
১৯৭১ সালে পাকিস্তানের বিপক্ষে রক্তাক্ত মুক্তিযুদ্ধের পর বাংলাদেশ কেবল স্বাধীন হয়েছে। সে সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা হেনরি কিসিঞ্জার বাংলাদেশ নিয়ে একটা মন্তব্য করেছিলেন। তিনি বাংলাদেশকে একটা ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’র সঙ্গে তুলনায় এনেছিলেন।
পাকিস্তানী শাসকদের শোষণে নিপীড়নে নিষ্পেষিত ও বিধ্বস্ত এক অর্থনীতি নিয়ে দেশ গড়ার কাজ শুরু করেছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৭৫ সালে ঘাতকদের হাতে নির্মমভাবে নিহত হন তিনি। তবে তার সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনার হাত ধরে বাংলাদেশ এখন বিশ্বের কাছে উন্নয়নের রোলমডেল। ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’র সেই বদনাম ঘুচিয়ে উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদায় বিশ্বের দরবারে আসীন হচ্ছে বাংলাদেশ।
বিশ্ব নেতারা আজ শেখ হাসিনার নেতৃত্বের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। বিশ্বজুড়ে চলছে তার নেতৃত্বের জয়ধ্বনি। এটা গোপনে নয়, প্রকাশ্যে। দেখাও যাচ্ছে আর শোনাও যাচ্ছে। তারা শেখ হাসিনাকে প্রতিনিয়ত অভিহিত করছেন প্রশংসাসূচক নানা অভিধায়।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে এক যুগে দারিদ্র্য দূরীকরণ আর উচ্চ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জনে বড় সফলতা এসেছে। সব ঠিক থাকলে, ২০৩৫ সাল নাগাদ বাংলাদেশ হবে বিশ্বের ২৫তম অর্থনীতির দেশ। আর ২০৪১ সালে উন্নত দেশের তালিকাভুক্ত হবে।
বিশ্বের নানা প্রান্তের গবেষক-বিশ্লেষকদের পাশাপাশি অর্থনৈতিক চালচিত্র পর্যবেক্ষণকারী নানা প্রতিষ্ঠানের অভিমত, জন্মের ৫২ বছরের মধ্যেই বাংলাদেশ উন্নয়নের দুর্বার গতি অর্জন করেছে। গত একযুগে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বা সামাজিক উন্নয়ন- যে কোনো সূচকে বাংলাদেশের অগ্রগতি অভূতপূর্ব। সামাজিক নিরাপত্তা, অর্থনৈতিক উন্নয়ন, অবকাঠামো উন্নয়ন, দারিদ্র্য হ্রাস, মাথাপিছু আয় বৃদ্ধিসহ সব ক্ষেত্রেই বিশ্বে বাংলাদেশ এখন এক বিস্ময়ের নাম।
শেখ হাসিনা নিজের অনুপ্রেরণা বলে উল্লেখ করেছেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী। আর দেশকে
সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নিয়ে যেতে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মতো নেতৃত্ব প্রয়োজন
বলে মন্তব্য করেছেন আইএমএফের ব্যবস্থাপনা পরিচালক। প্রশংসা করেছেন বিশ্বব্যাংকসহ বিভিন্ন
দেশের প্রধানরা। বিশ্বের ক্ষমতাধর নারীর তালিকায় ৪২তম স্থানে শেখ হাসিনা। আন্তর্জাতিক
বিভিন্ন সংস্থার প্রতিবেদন, গবেষণা প্রতিষ্ঠানের তথ্য এবং বিভিন্ন দেশের অর্থনীতিবিদ
ও সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের মুখে বাংলাদেশের উন্নয়নের জয়গান শোনা যায়। সমৃদ্ধির
বহু নামে বাংলাদেশকে পরিচিতি দেয়া হয় বিভিন্ন সংস্থার গবেষণা প্রতিবেদনে।
কিন্তু এ ঈর্ষণীয় অর্জনের উচ্চতা কতটুকু তা পরিমাপের পরিষ্কার ধারণা উঠে এসেছে জাতিসংঘের প্রতিবেদনে। বিশ্বের নীতিনির্ধারণী এই আন্তর্জাতিক সংস্থার দৃষ্টিতে বাংলাদেশ এখন স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তকমা ঘুচিয়ে উন্নয়নশীল দেশ। জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক কাউন্সিলের (ইকোসক) মানদণ্ড অনুযায়ী উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হতে হলে একটি দেশের মাথাপিছু আয় হতে হবে কমপক্ষে ১ হাজার ২৩০ ডলার। বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় এখন ২ হাজার ৮২৪ ডলার। মানবসম্পদ সূচকে ৬৬ পয়েন্ট দরকার হলেও বাংলাদেশ অর্জন করেছে ৭২.৯। অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা সূচক হতে হয় ৩২ শতাংশ বা এর কম, সেখানে বাংলাদেশের রয়েছে ২৪.৮ শতাংশ।
