বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ হিসাবায়নে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)-এর পরামর্শ মানবে না বাংলাদেশ ব্যাংক। এখন যেভাবে এর হিসাবায়ন হচ্ছে, ভবিষ্যতেও একইভাবে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের শীর্ষ পর্যায় থেকে এ তথ্য জানানো হয়েছে।
এর আগে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের হিসাব পদ্ধতিতে পরিবর্তন আনতে একাধিকবার পরামর্শ দিয়েছিল আইএমএফ। সর্বশেষ রবিবার (১৭ জুলাই) বাংলাদেশ ব্যাংকের শীর্ষ পর্যায়ের বৈঠকেও পরিবর্তন আনার প্রস্তাব দেওয়া হয়। এছাড়া, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ধরে রাখার পরামর্শের পাশাপাশি ব্যাংকের আমানত ও ঋণের সুদহারের ওপর যে সীমা রয়েছে, তা তুলে দেওয়ার সুপারিশ করেছে সংস্থাটি।
আইএমএফের এশিয়া অ্যান্ড প্যাসিফিক বিভাগের প্রধান রুহুল আনন্দের নেতৃত্বে সফররত আইএমএফ মিশন বাংলাদেশ ব্যাংক ছাড়াও এদিন অর্থ মন্ত্রণালয়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে পৃথক বৈঠক করে। আইএমএফ স্টাফ ভিজিট মিশন-২০২২ নামে প্রতিনিধি দলটি গত বৃহস্পতিবার ঢাকা সফরে এসেছে।
সংস্থাটি বলেছে, রিজার্ভের অর্থে গঠিত ইডিএফসহ বিভিন্ন ঋণ তহবিল গঠন করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। যা এখনও রিজার্ভেই দেখানো হচ্ছে। অথচ এগুলো নন লিকুইড সম্পদ বা ইনভেস্টমেন্ট গ্রেড সিকিউরিটিজ। সংস্থাটির ব্যালেন্স অব পেমেন্ট অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল ইনভেস্টমেন্ট পজিশন (বিপিএম-৬) ম্যানুয়াল অনুযায়ী, এসব দায় রিজার্ভ হিসেবে বিবেচিত হবে না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ হিসাবায়নে আইএমএফের এ পরামর্শ মানবে না কেন্দ্রীয় ব্যাংক। নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাংলাদেশ ব্যাংকের শীর্ষ এক কর্মকর্তা বলেন, আগের ধারাবাহিকতায় রবিবারের বৈঠকেও আইএমএফ রিজার্ভের হিসাবায়ন বদলাতে বলেছে। কিন্তু আমরা বলেছি, এতদিন যেভাবে হয়েছে, সেভাবেই হবে। রফতানি উন্নয়ন তহবিল বা ইডিএফকে অ্যাসেট বলতে রাজি নয় আইএমএফ। আমরা বলছি, এটা ফরেন অ্যাসেট। তারা (আইএমএফ) অনেক কিছুই বলতে পারে। আমরা মানতে বাধ্য নই।
আইএমএফের প্রতিনিধি দলের সঙ্গে বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর আহমেদ জামাল। তিনি বলেন, আইএমএফ হিসাবায়ন নিয়ে প্রশ্ন তুললেও বাংলাদেশ ব্যাংকের মতে রিজার্ভের হিসাব ঠিক আছে। তবে রিপোর্টিং সংক্রান্ত কিছু পার্থক্য রয়েছে যা পর্যালোচনাধীন।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, আমাদের হিসাবায়ন নিয়ে আইএমএফ দ্বিমত পোষণ করতে পারে। কিন্তু কিছু চাপিয়ে দিতে পারে না। এটা নিয়ে (হিসাবায়ন) আমরা বিশ্বব্যাংকের সঙ্গেও বসবো। আগের নির্ধারিত সফরে এসে তারা রবিবার বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। এটা ছিল তাদের সৌজন্য সাক্ষাত। বৈঠকে এলসি নিয়ে কথা হয়েছে, এসএমই নিয়েও হয়েছে। কাজেই কেউ যদি বলে আইএমএফের পরামর্শে রিজার্ভের হিসাব পদ্ধতি পরিবর্তনে বাংলাদেশ ব্যাংক সম্মতি দিয়েছে, তিনি ভুল করবেন। আইএমএফ যদি বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের হিসাবায়ন নিয়ে নির্দিষ্ট সুপারিশ করেও থাকে, তাহলে এই বিষয়ে আলাদাভাবে তাদের সঙ্গে আমাদের বসতে হবে।
উল্লেখ্য, এর আগে গত বছরের ৩ থেকে ১৪ অক্টোবর আইএমএফের একটি প্রতিনিধি দল বাংলাদেশে আসে। বাংলাদেশ সফরের পর সংস্থাটির পক্ষ থেকে একটি ‘সেফগার্ড অ্যাসেসমেন্ট রিপোর্ট’ বাংলাদেশ ব্যাংকে পাঠানো হয়। সেখানে রিজার্ভ হিসাবায়নে বাংলাদেশ এবং আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের তারতম্য উল্লেখ করে ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারির মধ্যে তা নিরসন করার সুপারিশ করা হয়। এরপর গত বছরের নভেম্বরে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে সংস্থাটিকে চিঠি দিয়ে প্রাথমিকভাবে রিজার্ভের হিসাবায়ন পদ্ধতিতে পরিবর্তন না আনার সিদ্ধান্ত জানানো হয়।
সাধারণত, বাংলাদেশ ব্যাংক দুটি পদ্ধতিতে রিজার্ভ হিসাব করে। একটি গ্রস, আরেকটি নিট হিসাব। নিট হিসাবে রিজার্ভ থেকে বিভিন্ন ঋণ তহবিল বাদ দেওয়া হয়। আইএমএফের হিসাব পদ্ধতি অনুসরণ করলে দেশের রিজার্ভ প্রায় ৭ বিলিয়ন ডলার কমে ৩১ বিলিয়ন ডলারে নামবে। বর্তমানে রিজার্ভের অর্থে ইডিএফে ৭০০ কোটি, জিটিএফে ২০ কোটি, এলটিএফএফে ৩ কোটি ৮৫ লাখ এবং সোনালী ব্যাংকের মাধ্যমে পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষকে ৬৪ কোটি ডলার ও বাংলাদেশ বিমানকে ৪ কোটি ৮০ লাখ ডলার ঋণ দেওয়া হয়েছে। এই ৭৯২ কোটি ৬৫ লাখ ডলারের বাইরে কারেন্সি সোয়াপের আওতায় শ্রীলঙ্কাকে দেওয়া হয়েছে ২০ কোটি ডলার। এগুলো রিজার্ভ থেকে বাদ দিলে প্রকৃত রিজার্ভ ৩১ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়ায়।
প্রসঙ্গত, গত মে মাসে বাংলাদেশ ব্যাংকে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকেও সিদ্ধান্ত হয়, আইএমএফের হিসাব পদ্ধতি অনুসরণ না করে বিদ্যমান নিয়মেই হিসাব চালিয়ে যাওয়া হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সদ্য বিদায়ী গভর্নর ফজলে কবির ওই বৈঠকের সভাপতিত্ব করেন।