হবিগঞ্জের বানিয়াচং উপজেলার কাগাপাশা ইউনিয়নের অন্তর্গত উত্তর-পূর্ব কোনজুড়ে হিন্দু জনসংখ্যা অধ্যুষিত একটি দূর্গম গ্রামের নাম মাকালকান্দি। হাওরাঞ্চলের মধ্যখানে অবস্থিত এই গ্রামটি ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের অন্যতম ঘাঁটি। যার দরুণ পাক-হানাদার বাহিনী ও স্থানীয় রাজাকারদের নিশানায় পরিণত হয় গ্রামটি।
১৯৭১ সালের ১৫ আগস্ট তৎকালীন হবিগঞ্জ মহকুমার সার্কিট হাউসে শান্তি কমিটির সঙ্গে পাক-হানাদার বাহিনীর বৈঠকে মাকালকান্দি আক্রমণের নীল নকশা প্রণয়ন করা হয়। সেই মোতাবেক মেজর দুররানির নেতৃত্বে পাক-হানাদার বাহিনী স্থানীয় রাজাকারদের সহযোগিতায় ১৮ আগস্ট ভোররাতেই প্রায় ৪০টি নৌকাযোগে মাকালকান্দি আক্রমণের উদ্দেশ্যে রওনা হয়।
দিনটি ছিল হিন্দু সম্প্রদায়ের অন্যতম ধর্মীয় উৎসব মনষা পুজার দিন। যথারীতি গ্রামের চন্ডীমন্দিরে মনষা পুজার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন পুজারীরা। সকাল ঠিক ৯টার সময় প্রায় ৪০/৪৫টি নৌকাযোগে স্থানীয় রাজাকারদের সহযোগিতায় পাক-হানাদার বাহিনী ঘিরে ফেলে পুরো গ্রামটিকে। কিছু বুঝে উঠার আগেই শুরু হয় আক্রমণ।
চণ্ডি মন্দিরের সামনে লাইনে দাঁড় করিয়ে তরণী দাশ, দীনেশ দাশ, ঠাকুরচান দাশ, মনোরঞ্জন দাশ, প্রভাসীনী বালা দাশ, চিত্রাঙ্গ বালা দাশসহ ৪৪ জন নারী সমেত শতাধিক মানুষকে ব্রাসফায়ার করে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে-খুঁচিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। তন্মধ্যে নাম পরিচয় সনাক্ত হয় ৭৮ জন নারী-পুরুষের।
গৃহবধু মিনতি রানীর কোল থেকে তিন বছরের শিশু সন্তানকে কেড়ে নিয়ে হত্যা করে নদীতে ফেলে দিতেও হাত কাঁপেনি হানাদারদের। গণহত্যা সাঙ্গ করেই নরপিশাচের দল মেতে ওঠে নারীদের সম্ভ্রমহানী ও লুটপাটে। পরে পেট্রোল দিয়ে সব বাড়িঘরে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়।
বাড়িঘর থেকে ধান, গৃহপালিত পশু, স্বর্ণালংকার, নগদ টাকা হতে শুরু করে ঘরের পিলার পর্যন্ত লুন্ঠন করে নিয়ে যাওয়া হয় নৌকাযোগে। গণহত্যায় বেঁচে যাওয়া অনেকেই পুনরায় হামলার আশঙ্কায় ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে ভারতে পালিয়ে যায়, পথিমধ্যে ডায়রিয়া, মহামারি ও অনাহারে মারা যায় আরও প্রায় অর্ধশত নারী-পুরুষ। এখনো সেই নির্মম হত্যাযজ্ঞের ভয়াবহ স্মৃতি স্মরণ করে আতঙ্কে শিহরিত হন গণহত্যা থেকে বেঁচে যাওয়া বয়স্ক মানুষজন।
উল্লেখ্য, সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি সংসদ সদস্য এডভোকেট আব্দুল মজিদ খাঁনের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ৩৩ লক্ষ ২৫ হাজার টাকা ব্যায়ে গণহত্যায় নিহত শহীদদের স্মরণে নির্মাণ করা স্মৃতিসৌধ গত ২০২১ সালের ১৮ আগস্ট উদ্বোধন করা হয়।