ব্যবসায়ীক মন্দায় পুঁজি হারিয়ে হারাতে বসেছে পাবনার ঐত্যিহ্যবাহী পশুর চামড়া ব্যবসা। চামড়া শিল্পে সুষ্ঠু বাজার ব্যবস্থাপনা না থাকায় ট্যানারি মালিকদের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে চামড়া ব্যবসায়ীরা। বর্তমানে পশুর চামড়া ন্যায্য দামে বিক্রি করতে না পেরে অনেকে আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
একসময়ে চামড়া ব্যবসাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠা পাবনার পশ্চিম সাধুপাড়া এলাকার চামড়াপট্টিতে এখন নেই কোন আগের মত কর্ম চাঞ্চল্যতা। নেই আগের সেই পশুর চামড়ার রমরমা দিনগুলো। একসময় ঈদের দুই তিন দিন ক্রেতা বিক্রেতার ভীড়ি থাকলেও এখন আর চোখে পড়ে না। কিছু সংখ্যক ব্যবসায়ী বাপ দাদার পৈতৃক ব্যবসা হিসেবে ধরে রাখলেও শ্রমিক খরচ, লবণের দাম বৃদ্ধি, চামড়ার ন্যায্য দাম না পাওয়ায় এবং এ পেশায় লাভের সংখ্যা খুব কম হওয়ায় কোন রকমে টিকে আছে তারা। এখন চামড়াপট্টিতে বেশিরভাগ গুদাম নেই, চামড়াও নেই। চামড়ার ব্যবসা ছেড়ে এখন অনেকে অটোরিকশা চালানো থেকে শুরু করে বিভিন্ন পেশায় জীবিকা নির্বাহ করছে।
সরেজমিনে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এক সময় পশুর চামড়ার রমরমা ব্যবসা হলেও অনেক ব্যবসায়ী ট্যানারি মালিকদের কাছ থেকে বকেয়া টাকা তুলতে ব্যর্থ হয়ে পরবর্তীতে ব্যবসা ধরে রাখতে পারেননি। আবার অনেকে চামড়া ব্যবসায় ঋণ না পেয়ে পুঁজির অভাবে পেশা পরিবর্তন করতে বাধ্য হয়েছে। তাই এ পেশার সাথে সম্পৃক্ত অল্প সংখ্যক ব্যবসায়ীর দাবি, চামড়া শিল্পে ঋণের ব্যবস্থাসহ কাঁচা চামড়া সংরক্ষণের ব্যবস্থা না করা হলে এক সময় একেবারেই হারিয়ে যাবে এ পেশা।
একসময় পাবনা পশ্চিম সাধুপাড়া এলাকায় গড়ে
ওঠেছিল চামড়াপট্টি। প্রায় ৩০ জন ব্যবসায়ী চামড়া কেনাবেচার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। আগে চামড়ার
ব্যবসার এতোই প্রসার ঘটে ছিল যে লবণ দিয়ে সংরক্ষণ করে রাখা চামড়ার দুর্গন্ধে আশপাশের
মানুষ রাস্তা দিয়ে চলাচল করতে পারতো না। অথচ এখন সেই চামড়াপট্টিতে চামড়া নেই। সময়মতো
বকেয়া টাকা তুলতে ব্যর্থ হওয়া, চামড়ার ভালো বাজার না পাওয়াসহ নানা সমস্যার কারণে চামড়াপট্টিতে
বর্তমানে হাতে গোনা দুই থেকে তিনজন ব্যবসায়ী কোন মত টিকে আছে। পেশা বদল করে নেয়া বেশিরভাগ
চামড়া ব্যবসায়ী এখন শুধু ঈদুল আজহাতে মৌসুমী ব্যবসায়ী হিসেবে কোরবানির পশুর চামড়া কেনাবেচা
করে থাকে।
পাবনা পশ্চিম সাধুপাড়া এলাকার চামড়া ব্যবসায়ী আমজাদ হোসেন আজম, মো. রাজু শেখ, ইমদাদুলহক ইন্দু, আবদুল হান্নান মিলন, শাকিলসহ বেশ কয়েকজন চামড়া ব্যবসায়ী জানান, ট্যানারি মালিকদের নির্ধারিত দামে চামড়া বিক্রি করতে হয়। বেশি দামে চামড়া কেনা থাকলেও কম দামে বিক্রি করা ছাড়া কোন উপায় থাকে না তাদের।