বাংলাদেশের বিভিন্ন খাতে বড় বিনিয়োগের প্রস্তাব দিয়েছে সৌদি আরব। স্থিতিশীলতা এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ভালো অবস্থানের কারণে বাংলাদেশে বড় অংকের বিনিয়োগে আগ্রহী মধ্যপ্রাচ্যের তেলসমৃদ্ধ শীর্ষ অর্থনীতির দেশটি। গত মঙ্গলবার (২৩ মে) কাতারে হোটেল ওয়ালডর্ফ অ্যাস্তোরিয়ায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎকালে সৌদি বিনিয়োগমন্ত্রী খালিদ এ আল-ফালিহ এবং সৌদি অর্থনীতি ও পরিকল্পনামন্ত্রী ফয়সাল আলিব্রাহিম এ প্রস্তাব দেন।
একই দিনে বাংলাদেশের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক আরো জোরদার করতে আগ্রহ প্রকাশ করেন কাতারের প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ বিন আব্দুল রহমান বিন জাসিম আল থানি। কাতারের প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, কাতার বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু। তারা বাংলাদেশের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক আরো এগিয়ে নিতে চায়।
গত ৩০ এপ্রিল ওয়াশিংটনের রিজ-কার্লটন হোটেলে বাংলাদেশ প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎকালে বাংলাদেশের অভূতপূর্ব উন্নয়নের ভূয়সী প্রশংসা করে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ব্যবস্থাপনা পরিচালক ক্রিস্টালিনা জর্জিয়েভা বলেছেন, ‘সকল বাধাবিপত্তি মোকাবিলা করে দেশকে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নিয়ে যেতে বাংলাদেশে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মতো নেতৃত্ব প্রয়োজন।’
ক্রিস্টালিনা বলেন, ‘বাংলাদেশ বিশ্বে একটি রোল মডেল। শেখ হাসিনার গতিশীল নেতৃত্বে দেশটি বিভিন্ন ক্ষেত্রে অভূতপূর্ণ উন্নয়ন অর্জন করেছে।’
জর্জিয়েভা আরো বলেন, ‘সকল বাধাবিপত্তি মোকাবিলা করে দেশকে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নিয়ে যেতে শেখ হাসিনার মতো নেতৃত্ব জরুরি।’
তিনি বাংলাদেশে কোভিড-১৯ মহামারিকালেও সামষ্টিক অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা বজায় রাখায় শেখ হাসিনার প্রশংসা করে বলেন, ‘ব্যাপক অবকাঠামোগত উন্নয়ন, সুসংযোগ স্থাপন এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে।’
যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক শেখ হাসিনাকে একজন সফল অর্থনৈতিক নেতা হিসেবে অভিহিত করে বলেছেন, ‘আপনি আমাদের জন্য অনুপ্রেরণা।’ সুনাক আরো বলেছেন, ‘আমি আপনাকে অনেক বছর ধরে অনুসরণ করছি। আপনি একজন সফল অর্থনৈতিক নেতা।’
যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী আরো বলেছেন, তার দুই মেয়ে এবং স্ত্রী তাঁর (শেখ হাসিনা) বড় ভক্ত। তিনি গত অক্টোবরে দায়িত্ব নেয়ার পর থেকে তার কন্যারা শেখ হাসিনার মতো মহান নেতা হবেন- এই কামনা করেছেন। সুনাক বলেন, ‘আপনি আমার দুই মেয়ের জন্য মহান অনুপ্রেরণা।’
ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশের সমৃদ্ধির জন্য শেখ হাসিনার নেতৃত্বের ভূয়সী প্রশংসা করেন এবং পাশাপাশি রোহিঙ্গাদের আশ্রয়, ভূমিহীন ও গৃহহীন বাংলাদেশের জনগণকে সরকারি খরচে বাড়ি দেয়া, জলবায়ু পরিবর্তনসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে তাঁর গৌরবময় ভূমিকার ভূয়সী প্রশংসা করেন।
গত ৫ এপ্রিল প্রকাশিত জাতিসংঘের বার্ষিক প্রতিবেদনে বাংলাদেশ সম্পর্কে বলা হয়েছে, করোনা মহামারি, ইউক্রেন যুদ্ধ, উন্নয়ন ও মানবিক সহায়তা পাওয়ার প্রতিযোগিতা এবং জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ক্রমবর্ধমান সংকট সত্ত্বেও ২০২৩ সালে অর্থনীতিকে স্থিতিশীল ও শক্তিশালী করে তোলার পথ খুঁজবে বাংলাদেশ। চলতি বছর বাংলাদেশকে কয়েকটি বড় চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে।
এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বাংলাদেশকে সহযোগিতা করবে জাতিসংঘ। বাংলাদেশ ২০২৬ সালে স্বল্পোন্নত দেশে উত্তরণের পথে হাঁটবে। দেশের টেকসই উন্নয়নজনিত অগ্রগতির গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক অর্জনের ব্যাপারে একটি কৌশল নিয়ে কাজ করবে।
