছি যে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু, এবং অন্য কোন ভাষা নয়। কেউ যদি আপনাদের বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করে তাহলে সে আসলে পাকিস্তানের শত্রু‘।
কয়েকদিন পর মোহাম্মদ আলি জিন্নাহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে ছাত্রদের সামনে আরো একটি ভাষণ দিলেন। সেখানেও একই কথা বললেন তিনি। বললেন, পাকিস্তানের প্রদেশগুলো নিজেদের সরকারি কাজে যে কোন ভাষা ব্যবহার করতে পারে - তবে রাষ্ট্রীয় ভাষা হবে একটিই এবং তা হবে উর্দু। কার্জন হলে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার কথা বলার পর কয়েকজন ছাত্র ‘না ‘ ‘না’ বলে চিৎকার করে প্রতিবাদ করেছিলেন - যা জিন্নাহকে কিছুটা অপ্রস্তুত করেছিল।
পাকিস্তানের প্রথম গণপরিষদের অধিবেশন বসেছিল - ১৯৪৮ সালের ২৫শে ফেব্রুয়ারি। তাতে গণপরিষদে কার্যক্রমে উর্দু ও ইংরেজির পাশাপাশি বাংলা ভাষাও যেন ব্যবহৃত হতে পারে - এমন এক প্রস্তাব উত্থাপন করেছিলেন কংগ্রেস দলীয় সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত। তাঁর যুক্তি ছিল - পাকিস্তানের ৬ কোটি ৯০ লক্ষ লোকের মধ্যে ৪ কোটিরও বেশি লোকের ভাষা বাংলা - অর্থাৎ সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ভাষাই বাংলা। তাই বাংলাকে পাকিস্তানের একটি প্রাদেশিক ভাষা হিসেবে দেখা উচিত নয়, বাংলারও হওয়া উচিত অন্যতম রাষ্ট্রভাষা। কিন্তু তাঁর এ সংশোধনীর প্রস্তাব গণপরিষদে টেকেনি। ২৫ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত আলোচনায় প্রধানমন্ত্রী তীব্র ভাষায় এ প্রস্তাবের বিরোধিতা করেন। দুঃখের বিষয়, মুসলিম লীগ দলের কোনো বাঙালি সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্তকে সমর্থন করে কথা বলেননি। পূর্ব পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিনও উর্দুর পক্ষ অবলম্বন করেন। ১১ মার্চ গণপরিষদে প্রস্তাব পাশ হয়, উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। এর প্রতিবাদে ঢাকায় ছাত্ররা ক্লাস বর্জন ও ধর্মঘট করে। ১১ই মার্চ ১৯৪৮ সালে পূর্ব বাংলায় পালিত হয় ‘ভাষা দিবস’।
১১ মার্চ ‘বাংলা ভাষা দাবি দিবস’ উপলক্ষ্যে পূর্ব বাংলায় সাধারণ ধর্মঘট পালিত হয়। ওইদিন ভোরবেলা শত শত ছাত্র ইডেন বিল্ডিং, জিপিও ও অন্যান্য জায়গায় পিকেটিং শুরু করে। সমগ্র ঢাকা শহর পোস্টারে ভরে যায়। ছাত্রদের আন্দোলনে পুলিশ লাঠিচার্জ করে। নানা জায়গায় অনেক ছাত্র আহত হয়। শামসুল হক, শেখ মুজিবুর রহমান, অলি আহাদসহ সত্তর-পঁচাত্তরজন ছাত্রকে গ্রেপ্তার করা হয়। এর ফলে আন্দোলন দানা বেঁধে ওঠে। স্বাধীন পাকিস্তানে এটিই শেখ মুজিবের প্রথম গ্রেপ্তার। দুজন মন্ত্রীকে পদত্যাগপত্র স্বাক্ষর করতে বাধ্য করেন বিক্ষোভকারীরা, পূর্ব পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজ নাজিমুদ্দিনকে গণপরিষদ ভবন থেকে বের করে নিতে সেনাবাহিনী ডাকতে হয়েছিল। এই নেতাদের গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে ১৩-১৫ই মার্চ ঢাকায় ধর্মঘটও পালিত হয়েছিল।
