পবিত্র ঈদুল
ফিতরকে সামনে রেখে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পাদুকা শিল্পের জৌলুসে ভাটা পড়েছে। অন্যান্য বছর
বৃহৎ এ উৎসবকে সামনে রেখে জেলার পাদুকা পল্লীতে চরম ব্যস্ততা থাকলেও এবারের চিত্র ভিন্ন।
নেই তেমন কাজের অর্ডার। এতে করে কারখানা মালিকদের কপালে যেমন চিন্তার ভাজ রয়েছে, তেমনি
হতাশ পাদুকা শিল্পের সাথে জড়িত কারিগররাও। ব্যবসায়ীদের মতে, অর্থনৈতিক মন্দার আচ লেগেছে
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পাদুকা শিল্পে। এছাড়াও লোডশেডিংসহ নানা সমস্যা থাকায় সম্ভাবনাময় এই
শিল্পটি এখন অনেকটাই হুমকীর মুখে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ১৯৬৩ সাল থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলায় পাদুকা শিল্পের যাত্রা শুরু। নান্দনিক ডিজাইন ও গুনগত মান ভাল হওয়ায় ক্রমেই বিকাশ ঘটতে থাকে এ শিল্পের। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে এখানকার জুতার চাহিদা রয়েছে। তবে গেল কয়েক বছর ধরে ধ্বস নেমেছে জেলার গুরুত্বপূর্ণ এই শিল্প খাতে। মাত্র কয়েক বছর আগেও জেলায় ৫ শতাধিক পাদুকা কারখানা থাকলেও এখন তা কমে দাঁড়িয়েছে প্রায় দেড়শতে। কোন রকমে টিকে থাকা অবশিষ্ট কারখানাগুলোও চলছে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। এসব কারখানার মধ্যে ২৫টি অটোমেটিক মেশিন এবং বাকিগুলোতে হাতেই তৈরী হচ্ছে লেডিস, জেন্টস, শিশুদের জন্য বিভিন্ন ডিজাইনের জুতা। দেশব্যাপী এখানকার জুতার কদর থাকলেও চামড়াসহ প্রয়োজনীয় উপকরণের মূল্য বেড়ে যাওয়ায় এবং জুতার তৈরীর কাঙ্খিত অর্ডার না থাকায় ঈদ মৌসুমেও তাদের ব্যস্ততা অনেক কম।
ব্যবসায়ীরা
জানিয়েছেন, করোনার পর অর্থনৈতিক মন্দার প্রভাব পড়েছে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পাদুকা শিল্পে।
অন্যান্য বছর ঈদ মৌসুমকে সামনে রেখে জুতা তৈরীর ব্যাপক ধূম থাকে। তবে এ মৌসুমে কাঙ্খিত
অর্ডার মিলছে না। আর যেটুকু জুতা তৈরীর অর্ডার মিলেছে লোডশেডিংয়ের কারণে তাও করতে গিয়ে
বিপাকে পড়তে হচ্ছে। প্রায় প্রতিদিনই লোডশেডিং হয়। এতে করে সঠিক সময়ে জুতা উৎপাদন যেমন
বিঘ্নিত হচ্ছে তেমনি আর্থিক লোকসানও হচ্ছে। সে সাথে জুতা তৈরীর উপকরণের মূল্য বৃদ্ধির
পাশাপাশি মন্দার প্রভাবে কাজ কমে যাওয়ায় কারখানা টিকিয়ে রাখতে তাদের হিমশিম খেতে হচ্ছে।
এদিকে, জেলায় থাকা অটোমেটিক মেশিন কারখানার সাথে পাল্লা দিয়ে কুলিয়ে উঠতে না পেরে হুমকীর মুখে রয়েছে শতাধিক হাতে জুতা তৈরীর আদি কারখানাগুলো। এতে মালিক লাভবান না হওয়ায় কারিগররাও ন্যায্য মজুরি পাচ্ছেন না। ফলে আর্থিক সংকটের কারণে অনেক কারিগর পেশা পাল্টাচ্ছেন । তারা এ শিল্পটিকে টিকিয়ে রাখতে সরকারের সহযোগিতা কামনা করেছেন।