বাংলাদেশের উন্নয়ন অগ্রযাত্রা থেকে অনেক দেশকে শিক্ষা নিতে বলেছেন বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট ডেভিড ম্যালপাস। তিনি বলেছেন, রেকর্ড সময়ের মধ্যে দারিদ্র্য হ্রাস, নারীর ক্ষমতায়ন, দেশব্যাপী বিদ্যুতায়ন এবং জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ তার উদ্ভাবনী পদ্ধতির জন্য স্বতন্ত্র।
১ মে বিশ্বব্যাংকের সদর দফতর ওয়াশিংটন ডিসিতে ‘বাংলাদেশ ও বিশ্বব্যাংকের অংশীদারত্বের ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে’ এক অনুষ্ঠানে তিনি এসব কথা বলেন।
বাংলাদেশ নজিরবিহীন বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করছে উল্লেখ করে বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট বলেন, বৃহত্তম উন্নয়ন সহযোগী হিসেবে আয় বৃদ্ধি ও দারিদ্র্য হ্রাসে বাংলাদেশের অগ্রগতিকে আমরা স্বাগত জানাই। বেসরকারি খাতকে আরো শক্তিশালী করতে, নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি, করের ভিত্তি প্রসারিত, আর্থিক খাত শক্তিশালীকরণ এবং অর্থনৈতিক ও জলবায়ু সংকট মোকাবিলায় বাংলাদেশের প্রতি বিশ্বব্যাংক তার সমর্থন অব্যাহত রাখতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
সম্প্রতি আন্তর্জাতিক অর্থ বিষয়ক সংবাদ সংস্থার এক নিবন্ধে লেখা হয়েছে, ‘তিনি (শেখ হাসিনা) টানা চতুর্থ মেয়াদে জয়ী হবেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।’ একই সঙ্গে শেখ হাসিনাকে পুরো তহবিল পেতে আরো সংস্কার করতে হবে বলেও পরামর্শ দেয়া হয়েছে।
বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যেও ‘সময়োচিত সংস্কার পদক্ষেপ’ গ্রহণের মাধ্যমে দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রশংসা করে বিশ্বখ্যাত সংবাদ সংস্থা ব্লুমবার্গ বাংলাদেশে আগামী সাধারণ নির্বাচনে তার নেতৃত্বাধীন সরকার চতুর্থ মেয়াদে নির্বাচিত হবে বলে ইঙ্গিত দিয়েছে।
এতে বলা হয়, শেখ হাসিনা ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে অনুষ্ঠেয় জাতীয় নির্বাচনে টানা চতুর্থ মেয়াদে সম্ভাব্য জয়ী হওয়ার কারণ এটা নয়, যে তার অনেক প্রতিপক্ষ কারাগারে আছেন বা আইনি ফাঁদে পড়েছেন।
নিবন্ধে বলা হয়েছে, শেখ হাসিনার বিজয়ের কারণ ‘কেবলমাত্র তার অনেক প্রতিপক্ষ কারাগারে আছে বা আইনী ফাঁদে পড়েছেন- এটা নয় বরং অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে তার সাফল্যের কারণেই এটা ব্যাপকভাবে প্রত্যাশিত।’
আগামী জাতীয় নির্বাচনের আগে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে দক্ষিণ এশিয়ার দেশটির সময়োপযোগী সংস্কারের জন্য আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঋণ প্রাপ্তির পটভূমিতে ব্লুমবার্গ দুটি উপ-শিরোনামসহ ‘বাংলাদেশ লিডার বেটস আইএমএফ-ম্যান্ডেটেড রিগর উইল পে অফ ইন পোলস’ শিরোনামের এই নিবন্ধটি প্রকাশ করে।
উন্নয়ন পরিক্রমা বিবেচনায় স্বাধীনতার ৫০ বছরে বাংলাদেশের এই অর্থনৈতিক শক্তি বিশ্বের খুব কম দেশেরই রয়েছে। বাংলাদেশের অপ্রতিরোধ্য উন্নয়নের স্বীকৃতি এসেছে যুক্তরাজ্যভিত্তিক অর্থনৈতিক গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর ইকোনমিক্স অ্যান্ড বিজনেস রিসার্চের সর্বশেষ প্রকাশিত ‘ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক লিগ টেবিল-২০২২’ প্রতিবেদন থেকেও। এই প্রতিবেদনের সারসংক্ষেপে বাংলাদেশকে ২০২০ সালের সূচকে বিশ্বের ১৯৬টি দেশের মধ্যে ৩৫তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ হিসেবে পরিচিতি দেয়া হয়েছে। পাশাপাশি ভবিষ্যদ্বাণী করে আরো বলা হয়েছে, আগামী ১৫ বছর পর অর্থাৎ ২০৩৫ সালের মধ্যে বাংলাদেশ হবে বিশ্বের ২৫তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ। আরেকটি পরিষ্কার ধারণা পাওয়া যায়, খ্যাতনামা অর্থনীতিবিদদের মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) ভিত্তিক প্রবৃদ্ধি পর্যালোচনা থেকে।