তখন পূর্ব পাকিস্তান আইনসভার অধিবেশন চলছিল। এ সময় শেরেবাংলা একে ফজলুল হক, বগুড়ার মোহাম্মদ আলী, তোফাজ্জুল আলী, ডা. মালেক, খান এ সবুর, খয়রাত হোসেন, আনোয়ারা খাতুন এবং আরও অনেক সদস্য ছাত্রদের পুলিশ কর্তৃক মারধর ও জেলে পাঠানোর প্রতিবাদ করেন। নাজিমুদ্দিন সাহেব ঘাবড়ে গেলেন এবং সংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে আলাপ করতে রাজি হলেন। ছাত্রনেতাদের সঙ্গে নাজিমুদ্দিন সরকারের আলোচনার পর উভয়পক্ষ মিলে একটি সমঝোতা চুক্তি প্রণয়ন করে। বিশিষ্ট ছাত্রনেতারা জেলে থাকায় চুক্তিপত্রটি তাদের অনুমোদনের জন্য অধ্যাপক আবুল কাশেম ও কামরুদ্দিন আহমেদ গোপনে জেলে নিয়ে যান এবং শামসুল হক, শেখ মুজিবুর রহমান ও অলি আহাদ বন্দিদের পক্ষে খসড়া চুক্তির শর্তাবলি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে অনুমোদন করেন।
চুক্তির প্রধান প্রধান শর্ত ছিল-বন্দিদের মুক্তি, পুলিশি নির্যাতনের প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক তদন্ত, বাংলা ভাষাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা ও শিক্ষার মাধ্যম হিসাবে গ্রহণ করার জন্য পূর্ব পাকিস্তান সরকারের পক্ষ থেকে প্রস্তাব উত্থাপন, সংবাদপত্রের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার। আট দফা চুক্তিটি ১৫ মার্চ সরকারের পক্ষে খাজা নাজিমুদ্দিন এবং সংগ্রাম পরিষদের পক্ষে কামরুদ্দিন আহমদ স্বাক্ষর করেন। চুক্তির শর্ত মোতাবেক ১৫ মার্চ শেখ মুজিব ও অন্যান্য নেতাসহ বন্দিরা মুক্তিলাভ করেন।
আন্দোলন যাতে ঝিমিয়ে না পড়ে সেজন্য ১৬ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় ছাত্র সমাবেশ ডাকা হয়। ওই সভায় সর্বসম্মতিক্রমে সভাপতিত্ব করেন ছাত্রনেতা শেখ মুজিবুর রহমান। বিখ্যাত আমতলায় এটিই শেখ মুজিবের প্রথম সভা। তিনি আন্দোলনের কিছু দিকনির্দেশনা দেন। যেসব শর্তের ভিত্তিতে সংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে সরকারের আপস হয়েছে, সেসব মেনে চলতে হবে। তবে সভা খাজা নাজিমুদ্দিন কর্তৃক পুলিশি নির্যাতনের যে তদন্ত হবে তা মানতে রাজি নয়।
শেখ মুজিব বললেন, ‘ঠিক আছে, আমরা প্রস্তাবটি শুধু পরিবর্তন করতে অনুরোধ করতে পারি, এর বেশি কিছু না। বাংলা পাকিস্তানের শতকরা ছাপ্পান্ন ভাগ লোকের মাতৃভাষা। তাই বাংলাই একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হওয়া উচিত। তবুও আমরা বাংলা ও উর্দু দুটি রাষ্ট্রভাষা করার দাবি করেছিলাম।’ সিদ্ধান্ত হলো শোভাযাত্রা করে আইন পরিষদে গিয়ে খাজা নাজিমুদ্দিনের কাছে এ দাবিটা পেশ করে সবাই চলে আসবে। কিন্তু দিনভর অনেক ছাত্র-জনতা আইন পরিষদের কাছে দাঁড়িয়ে থাকে। পুলিশ লাঠিচার্জ করে ও কাঁদানে গ্যাস ছোড়ে। ছাত্র-জনতাকে নিবৃত্ত করতে শেখ মুজিব আবারও সেখানে ছুটে যান। শেখ মুজিবকে কাঁদানে গ্যাস ও লাঠিচার্জের মুখোমুখি হতে হয়।
