সবুজ ও নিবিড় জলাশয়ের সম্মিলনে বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ধরণের গহনতাই কাম্য। পাখির কলতান, জ্যোৎস্নার প্রাচুর্য এবং সকল রকম প্রাকৃতিক ঐশ্বর্য থাকতে হয় সেখানে
কাজী মসিউর রহমান
গত ৯ই অক্টোবর মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পিরোজপুর জেলায় সরকারি অর্থায়নে একটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দিয়েছেন। এরকম একটি উদ্যোগের জন্য বর্তমান সরকারের সংশ্লিষ্ট সকলকে কৃতজ্ঞতা জানাই। একই সাথে বিশ্ববিদ্যালয়ের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ ও স্বার্থকতা কামনা করি। স্বার্থকতার কথা বলতে গিয়ে জোড় দিয়ে বলা দরকার যে, বিশ্ববিদ্যালয় কিন্তু একটি গুণবাচক ধারণা ও প্রতিষ্ঠান। মানুষের জীবনের উৎকর্ষ সাধন এবং ‘মুক্ত মানুষের মুক্ত সমাজ’ গড়ার জন্য জ্ঞান উৎপাদন ও চর্চাই এ প্রতিষ্ঠানের প্রধান উদ্দেশ্য । কিন্তু সৃষ্টিশীল উৎপাদনের পূর্বশর্ত হলো স্বাধীনতা। স্বাধীনতা ছাড়া কোনো সৃজন হতে পারে না। স্বাধীনতাহীনতায় প্রাপ্ত জ্ঞান বড় জোর ‘দক্ষ শ্রমিক’ উৎপাদন করতে সক্ষম, আত্মমর্যাদাশীল মানুষ নয়; জ্ঞানী তো নয়ই। স্বাধীনতাই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণ, বিশ্ববিদ্যালয়ের বিমূর্ত ধারণার অংশ।
বিশ্ববিদ্যালয় মূলত একটি বিমূর্ত প্রতিষ্ঠান, যাকে জড়িয়ে থাকে মূর্ত নানা উপকরণ। যেমন- শিক্ষার্থী, শিক্ষক, প্রশাসন, ভৌগোলিক এলাকা, আড়াআড়ি বা খাড়াখাড়ি বিস্তৃত ভৌত অবকাঠামো ইত্যাদি। কিন্তু এসব বিষয়ের গভীরে অদৃশ্য জ্যার মতো একটি আত্মা থাকে। যাকে পঞ্চইন্দ্রিয় দিয়ে চিহ্নিত করা না গেলেও সংবেদনশীল চৈতন্য দিয়ে বেশ অনুভব করা যায়। ওই আত্মাটিই সমস্ত জাহিরি উপকরণের ভেতর দিয়ে একটি সুললিত সুর তৈরি করে গড়ে তোলে বিশ্ববিদ্যালয়।
সাধারণত দুই ধরণের বিশ্ববিদ্যালয় পাওয়া যায়- পাঠদানকেন্দ্রিক ও গবেষণাভিত্তিক। তবে সবচেয়ে বহুল প্রচলিত প্রকরণ হলো এদু’য়ের মিশ্রণ। স্নাতক স্তরে প্রধানত আন্তঃশাস্ত্রীয় পাঠদানের ওপর গুরুত্ব দেয়া এবং স্নাতকোত্তর পর্যায়ে গবেষণাকে জোর দেয়া। আন্তঃশাস্ত্রীয় পাঠদান কেন জরুরী? আন্তনিও গ্রামসি, নোয়াম চমস্কি, টমাস কুন ও ফায়ারাবেনসহ অগণন তাত্ত্বিক মনে করেন- জ্ঞান বিজ্ঞানের বিকাশ প্রশিক্ষণের মধ্য দিয়ে হয় না। বরং এর বিকাশ সংশ্লিষ্ট জ্ঞানের মধ্যকার বিরাজমান স্ববিরোধিতা চিহ্নিত করার মধ্য দিয়ে আসে। শুধুমাত্র প্রায়োগিক বা কারিগড়ি দিক গুরুত্ব পেলে কারগড়ি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মানোন্নয়নের মাধ্যমেই সেটি সম্ভব।
বিশ্বে হাজিরথাকা সাম্প্রতিকতম বিজ্ঞান-প্রযুক্তি এবং ব্যবসায়ে শিক্ষার বৈচিত্র্যময় সকল বিষয়ের পাশাপাশি বিশ্ববিদায়লয়ে মৌলিক মানবিক ও কলা বিদ্যার বিষয়গুলো থাকতে হবে। কারণ উচ্চতর জ্ঞান অবশ্যই আন্তঃশাস্ত্রীয় হতে হবে। গবেষণায় দেখা গেছে- বিষয় কেন্দ্রিক জ্ঞান অন্যান্য বিষয়ে অজ্ঞতা তৈরির সম্ভাবনা রাখে। এমন কি বিশেষজ্ঞরা নিজের বিষয়ের বাইরে জগত-জীবনের অপরাপর বিষয়ে অজ্ঞ থাকার কারণে বিচক্ষণ সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না। আর শুধু বিশেষায়িত জ্ঞান মানুষকে বিভাজিতও রাখে।