স্বাধীনতা অর্জনের পর গত পাঁচ দশকের শেষ দুই দশকে প্রায় প্রতি বছর আগের বছরের তুলনায় জিডিপি বেড়েছে গড়ে এক শতাংশ হারে। এটা বিশ্বে অনন্য নজির। এছাড়া, স্বাধীনতার প্রথম তিন দশকেও প্রবৃদ্ধির ধারাবাহিকতা ছিল। ওই সময় প্রতি দশকে গড়ে এক শতাংশের অতিরিক্ত প্রবৃদ্ধি যোগ হয়েছে। উচ্চ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ফলে জনগণের মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি পেয়েছে। দেশের মানুষের বর্তমান মাথাপিছু আয় বেড়ে ২ হাজার ৮২৪ মার্কিন ডলারে উন্নীত হয়েছে, যা স্বাধীনতার পর ৭০ দশকে ছিল ৫০ থেকে ৭০ ডলারের মধ্যে।
সামাজিক ও মানব উন্নয়নের বিভিন্ন সূচকেও বাংলাদেশের রয়েছে ঈর্ষণীয় সাফল্য। বিগত একযুগ ধরে সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ধারাবাহিক উন্নয়নের ফলে বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য সফলতা অর্জিত হয়েছে। বাংলাদেশ ২০১৫ সালে বিশ্বব্যাংকের মানদণ্ড অনুযায়ী নিম্ন আয়ের দেশ থেকে নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হয়েছে। আবার জাতিসংঘের মানদণ্ড অনুসারে ২০১৮-২১ সালের পর্যালোচনায় ধারাবাহিকভাবে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের সব শর্ত পূরণ করে। গত দশকে কোভিড-১৯-এর আগ পর্যন্ত বাংলাদেশ বিশ্বে দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতিগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল। প্রতিবেশী দেশ ভারত ও পাকিস্তানকে পেছনে ফেলে বাংলাদেশ মাথাপিছু আয় ও সামাজিক সূচকগুলোর মধ্যে প্রায় অধিকাংশ ক্ষেত্রে এগিয়ে।
এর সঙ্গে রয়েছে এমডিজি ক্ষেত্রে প্রভূত সাফল্য ও দারিদ্র্য নিরসনে অসামান্য অর্জন। আমাদের দেশের প্রথিতযশা ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের মুখে তা খুব বেশি উচ্চারিত না হলেও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম, নামকরা অর্থনীতিবিদ, আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের চোখ এড়ায়নি। তারা নির্ধিদ্বায় বাংলাদেশের অর্জন তুলে ধরেছেন। এতো প্রতিকূলতার মাঝে বাংলাদেশের স্বল্প সময়ে উত্থান লাভ বিশ্বের নামজাদা গণমাধ্যমের কাছে এক বিস্ময় হয়ে ধরা দিয়েছে। ইন্টারন্যাশনাল মনিটারি ফান্ড বা আইএমএফ-এর তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশ এখনই তৃতীয় সর্বোচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জনকারী দেশ।
যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্বখ্যাত সংবাদ সংস্থা ব্লুমবার্গ বলেছে, বাংলাদেশ হতে পারে সর্বোচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জনকারী দেশ। হংকং সাংহাই ব্যাংকিং করপোরেশনের (এইচএসবিসি) সর্বশেষ গ্লোবাল রিসার্চ ‘দ্য ওয়ার্ল্ড ইন ২০৩০ : আওয়ার লং টার্ম প্রজেকশনস ফর ৭৫ কান্ট্রিজ’ শিরোনামের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৮ সাল থেকে ২০৩০ সালের মধ্যে অবস্থানের দিক থেকে বাংলাদেশের অর্থনীতি ১৬ ধাপে উন্নীত হবে। এর মধ্য দিয়ে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ভিত্তিতে বিশ্বের ২৬তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ হবে বাংলাদেশ। ৫৪টি স্বাধীন দেশের সমন্বয়ে গঠিত ভলান্টারি সংস্থা কমনওয়েলথের মহাসচিব প্যাট্রিসিয়া স্কটল্যান্ড জানান, শুধু গত দশকেই বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ১৮৮ ভাগ বেড়েছে।