১৯৪৯ সালের ১১ অক্টোবর আওয়ামী মুসলিম লীগের উদ্যোগে ঢাকার আরমানিটোলা ময়দানে অনুষ্ঠিত জনসভায় মওলানা ভাসানী, শামসুল হক ও শেখ মুজিবুর রহমান বক্তৃতা করেন। এ জনসভায় সরকারবিরোধী বক্তব্য প্রদানের অভিযোগে ৩১ ডিসেম্বর শেখ মুজিবকে গ্রেফতার করা হয় এবং একটানা ২৬ মাস তাকে রাজনৈতিক (নিরাপত্তা) বন্দি হিসাবে জেলে আটক রাখা হয়।
রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের দ্বিতীয় পর্ব শুরু হয় ১৯৫২ সালের জানুয়ারি মাসে। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হিসাবে খাজা নাজিমুদ্দিন প্রথম ঢাকায় আসেন ১৯৫২ সালের ২৫ জানুয়ারি। ২৬ জানুয়ারি পল্টন ময়দানে অনুষ্ঠিত জনসভায় তিনি ঘোষণা করেন-‘উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা।’ তার এ ঘোষণার পর ১৯৪৮ সালের চেয়েও ব্যাপক আন্দোলন শুরু হয়। ৩০ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে ধর্মঘট পালিত হয় এবং বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে সভা করে বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা কমিটি। ওইদিন সন্ধায় ঢাকা জেলা বার লাইব্রেরি মিলনায়তনে সর্বস্তরের প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। ছাত্র ও তরুণদের বাইরে এটিই প্রথম সভা, যেখানে বিশিষ্ট নাগরিক ও রাজনৈতিক নেতারা সমাবেত হন।
এ সভায় পূর্বে গঠিত রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদকে ‘সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদে’ রূপান্তরিত করা হয়। কাজী গোলাম মাহবুব এ পরিষদের আহ্বায়ক নিযুক্ত হন। তরুণ রাজনৈতিক নেতা শেখ মুজিবুর রহমান এবং মহিউদ্দিন আহমদ তখন জেলে বন্দি ছিলেন। অসুস্থতার ভান করে শেখ মুজিব মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হলেন। হাসপাতাল থেকেই তিনি গোপনে মোহাম্মদ তোয়াহা, অলি আহাদ, শওকত আলি, আবদুস সামাদ আজাদ, গোলাম মাওলা প্রমুখের সঙ্গে সভা করে জানিয়ে দেন ২১ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা দিবস পালন করা হবে, হরতাল হবে এবং অ্যাসেম্বলি ঘেরাও কর্মসূচি পালিত হবে।
