সাভার (ঢাকা) প্রতিনিধি:
আশুলিয়ায় এক এসএসসি পরীক্ষার্থী রেজিয়া আক্তার কেয়ার পিতা-মাতার বিরুদ্ধে বানোয়াট মামলা দিয়ে পিতাকে আটক করার অভিযোগ উঠেছে আশুলিয়া থানার এক পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে। প্রতিবেশীর সাথে একটি ফ্লাট নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে ওই পরিক্ষার্থীর পিতাকে আটক করে নিয়ে যায় পুলিশ। বাদির সাথে পুলিশের এক কর্মকর্তার বিশেষ সখ্যতার কারণে আটক রেখে বানোয়াট মামলা দিয়ে পরিক্ষার্থীর বাবা সাবেক সেনাসদস্যকে হাজতে পাঠানোর অভিযোগ করেছে শিক্ষার্থীর পরিবারসহ প্রতিবেশীরা।
উক্ত মামলায় পরীক্ষার্থীর মাকেও আসামি করা হয়। এ ঘটনায় বিপাকে ও আতঙ্কগ্রস্থ হয়ে এসএসসি পরীক্ষা দেয়া অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে বলে জানায় এসএসসি শিক্ষার্থী রেজিয়া আক্তার কেয়া ।
মূলত ফ্ল্যাটের মালিকানা দ্বন্দ্বে পুলিশের সখ্যতাকে কাজে লাগিয়ে চুরির একটি বানোয়াট মামলায় ফাঁসানোর অভিযোগ করেন, ভুক্তভোগী পরীক্ষার্থীর বাবা সাবেক সেনাসদস্য রাজুসহ তাদের প্রতিবেশী ফ্ল্যাটের অন্যান্য মালিকগণ।
আশুলিয়ার দক্ষিণ গাজীরচট এলাকায়, যৌথ মালিকানায় ১২শতাংশ জমির উপর ৮ ইউনিট বিশিষ্ট ৪র্থ তলা ভবন নির্মাণ করে ৮ জন মালিক। ভুক্তভোগী রাজু ও অভিযোগকারী দুলাল আটজনের দুইজন মালিক। তারা দু'জনই অবসরপ্রাপ্ত সেনাসদস্য।
অভিযোগকারী দুলালের স্ত্রী আছমা সুলতানা ও আশুলিয়া থানার পরিদর্শক তদন্ত জিয়াউল ইসলামের গ্রামের বাড়ি একই জেলায়। সেই সুবাদে তাদের মধ্যে সুসম্পর্ক রয়েছে, যার প্রভাব খাটিয়ে এই মামলা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
দুলাল দম্পতির পক্ষ থেকে মামলা করার আগেই, গত মঙ্গলবার রাতে আশুলিয়ার দক্ষিণ গাজীরচট এলাকার নিজ বাসা থেকে আটক করা হয় অবসরপ্রাপ্ত সেনাসদস্য রাজু আহম্মেদকে। পরদিন আশুলিয়া থানায় শিক্ষার্থীর পিতা রাজু আহমেদসহ তার মা আসমার বিরুদ্ধে একটি চুরির মামলা হয়। এরপর শিক্ষার্থীর পিতাকে আদালতে পাঠানো হয়।
এর আগেও আশুলিয়া থানার পরিদর্শক তদন্ত জিয়াউল ইসলামের বিরুদ্ধে, আশুলিয়ার কবিরপুর এলাকায় অন্যকে ঝুট ব্যবসা দখল পাইয়ে দিতে মূল মালিককে দুটি মামলায় ফাঁসানোর অভিযোগ ওঠে। যা বিভিন্ন গণমাধ্যমে বিশেষ প্রতিবেদন আকারে প্রকাশিত হয়।
গ্রেপ্তার রাজুর স্ত্রী ও পরিক্ষার্থীর মা আসমা আহম্মেদ বলেন, ‘গাজীরচট এলাকার চতুর্থ তলায় আমার একটা ফ্ল্যাট আছে। বিক্রি করার ইচ্ছা প্রকাশ করলে আমাদের এক শেয়ারমেট (দুলাল হোসেন ও তার স্ত্রী আছমা সুলতানা) জানায় তিনি কিনবেন। সম্পর্ক ভালো থাকায় ১০ হাজার টাকায় তার সঙ্গে ফ্ল্যাটটি মৌখিক বায়না করি। কথা ছিল বাকি ৭ লাখ টাকা পরে দেবে।
‘কিন্তু ফ্ল্যাটের ৭ লাখ টাকা না দিয়েই দুলাল-আছমা দম্পতি ফ্ল্যাটের ভেতরে গোপনে নির্মাণকাজ করে যাচ্ছিল। বিষয়টি জানতে পেরে আমি প্রতিবাদ করতে গেলেই আমাদের মারধর করতে আসেন ওনারা। অনেকবার থানায় গেলেও পুলিশ মামলা নেয়নি। স্থানীয়ভাবে মীমাংসার জন্য ওনাদের ডাকা হলেও তারা বসেননি। পরে এ ব্যাপারে আমরা আদালতে একটি পিটিশন মামলা এবং ডিবি পুলিশের কাছে অভিযোগ করেছি। পরে আমরা ফ্ল্যাটটি অন্যজনের কাছে বিক্রি করি।’
তিনি জানান, গত বুধবার দুলাল ও আছমারা জোরপূর্বক ফ্ল্যাট দখল করতে আসলে তাদের সঙ্গে বাগবিতণ্ডা হয়। একপর্যায়ে দুলালের স্ত্রী থানায় ফোন করে পুলিশ ডেকে আনেন। তখন আমার স্বামী রাজুকে ধরে নিয়ে যান এসআই মিলন ফকির। পরদিন আমার এবং আমার স্বামীর নামে চুরি, জখম, ভাঙচুরের মামলা করেন দুলালের স্ত্রী আছমা।