চলতি বছর বাংলাদেশ হাইকমিশন ও কমনওয়েথ সচিবালয়ের যৌথ আয়োজনে লন্ডনে অনুষ্ঠিত একটি উচ্চ পর্যায়ের আলোচনায় তিনি বাংলাদেশের এই অসামান্য অর্জনের ভূয়সী প্রশংসা করে আরো বলেন, ১০ লাখের বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থীর বোঝা বহন এবং বিশ্বব্যাপী চলমান করোনা মহামারির মধ্যেও বাংলাদেশে অর্থনীতি ও উন্নয়নের লক্ষ্যগুলো সঠিকভাবেই এগিয়ে যাচ্ছে। জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিডি) কর্তৃক প্রকাশিত মানব উন্নয়ন সমীক্ষা ২০২০-এ দাবি করা হয়, মানব উন্নয়নে বাংলাদেশের অর্জন অসাধারণ। ১৯৯০ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে মানব উন্নয়ন সূচক শতকরা ৬০ দশমিক ৪ ভাগ বৃদ্ধি পেয়েছে। এ ধরনের অগ্রগতির নজির বিশ্বে কমই আছে।
এতে আরো বলা হয়, গত ৩০ বছরে বাংলাদেশের মানুষের প্রত্যাশিত গড় আয়ু বেড়েছে ১৪ দশমিক ৪ বছর, গড় শিক্ষাকাল বেড়েছে ৩ দশমিক ৪ বছর এবং প্রত্যাশিত শিক্ষাকাল বেড়েছে ছয় বছর। এছাড়া এ সময়ে মাথাপিছু আয়ের পরিমাণও বেড়েছে প্রায় শতকরা ২২০ দশমিক ১ ভাগ। বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের (ডব্লিউইএফ) ‘ইনক্লুসিভ ডেভেলপমেন্ট ইনডেক্স-আইডিআই ২০১৮ র্যাংকিংয়ে অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন সূচকে ভারতের চেয়ে ২৮ ধাপ এবং পাকিস্তানের চেয়ে ১৩ ধাপ এগিয়েছে বাংলাদেশ। সংস্থাটির গ্লোবাল জেন্ডার গ্যাপ রিপোর্ট ২০১৬-এর তথ্য অনুযায়ী লিঙ্গসমতা প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশ এশিয়ায় সবচেয়ে সফল দেশ।
১৪৫ দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৬৪তম। বিশ্বব্যাংকের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, উন্নয়নের প্রধান ১২টি সূচকের ১০টিতেই বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়া ও অন্যান্য নিম্ন আয়ের দেশের তুলনায় ভালো করছে। আমেরিকার নিউইয়র্কভিত্তিক অন্যতম সংবাদমাধ্যম ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল (৩ মার্চ, ২০২১) বাংলাদেশকে দক্ষিণ এশিয়ার অর্থনীতির ‘বুল কেস’ হিসেবে অভিহিত করেছে। ভারত ও পাকিস্তানের সঙ্গে তুলনা করে পত্রিকাটি বলেছে, বাংলাদেশের রফতানি লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। শুধু তাই নয়, দক্ষিণ কোরিয়া, চীন ও ভিয়েতনামে যে উন্নয়ন মডেল দেখা গেছে তার সবচেয়ে কাছাকাছি মনে করা হচ্ছে বাংলাদেশকে। নিউইয়র্কভিত্তিক আরো একটি আন্তর্জাতিকখ্যাত সংবাদমাধ্যম ব্লুমবার্গ (৫ জুন, ২০২১) শিরোনাম দিয়েছে ‘বাংলাদেশ ইজ অন দ্য রাইজ।’
বাংলাদেশের উচ্চপ্রবৃদ্ধির পেছনে তিনটি ভিত্তি কাজ করেছে- রফতানি, সামাজিক খাতে অগ্রগতি ও আর্থিক দূরদর্শিতা। ২০১১-১৯ সময়ে বাংলাদেশের রফতানি প্রবৃদ্ধি ছিল প্রতি বছর গড়ে ৮ দশমিক ৬ শতাংশ, অন্যদিকে গোটা বিশ্বে তা মাত্র শূন্য দশমিক ৪ শতাংশ। বাংলাদেশ ঋণ জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৩০-৪০ শতাংশের মধ্যে রাখতে সক্ষম হয়েছে। অন্যদিকে ভারত ও পাকিস্তানের ক্ষেত্রে তা ৯০ শতাংশের কাছাকাছি চলে এসেছে। পাকিস্তানের সঙ্গে তুলনায় বলা হয়েছে, ১৯৭১ সালে পাকিস্তান বাংলাদেশের চেয়ে ৭৫ শতাংশ বেশি ধনী ছিল, আর বাংলাদেশ এখন ৪৫ শতাংশ বেশি ধনী। ৫০ বছর আগে গণহত্যা, অপরিচ্ছন্নতা ও ক্ষুধায় মৃত্যুর মধ্যে জন্মলাভ করে বাংলাদেশকে মনে হয়েছিল আশাহীন। বাংলাদেশের অর্থনীতি দ্রুত বেড়েছে। করোনার আগের চার বছরের গড় প্রবৃদ্ধি চীনকেও ছাড়িয়ে গেছে। এর পেছনে অন্যতম রহস্য হলো মেয়েদের শিক্ষা ও কর্মে অংশগ্রহণ।