আন্তঃশাস্ত্রীয় ও গবেষণামূলক পাঠদানের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের বিমূর্ত সত্ত্বাটিকে কিন্তু আশ্রয় নিতে হয় বিস্তৃত আর নিবিড় কোনো প্রাকৃতিক পরিসরে। এর কারণ হিসেবে বলা যায়, প্রতিবেশের সঙ্গে মানুষের রয়েছে এক বর্ণাঢ্য বন্ধুতা। যদি পরিবেশ হৃদয়গ্রাহী হয়, সেখান থেকে পাওয়া যায় ইতিবাচক আবেগের প্রবহ, প্রাণোচ্ছ্বাস আর সততা নির্মাণের নির্মল প্রেরণা। এর মধ্য দিয়ে ব্যক্তির সঙ্গে অন্যান্য সৃষ্টির এবং মহাজাগতিক আবহের মাঝে এক গভীর সখ্য সৃষ্টি হওয়ার সুযোগ তৈরি হয়। চাপমুক্ত এ রকম পরিসরে চৈতন্য তীব্রতর বিকশিত হতে পারে। শুধু তাই নয়, প্রতিবেশ কাঠামো স্বাস্থ্যকর ও আধ্যাত্মিক হয়ে উঠলে শিক্ষার্থীর চিন্তাচেতনায় আরও বোধগত উন্মেষ ঘটে, আচরণে ইতিবাচকতা নির্মিত হয়, সামাজিকতার আঙ্গিক ও বহুমাত্রিকতার বিবেচনা বিকশিত হয়, যোগাযোগ দক্ষতা হয়ে ওঠে পরিশীলিত, কাঙ্ক্ষিত আবেগের স্ম্ফুরণ ঘটে এবং মস্তিস্কের মটর-নিউরণ বেশি সক্রিয় হয়। অর্জিত জ্ঞানের গাজন আর প্রতিফলন হতে পারে বিশুদ্ধ প্রকৃতিতেই।
সবুজ ও নিবিড় জলাশয়ের সম্মিলনে বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ধরণের গহনতাই কাম্য। পাখির কলতান, জ্যোৎস্নার প্রাচুর্য এবং সকল রকম প্রাকৃতিক ঐশ্বর্য থাকতে হয় সেখানে। আর এসবের জন্য প্রয়োজন হয় বিশাল ভৌগোলিক পরিসর। কারণ ভৌত, সামাজিক, মানসিক, প্রাকৃতিক, বুদ্ধিবৃত্তিক ইত্যাদি সম্পদের তুলনায় তার ওপর নির্ভরশীল জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ভবিষ্যতে বেড়ে গেলে সামান্য সম্পদে কর্তৃত্ব বা দাবী প্রতিষ্ঠার জন্য মানুষ আগ্রাসী ও স্বজাতিবিনাশী (Cannibalistic) হয়ে উঠতে পারে। সেখানে অনিবার্যভাবেই তৈরি হয় ধ্বংসের প্রতিযোগিতা। নিরাপত্তাহীনতার বোধ ছড়িয়ে পড়ে চারিদিকে। ক্ষতিগ্রস্ত হবে শিক্ষা-গবেষণার পরিবেশ। তাই শিক্ষার্থী-শিক্ষকের আদর্শ অনুপাত রক্ষার আন্তরিকতা থাকতে হবে শুরু থেকেই। আদর্শ অনুপাতই নয় শুধু- নিয়োগের ক্ষেত্রে স্থানীয়তাকে মূলত প্রাধাণ্য দিলে বিশ্ববিদ্যালয়ের কসমোপলিটান পরিসর পঙ্গু ও ভঙ্গুর হতে পারে।
একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের নিউক্লিয়াস হলেন উপাচার্য। বিদ্যমান নীতিমালা অনুযায়ী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে উপাচার্যগণ সীমাহীন ক্ষমতার অধিকারি। অথচ ক্ষমতা ও সম্পদের ন্যায়ভিত্তিক বণ্টন না হলে সেখানে স্বেচ্ছাচার তীব্রতর হয়ে ওঠে। বিশ্ববিদ্যালয় স্বৈরাচারী হয়ে উঠলে জনকরে পরিচালিত মুক্তিকামী উচ্চশিক্ষার আদর্শ পরাজিত হয়। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের নিরঙ্কুশ ক্ষমতায় ভারসাম্য সৃষ্টি করে উচ্চশিক্ষাক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের অনুশীলন বাড়াতে হবে। উপাচার্য যদি হন সৎ মানুষ, প্রজ্ঞাবান দার্শনিক ও জনবুদ্ধিজীবী তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্থক হবার সম্ভবনা বাড়ে। তাই উপাচার্য নির্বাচনের ক্ষেত্রে সরকারের অন্যান্য সকল নিরীক্ষণের পাশাপাশি আরও একটি বিশেষ উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে- প্রার্থীদের কাছ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য ভবিষ্যৎ স্বপ্ন ও কর্মপরিকল্পণার ওপর ধারণাপত্র আহ্বান করা যেতে পারে। প্রাপ্ত ধারণাপত্র শিক্ষাবিদ ও বিশেষজ্ঞদের মাঝে উপস্থাপন করানোর আয়োজন করা গেলে যোগ্য ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন উপাচার্য বাছাই করার সুযোগ আরও বৃদ্ধি পাবে।
পরিশেষে বলতে চাই, পিরোজপুরের জন্য অনুমোদনপ্রাপ্ত বিশ্ববিদ্যালয়টি জনগণের আশা-আকাংক্ষার প্রতি সুবিচার করুক। আন্তঃশাস্ত্রীয় মুক্ত জ্ঞান অনুশীলনের মাধ্যমে সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচারসম্মৃদ্ধ বঙ্গবন্ধুর-স্বপ্নের-সোনার-বাংলা বিনির্মাণে অগ্রণী ভূমিকা পালন করুক। দেশকে এনে দিক জ্ঞানবিজ্ঞানে বৈশ্বিক পরিচিতি আর মানুষের জন্য নিয়ে আসুক ৭ই মার্চের প্রস্তাবিত সেই কাঙ্ক্ষিত ‘মুক্তি’।
লেখক: শিক্ষক
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
গোপালগঞ্জ।