তারা আরও জানান, চামড়া সংরক্ষণ করে রাখবে সেই সুযোগও নেই তাদের। নগদ দামে চামড়া কিনে বেশ কিছু টাকা বাকি রেখে ট্যানারিগুলোতে তাদের চামড়া বিক্রি করতে হচ্ছে। অতীতে প্রসিদ্ধ ট্যানারি মালিকের মৃত্যুর কারণে চামড়াপট্টির অনেক ব্যবসায়ী বকেয়া লাখ লাখ টাকা আজও তুলতে না পেরে মূলধনের অভাবে তারা আজ পথে বসেছে। চামড়া বিক্রি করে বছরের পর বছর ধর্ণা দিয়েও বকেয়া টাকা তুলতে পারিনি অনেকে। তারা জানান, শুধু তারাই নয়, তাদের মতো অনেকেই আজ পুঁজি হারিয়ে পথে বসেছে অথবা ধার-দেনা করে অন্য পেশায় যুক্ত হয়েছে। তাই চামড়া শিল্পে ব্যাংক ঋণ চালু করাসহ সুষ্ঠু বাজার ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলার জন্য সরকারের কাছে দাবি জানান তারা।
পাবনা হাজিরহাট বেতে পাড়ার আইসা ডেইরি ফ্রাম ও চামড়া আড়ৎ ব্যবসায়ী আব্দুল খালেক জানান, চামড়া ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে আমরা এ ব্যবসা শুরু করেছি। মসজিদ মাদ্রাসা যেন এই চামড়ার ন্যায্য মূল্য পায় এজন্য আমরা এ পেশায় সম্পৃক্ত হয়েছি।
তিনি জানান, পাবনার সবচেয়ে বেশি পশুর চামড়া ক্রয় করে থাকি আমরা। পাবনায় চামড়া ব্যবসা যেন হারিয়ে না যায় এজন্যই তারা এই পেশা ধরে রাখার চেষ্টা করছেন বলে জানান তিনি। তিনি আরও জানান, চামড়া প্রতি ৮০০ থেকে ৯০০ টাকা দরে চামড়া কিনে থাকেন তারা, তবে সব মিলিয়ে চামড়া প্রতি তাদের খরচ হয় ১৩০০ টাকার মত। তিনি বলেন, বর্তমানে চামড়ার বাজার নেই। ট্যানারি ছাড়া স্থানীয়ভাবে চামড়া সংরক্ষণে বিকল্প কোন ব্যবস্থাও নেই, আমদানি কম অন্যদিকে লবণের দাম বৃদ্ধি। ঢাকার ব্যবসায়ীরা চামড়ার ন্যায্য মূল্য না দেওয়ায় এব্যবসা টিকিয়ে রাখা কঠিন হচ্ছে বলে তিনি দাবি করেন।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক) এর পাবনা (ভারপ্রাপ্ত) উপ-মহাব্যবস্থাপক মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, গত দুই বছর হলো চামড়া শিল্প নিয়ে কাজ করছি। চামড়া ব্যবসা যেন আগের মত চাঙ্গা হয় এজন্য বিসিক নিরলস ভাবে কাজ করছে। তিনি বলেন, সরকারি রেট অনুযায়ী চামড়া ক্রয় বিক্রয় হচ্ছে কি-না আমরা সে বিষয়েও মনিটরিং করছি। এর পাশাপাশি বিসিক ঋণ কার্যক্রমও চালু আছে। চামড়া শিল্প রক্ষায় সহজ শর্তে ঋণসহ নানা সহয়োগিতার আশ্বাস দেন স্থানীয় এই বিসিক কর্মকর্তা।
তিনি বলেন, যেসকল চামড়াগুলি জেলা পর্যায়ে আছে এই চামড়াগুলি নিয়ে ব্যবসায়ীরা যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হয় এ ব্যাপারেও তারা তাদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে চলছে।