বাংলাদেশে এখন প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্কুলে ছেলেদের চেয়ে মেয়েদের সংখ্যা বেশি। বাংলাদেশ সবচেয়ে অবহেলিত ও পশ্চাৎপদ জনগোষ্ঠীর পেছনে বিনিয়োগ করেছে। এটা কোনো সহানুভূতি নয়, বরং কোনো জাতিকে এগিয়ে নিতে এটি সাহায্য করছে, যা অন্যান্য দেশের জন্য শিক্ষণীয় হতে পারে। যুক্তরাজ্যভিত্তিক পত্রিকা ফাইন্যান্সিয়াল টাইমস (২৮ জুলাই, ২০২২) লিখেছে, উন্নয়ন বিষয়ে বাংলাদেশ থেকে অন্যরা কি শিক্ষা নিতে পারে? পত্রিকাটি বলছে, ‘দেশের বর্তমান আর্থিক পরিস্থিতির কিছুটা সমস্যা থাকলেও এর দ্রুত অগ্রগতি থেকে আফ্রিকার দেশগুলো শিক্ষা নিতে পারে। বাংলাদেশ দেখিয়ে দেয় প্রকৃতপক্ষে কী করা সম্ভব এবং যারা অতীতের কিছু পারফরমেন্সকে ভবিষ্যতের সম্ভাবনার দিকনির্দেশক মনে করে হতাশা প্রকাশ করে, তাদের জন্য এটি বড় ধরনের তিরস্কার। বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ থেকে জন্মলাভের সঙ্গে সঙ্গে দুর্ভিক্ষ ও রাজনৈতিক গুপ্তহত্যার মুখোমুখি হয়। সে সম্ভাবনাহীন সূচনা থেকে এ সাফল্যের সংস্করণ।’ নিউইয়র্কভিত্তিক ম্যাগাজিন নিউজ-উইক বাংলাদেশকে নিয়ে কয়েকটি আলাদা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। তার মধ্যে একটি হলো ‘অদম্য বাংলাদেশ’। ২০০৯ সাল থেকে শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর বাংলাদেশের অর্থনীতিতে দ্রুত রূপান্তর ঘটেছে এবং আগামী অর্ধশতাব্দীর মধ্যে বাংলাদেশের শুধু আঞ্চলিক পাওয়ার হাউস নয়, বরং বৈশ্বিক পাওয়ার হাউস হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
বোস্টন কনসাল্টিং গ্রুপ বলেছে, ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ ১ ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনীতি হতে যাচ্ছে। ওয়াশিংটনভিত্তিক ম্যাগাজিন ফরেন পলিসি (১০ এপ্রিল, ২০২১) শিরোনাম লিখেছে ‘বাংলাদেশের বাস্কেট কেস থেকে উদীয়মান তারকা হওয়ার দীর্ঘ অভিযাত্রা।’ ৫০ বছরে সব বাধা-বিপত্তি ডিঙিয়ে অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে ব্যাপক অগ্রগতির মাধ্যমে বাংলাদেশ শেষ হাসি দিয়েছে। ম্যাগাজিনটি প্রেক্ষাপট বোঝাতে পুরনো ইতিহাস স্মরণ করিয়ে দিয়েছে।
বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থার পেছনে শেখ হাসিনাকে কৃতিত্ব দেয়া হয়েছে। ভারতের অন্যতম প্রভাবশালী পত্রিকা টাইমস্ অব ইন্ডিয়া (৩ এপ্রিল, ২০২২) লিখেছে, বাংলাদেশ কেন ভারতকে অনেক পেছনে ফেলেছে? ১৪ বছর আগে ২০০৭ সালে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ভারতের মাত্র অর্ধেক ছিল। অথচ গত বছর ভারতকে ছাড়িয়ে গেছে। বাংলাদেশে কর্মক্ষেত্রে নারীদের অংশগ্রহণে ৩৬ দশমিক ৩ শতাংশ, ভারতে ২০ ও পাকিস্তানে ২০ শতাংশ। বাংলাদেশ যে এগিয়েছে নারীর কর্মক্ষেত্রে অধিক অংশগ্রহণ অন্যতম কারণ। শ্রীলঙ্কার ইংরেজি দৈনিক ডেইলি নিউজ (২৫ এপ্রিল, ২০২২) শিরোনাম করেছে ‘শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তান : বাংলাদেশ মডেল থেকে শিক্ষা।’
অর্থনৈতিক সংকট এড়াতে শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তান বাংলাদেশ অর্থনৈতিক মডেল থেকে শিক্ষা নিতে পারে। শ্রীলঙ্কা যখন অর্থনৈতিক মন্দার দিকে ধাবিত হচ্ছে তখন দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার অর্থনৈতিক মিরাকল হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। বাংলাদেশ অভাবনীয় অর্থনৈতিক অগ্রগতির মাধ্যমে আঞ্চলিক যোগাযোগ, ব্যবসা ও বিনিয়োগ সুযোগের উদীয়মান কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে।
পরিপ্রেক্ষিত পরিকল্পনা-২০৪১ অনুযায়ী অর্থনীতিকে আগামী দুই দশকে গড়ে ৯ শতাংশ হারে বাড়াতে হবে। কোভিড-১৯-এর পরিস্থিতি ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ না হলে হয়তো এখন প্রবৃদ্ধি ৯ শতাংশ বা তার কাছাকাছি থাকতো। সে হিসেবে যদি বাস্তবিক প্রক্ষেপণ করা হয়, তাহলে ২০৩৪-৩৫ সালের মধ্যে বাংলাদেশ ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনীতিতে পরিণত হবে, এটা নিশ্চিত। ২০০৯-এর পর থেকে শুরু হওয়া অর্থনৈতিক গতি ২০৪০ সাল পর্যন্ত অব্যাহত থাকলে বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম অর্থনৈতিক শক্তিতে পরিণত হবে। এ কথা বাহুল্য নয়, কারণ চীন তিন দশক পর্যন্ত দুই অঙ্কের প্রবৃদ্ধি বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছিল।