এদিকে শেখ মুজিবুর রহমান ও মহিউদ্দিন আহমেদ তাদের দীর্ঘ কারাবাস (২৬ মাস) থেকে মুক্তির জন্য ১ ফেব্রুয়ারি সরকারের কাছে আবেদন করেন এবং জানান, ১৫ ফেব্রুয়ারির মধ্যে তাদের মুক্তি দেওয়া না হলে ১৬ ফেব্রুয়ারি থেকে তারা জেলের ভেতর অনশন ধর্মঘট করবেন। ১৫ ফেব্রুয়ারি তাদের দু’জনকে ঢাকা থেকে ফরিদপুর জেলে পাঠিয়ে দেওয়া হলো। শেখ মুজিব ও মহিউদ্দিন সাহেব ফরিদপুর জেলেই অনশন করলেন। দু’দিন পর অবস্থার অবনতি হলে হাসপাতালে নিয়ে তাদের জোর করে নল দিয়ে তরল খাবার দেওয়া হলো। এদিকে শেখ মুজিবুর রহমানের অনশনের বিষয়টি ২০ ফেব্রুয়ারি তদানীন্তন বঙ্গীয় আইন পরিষদের সদস্য আনোয়ারা খাতুন মুলতুবি প্রস্তাব হিসাবে উত্থাপন করলে মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিন নির্লজ্জভাবে এর বিরোধিতা করেন।
ইতোমধ্যে ঢাকায় ২০ ফেব্রুয়ারি বিকাল ৪টার দিকে মাইকে ১৪৪ ধারা জারি করে পরবর্তী এক মাস ঢাকায় সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ করা হয়। ঢাকা বেতারেও এ খবর প্রচারিত হয়। এরপরই সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের নেতারা ৯৪, নবাবপুরের আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে জরুরি সভায় বসেন। সভায় অলি আহাদ ১৪৪ ধারা ভঙ্গের পক্ষে যুক্তি দেখালেও কর্মপরিষদের সংখ্যাগরিষ্ঠ নেতা বিপক্ষে ভোট প্রদান করে। তবে ওই রাতেই ফজলুল হক হলের পুকুরপাড়ে ছাত্রনেতাদের বৈঠকে পরদিন ১৪৪ ধারা ভঙ্গের পক্ষে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। সাধারণ ছাত্র ও ছাত্রসমাজের বৃহত্তর অংশ ১৪৪ ধারা ভঙ্গের পক্ষে ছিলেন। ২১ ফেব্রুয়ারি বেলা ১০টা থেকে ছাত্ররা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে জমা হতে থাকে। বটতলায় দাঁড়িয়ে ছাত্রনেতারা বক্তৃতা দেন। বিশ্ববিদ্যালয় ভাষা কমিটির আহ্বায়ক আবদুল মতিন জ্বালাময়ী বক্তৃতায় ১৪৪ ধারা ভঙ্গের প্রস্তাব দেন। সহস্র কণ্ঠ গর্জে উঠল-১৪৪ ধারা মানব না, মানব না। সিদ্ধান্তমতে দশজন দশজন করে ছাত্র মিছিল করে অ্যাসেম্বলি ভবনের দিকে যেতে থাকে।
পুলিশ ছাত্রদের প্রথম দলটিকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায়। ছাত্ররা দলবদ্ধ হয়ে স্লোগান দিয়ে মেডিকেল কলেজ হোস্টেল, মেডিকেল কলেজ ও ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ গেট থেকে বের হতেই পুলিশ বাহিনী তাড়া করে, কাঁদানে গ্যাস ছোড়ে। বেলা প্রায় সোয়া ৩টার সময় এমএলএ ও মন্ত্রীরা মেডিকেল কলেজের সামনে দিয়ে পরিষদ ভবনে আসতে থাকেন। পুলিশ বেপরোয়াভাবে ছাত্রদের ওপর আক্রমণ চালায়। বাধ্য হয়ে ছাত্ররা ইটপাটকেল ছুড়তে থাকে। পুলিশ ছাত্রদের লক্ষ করে গুলি চালায়। ঘটনাস্থলেই রফিকউদ্দিন, আবদুল জব্বার শহিদ হন এবং আরও ১৭ জন গুরুতর আহত হন। রাতে আবুল বরকত মারা যান।
ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে পূর্ববাংলায় যে স্বাধিকার আন্দোলনের ভিত্তি রচিত হয়, তার পথ ধরেই চলতে থাকে পরবর্তী আন্দোলন-সংগ্রাম, যা ১৯৭১ সালে মুক্তির সংগ্রামে পূর্ণতা লাভ করে।