পাদুকা শিল্পে কর্মরত কয়েকজন কারিগরের সাথে কথা হলে তারা জানান, অটোমেটিক মেশিন কারখানাগুলোর সাথে তাল মিলিয়ে চলতে আদি কারখানাগুলোকে হিমশিম খেতে হচ্ছে। কারণ হাতে জুতা তৈরীর কারখানার শ্রমিকদের এডভান্স দিতে হয়, দৈনকি খরচ দিতে হয়। কিন্তু অটোমেটিক মেশিন কারখানাগুলোতে এমনটা নয়। সেখানে প্রতিমাসের কাজ বুঝে মাসিক ভিত্তিতে তাদের পারিশ্রমিক দিতে হয়। এছাড়া সেখানে কম সময়ে অধিক জুতা উৎপাদিত হয়ে থাকে। মূলত এসব কারণে খরচ বেড়ে যাওয়ায় ও বাজার মূল্যের প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে আদি কারখানাগুলোর দুর্দিন চলছে। তারা আরো জানান, চামড়াসহ জুতা তৈরীর সকল উপকরণের দাম বেড়েছে কিন্তু জুতার দাম তেমন বাড়েনি। এতে করে মালিক লাভবান না হওয়ায় শ্রমিকরাও ন্যায্য মজুরি পাচ্ছেন না। দৈনিক ১০/১২ ঘন্টা কাজ করেও দৈনিক ৫শ থেকে ৬শ টাকা মিলে। বর্তমানে সব জিনিসের দাম বেড়ে যাওয়ায় যে মজুরি পাওয়া যায় তা দিয়ে চলা মুশকিল। এতে পরিবার পরিজন নিয়ে কষ্টেই দিন কাটে। এই শিল্পটিকে টিকিয়ে রাখতে হলে উপকরণের মূল্যবৃদ্ধির উপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ আনতে হবে।
এ বিষয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া
ফুট ওয়ের এসোসিয়েশন (অটো কারখানা) সাধারণ সম্পাদক মোঃ হানিফ মিয়া বলেন, দেশের অর্থনৈতিক
মন্দার কারণে এবার জুতার চাহিদা অনেক কম। জেলায় পাদুকা শিল্পের ইতিহাসে এবারই এত কম
চাহিদা লক্ষ্য করা গেছে। তিনি আরো বলেন, লোড শেংয়ের কারণে উৎপাদন বিঘ্নত হয়। ঈদ মৌসুমকে
সামনে রেখে লোডশেডিং না হলে উৎপাদন বাড়ার পাশাপাশি পাদুকা শিল্পের সাথে জড়িতরাও লাভবান
হত। তিনি এই শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে সরকারি সহযোগিতার দাবী জানান।
এদিকে হাতে
তৈরী জুতা কারখানা- ওয়ান্ডার সুজের মালিক মোঃ ওয়াসিম জানান, উপকরণের অত্যাধিক মূলবৃদ্ধির
কারণে আমাদের মারাত্মক আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে। জুতা উৎপাদনে যে খরচ হচ্ছে। বাজারে তেমন
দাম পাওয়া যাচ্ছে না। পাশাপাশি অটো কারখানাগুলো উৎপাদন খরচ কম থাকায় তারা কমে জুতা
বিক্রী করতে পারছে। যা আদি কারখানাগুলোর জন্য কঠিন। এতে করে উৎপাদন ও মুনাফার মধ্যে
ঘাটতি থাকায় আদি কারখানাগুলোর অবস্থা নাজুক। সরকারের পক্ষ থেকে সহজ শর্তে ঋণ সুবিধা
পাওয়া গেলে ব্যবসার আধুনিকতার মাধ্যমে এই শিল্পটিকে টিকিয়ে রাখা সম্ভব।