স্টিফান ডারকনের সঙ্গে সুর মিলিয়ে তাই বলতে হয়, ‘বাংলাদেশ ক্রমাগত বিশ্বকে অবাক করে দিতে থাকবে। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় শক্তি হলো- মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাই বাংলাদেশকে অগ্রগতির পথে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। যতক্ষণ পর্যন্ত বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা জাগ্রত থাকবে ততক্ষণ পর্যন্ত বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ অত্যন্ত উজ্জ্বল।
অপ্রতিরোধ্য বাংলাদেশ:
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নানা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যেও শেখ হাসিনার নেতৃত্বে নতুন এক উচ্চতায় দাঁড়িয়ে আছে দেশের অর্থনীতি। অপ্রতিরোধ্য গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে দেশ। গত ১৪ বছরে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বেড়েছে ছয়গুণের বেশি। বিশ্বের ৩৫তম বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ হিসেবে স্থান করে নিয়েছে বাংলাদেশ। বৈশ্বিক সংকটেও সচল রয়েছে রেমিট্যান্স ও রফতানি আয়।
তারা বলছেন, যেখানে অনেক দেশের অর্থনীতির অবস্থা তলানিতে, সেখানে জীবন-জীবিকার সমন্বয় ঘটিয়ে সচল রয়েছে বাংলাদেশের অর্থনীতির চাকা। দীর্ঘ চার দশক ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের এবং ১৯ বছর সরকারের নেতৃত্ব দিচ্ছেন শেখ হাসিনা। তার নেতৃত্বাধীন সরকার টানা তৃতীয় মেয়াদসহ চতুর্থবার দেশ পরিচালনা করছে।
এ সময়ের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ পুনঃপ্রতিষ্ঠা, বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার, যুদ্ধাপরাধের বিচার, সমুদ্রসীমা জয়, ছিটমহল সমস্যার সমাধান, বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের মধ্য দিয়ে মহাকাশ বিজয়, সাবমেরিন যুগে বাংলাদেশের প্রবেশ, নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ ও চালু, মেট্রোরেল, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন, কর্ণফুলী নদীর তলদেশে টানেল নির্মাণ, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, নতুন নতুন উড়াল সেতু নির্মাণ, মহাসড়ক চার লেনে উন্নীতকরণ, এলএনজি টার্মিনাল স্থাপন, খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন, রেকর্ড পরিমাণ রেমিট্যান্স দেশে আনয়ন, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ রেকর্ড পরিমাণ বৃদ্ধি, দারিদ্র্যের হার হ্রাস, গড় আয়ু প্রায় ৭৩ বছরে উন্নীত করা, বিদ্যুতের উৎপাদন ২৫ হাজার মেগাওয়াটে উন্নীত করা ও প্রায় শতভাগ বিদ্যুতায়ন, জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন, সাক্ষরতার হার ৭৫ দশমিক ৬ শতাংশে উন্নীত করা, বছরের প্রথম দিনে শিক্ষার্থীর হাতে বিনামূল্যে নতুন বই পৌঁছে দেয়া, মাদরাসা শিক্ষাকে মূলধারায় সম্পৃক্ত করা ও স্বীকৃতি দান, মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন ও চিকিৎসা ব্যবস্থার আধুনিকায়ন, প্রতি জেলায় বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের উদ্যোগ, নারীনীতি প্রণয়ন ও নারীর ক্ষমতায়ন, ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণ ও আইসিটি খাতে বিপ্লব সাধন, ভূমিহীন ও গৃহহীনকে ঘর প্রদান, দুস্থ ও অসহায়দের সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় আনা, করোনা মহামারি মোকাবিলায় অসামান্য সাফল্যে বাংলাদেশকে দক্ষিণ এশিয়ায় শীর্ষে ও বিশ্বে পঞ্চম স্থানে আসীন করা, দেশকে উন্নয়নশীল বিশ্বের কাতারে শামিল করাসহ বাংলাদেশের এরকম অসংখ্য কালোত্তীর্ণ অর্জনের কারিগর সফল রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনা।