রাজুর স্ত্রী বলেন, ‘মূলত থানার ওসি জিয়া ও আছমার বাড়ি ময়মনসিংহ জেলায়। সখ্যতার কারণে ওসি সাহেব ওই মহিলার পক্ষ নিয়ে মিথ্যা মামলায় আমার স্বামীকে গ্রেপ্তার করেছেন এবং আমার নামে মামলা হওয়া আতঙ্ক নিয়ে এক প্রকার পলাতক অবস্থায় রয়েছি। আমার মেয়ের এসএসসি পরীক্ষা চলছে, ওর ভবিষ্যৎ জীবন ও পরিক্ষা এখন অনিশ্চয়তার পথে’।
ওই ভবনের ফ্ল্যাট মালিকদের মধ্যে প্রধান মালিক সাবেক সেনাসদস্য, সিনিয়ার ওয়ারেন্ট অফিসার, গোলজার হোসেন বলেন, ‘আমরা আটজন সেনাসদস্য নিজেদের জমানো অর্থ দিয়ে চারতলা এই বাড়িটি নির্মাণ করেছি। পুরো বাড়ি আমার তত্ত্বাবধানেই হয়েছে।
‘নির্মাণ শেষ হওয়ার পর অংশীদারদের ফ্ল্যাট বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে। কিন্তু চারতলার দুলাল-আছমা দম্পতি জোর করে নিচের একটি দোকান ও নিচতলার আরেকটি ফ্ল্যাট দখল করে ভাড়া আদায় করছেন। প্রতিবাদ করতে গেলে নানা হুমকি দিয়ে আসছেন। এমনকি এলাকাভিত্তিক মীমাংসার জন্য বসা হলে সেখানে দুলাল ও তার ছেলে লোকজন ভাড়া করে এনে আমাদের মারধর করে। থানায় গিয়েও এর কোনো প্রতিকার পাইনি।’
গোলজার বলেন, ‘তখন ওসি (আসলে পরিদর্শক-তদন্ত) জিয়া মামলা না নিয়ে আমাদের বলেন, সব মিটমাট করে ফেলেন। পরে আমরা জানতে পারলাম জিয়ার গ্রামে নাকি আছমা-দুলাল দম্পতির বাড়ি। পক্ষ নিয়ে তখনও আমাদের সঙ্গে উনি খারাপ আচরণ করেছেন।’
আরেক ফ্ল্যাট মালিক সাবেক সেনাসদস্য সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘পুলিশকে দিয়ে রাজুকে হয়রানি করছে দুলাল ও আছমা দম্পতি। জবরদখল করে রাখছে ফ্ল্যাটও।’
আশুলিয়া থানা স্বেচ্ছাসেবক লীগের অর্থবিষয়ক সম্পাদক জামাল উদ্দিন ভূঁইয়া বলেন, ‘বিষয়টি স্থানীয়ভাবে মীমাংসার জন্য ডাকা হলেও দুলাল-আছমা দম্পতি আসেননি। এখন তারা পুলিশের প্রভাব খাটিয়ে অবৈধভাবে ফ্ল্যাট দখল করেছেন। পুলিশ একতরফাভাবে দুলাল-আছমা দম্পতির পক্ষে কাজ করেছে। পুলিশ নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করবে এটাই সবার কাম্য।’
মামলা করার বিষয়ে বাদী আছমা সুলতানা বলেন, ‘ওনারা আমার ফ্ল্যাটে ঢুকে আমার স্বামী, ছেলে-মেয়েসহ আমাকে রড, লাঠি দিয়ে মারধর করেছে। হাসপাতালে এখনো যায়নি তবে পরে যাব। তাছাড়া নির্মাণাধীন ওই ফ্লাট থেকে আমার স্বর্ণ, টাকা নিয়ে গেছে। তাই মামলা করেছি।’
তিনি বলেন, ‘করোনাকালীন ৭ লাখ ১০ হাজার টাকা দিয়ে ফ্ল্যাট কিনেছি। বিশ্বাসের জায়গা থেকে কোনো স্ট্যাম্প কিংবা ডিডে লিখিত কোনো ডকুমেন্ট রাখিনি। এটাই আমাদের ভুল হইছে।’
আশুলিয়া থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মোহাম্মদ জিয়াউল ইসলাম বলেন, 'এটা ফ্ল্যাটের মালিকানা নিয়ে দ্বন্দ্ব। চেয়ারম্যান বলেছিল মীমাংসা করে দেবে। কিন্তু ওরা (রাজু আহম্মেদ) শোনেনি। দিনেদুপুরে লোকজন নিয়ে মহিলার (বাদীর) ফ্ল্যাটে তালা লাগিয়ে দিয়েছে।'
মামলায় যে অভিযোগ আনা হয়েছে, সেটি তো সত্য নয় বলে প্রতিবেশী ফ্ল্যাটের মালিকরা বলছেন, এমন প্রশ্নে পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, ‘অভিযোগ দিলেই তো হলো না। ওইটা তো আমরা তদন্ত করে যেটা প্রমাণ হবে ওইটাই হবে। মামলার তো আর চার্জশিট হয় নাই। অভিযোগ তো অনেকে অনেক কিছু দেয়। কিন্তু তদন্তসাপেক্ষে আমরা তো অনেক কিছু পাই, অনেক কিছু দিই।
ঢাকা জেলার পুলিশ সুপার মো. আসাদুজ্জামান বলেন, ‘যদি এ ধরনের কোনো ঘটনা হয়ে থাকে। তাহলে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়া হবে।’