বিশেষজ্ঞরা জানান, আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অর্জন রীতিমতো বিস্ময়কর। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও বড় বড় সংস্থা থেকে তিনি পেয়েছেন নানা স্বীকৃতি। শান্তির প্রচার, অনুসন্ধান ও সুরক্ষার জন্য ইউনেস্কো থেকে পেয়েছেন ‘হুপে-বোয়ানি’ শান্তি পুরস্কার। অর্জন করেছেন ‘মেডেল অব ডিস্টিনকশন’ ও ‘হেড অব স্টেট’ পদক। বিশ্ব শান্তির দূত হিসেবে সর্বভারতীয় শান্তিসংঘ থেকে পেয়েছেন ‘মাদার তেরেইজা পুরস্কার’।
জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবিলায় দূরদর্শী ভূমিকার জন্য বিশ্বের পরিবেশবিষয়ক সর্বোচ্চ স্বীকৃতি ‘চ্যাম্পিয়নস অব দ্য আর্থ’ অর্জন করেছেন। খাদ্য ও কৃষিক্ষেত্রে দীর্ঘকালীন প্রতিশ্রুতি তাকে এনে দিয়েছে ‘দ্য সিরিস মেডেল’। মিয়ানমারের বলপূর্বক বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে ভূষিত হয়েছেন ‘মাদার অব হিউম্যানিটি’ সম্মানে। অর্জন করেছেন জাতিসংঘের ‘আইসিটি টেকসই উন্নয়ন পুরস্কার’।
নারী রাজনীতিবিদদের বৈশ্বিক নেটওয়ার্ক উইমেন পলিটিক্যাল লিডার্স প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ভূষিত করেছে ‘রিজিওনাল লিডারশিপ’ অ্যাওয়ার্ডে। নারী ও কন্যাশিশুদের শিক্ষা প্রসারে অবদানের স্বীকৃতি ‘পিস ট্রি’ অ্যাওয়ার্ড, শিশু ও মাতৃমৃত্যু হার হ্রাস এবং ক্ষুধা ও দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে বিশেষ অবদানের স্বীকৃতি সাউথ-সাউথ পুরস্কার, নারীর ক্ষমতায়নে অসামান্য অবদানের জন্য ইউএন উইমেন প্রদত্ত ‘এজেন্ট অব চেঞ্জ’ পুরস্কার ও ‘প্ল্যানেট ৫০-৫০ চ্যাম্পিয়ন’ অ্যাওয়ার্ড রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনার অর্জনের মুকুটে এক একটি জ্বলজ্বলে পালক।
খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন, সামাজিক নিরাপত্তা প্রদান ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে রাষ্ট্রনায়কোচিত ভূমিকা রেখে তিনি হয়ে উঠেছেন ‘স্টেট ম্যান’। বিশ্ব নেতৃত্ব শেখ হাসিনাকে বলেছেন ‘স্টার অব ইস্ট’। জাতিসংঘের সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট সলিউশনস নেটওয়ার্ক তাকে ‘এসডিজি অগ্রগতি পুরস্কার’ প্রদান করে ‘মুকুট মণি’ অভিধায় ভূষিত করেছে।
এ সবই দূরদর্শী নেতা ও সরকারপ্রধান শেখ হাসিনার অনবদ্য নেতৃত্বের স্বীকৃতি। এখানেই একজন শেখ হাসিনা অনন্য, অপ্রতিদ্বন্দ্বী।
বিবিএস এবং বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে এসব সূচকের প্রথম যে তথ্য পাওয়া যায় তাতে দেখা যাচ্ছে, রফতানি আয় বহুগুণে বেড়ে মিলিয়ন ডলার থেকে এসেছে বিলিয়ন ডলারের ঘরে। ২০২০ সালের হিসাবে যা ৩৯.৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। জিডিপি আকার ২০১৯-২০ অর্থবছরে এসে হয়েছে প্রায় ২৭ লাখ ৯৬ হাজার কোটি টাকা। মাথাপিছু আয় বেড়েছে ১৬ গুণ। হিসাব অনুযায়ী, ২০২১-২২ অর্থবছরের সাময়িক হিসাবে মাথাপিছু আয় দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ৪১ হাজার ৪৭০ টাকা বা ২ হাজার ৮২৪ মার্কিন ডলার।
জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক কাউন্সিলের (ইকোসক) মানদণ্ড অনুযায়ী মানবসম্পদ সূচকে ৬৬ প্রয়োজন হলেও বাংলাদেশ অর্জন করেছে ৭২.৯। অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা সূচক হতে হবে ৩২ শতাংশ বা এর কম, যেখানে বাংলাদেশের রয়েছে ২৪.৮ শতাংশ।
মাত্র ৭ কোটি ৮৬ লাখ টাকার বাজেট নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিল যে দেশ, তা আজ ৬ লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকার, যা জিডিপির ১৫.৪০ শতাংশ। চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটের আকার ৬ লাখ ৩ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা, যা জিডিপির ১৭.৫০ শতাংশ।
শুধু বাজেট কেন, মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপি, মাথাপিছু আয় ও মানবসম্পদ সূচকে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের ব্যবধান ধীরে ধীরে কমে আসছে। অর্থনৈতিক অগ্রগতির সূচকে বিশ্বের শীর্ষ পাঁচটি দেশের একটি এখন বাংলাদেশ।