চাহিদা মেটাতে
বাংলাদেশ থেকে কর্মী নিতে মুখিয়ে রয়েছে মালয়েশিয়া। এ লক্ষ্যে সব ধরনের নির্দেশনা চূড়ান্ত
করার পাশাপাশি প্রায় দেড় লাখ ভিসা অনেকটা প্রস্তুত করে রেখেছে দেশটি। কিন্তু বাংলাদেশের
দিক থেকে সিদ্ধান্তহীনতায় দেখা দিয়েছে চরম অনিশ্চয়তা। সমঝোতা স্মারক সইয়ের দুই মাস
অতিবাহিত হলেও দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি দেখা যায়নি। চূড়ান্ত হয়নি কারিগরি বিষয়গুলোও।
এতে বহুল আকাঙ্খিত বাজারটি নেপালের দিকে ঝুঁকে পড়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। তাঁরা
বলেছেন, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের উদাসীনতার মাশুল গুণতে হতে পারে কয়েক লাখ বেকার কর্মীদের।
মালয়েশিয়ার
একাধিক সূত্রের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নিয়োগদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোরে চাহিদার প্রেক্ষিতে
আগামী ২৮ ফেব্রুয়ারির মধ্যে এক লাখ ৪৩ হাজার ভিসা অনুমোদন দেবে মালয়েশিয়ার পররাষ্ট্র
মন্ত্রণালয়। চাহিদাপত্রটি যাবে মালয়েশিয়াস্থ বাংলাদেশ হাইকমিশনে। তারপর সরেজমিন পরিদর্শন
করে নিয়োগদাতার সক্ষমতা যাচাই করে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেবে হাইকমিশন। মালয়েশিয়া সরকার
বাংলাদেশের ২৫টি এজেন্সীর মাধ্যমে চাহিদানুযায়ী কর্মীদের নিতে চায়।
দায়িত্বশীল
সূত্র জানায়, কর্মীদের চাহিদাপত্র থেকে শুরু করে নিয়োগের সকল প্রক্রিয়া ডিজিটালাইজড
হওয়ায় বাংলাদেশ দূতাবাসকেও সংযুক্ত করার আগ্রহ দেখায় মালয়েশিয়া। এর ধারাবাহিকতায় মালয়েশিয়া
সরকার কর্তৃক দায়িত্বপ্রাপ্ত সিস্টেম প্রভাইডার বাংলাদেশ দূতাবাসের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের
জন্য ডাটা ডাউনলোডসহ সংশ্লিষ্ট কার্যক্রমের জন্য প্রশিক্ষণ এবং প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশ
স্থাপনের আবেদন করেছে। কিন্তু বাংলাদেশ থেকে মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা না পাওয়ায় এ বিষয়ে
কোনো কার্যক্রম গ্রহণে অপারগতার কথা স্বীকার করেছে হাইকমিশন। এর ফলে মালয়েশিয়ায় কর্মী
পাঠানোর বিষয়টি আটকে রয়েছে।
হাইকমিশন সূত্র
জানায়, মালয়েশিয়া চাহিদাপত্র অনুমোদন দেয়া শুরু করলেও সত্যায়ন কার্যক্রম শুরু না হলে
কর্মী পাঠানোর কার্যক্রম বিলম্বিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এ বিষয়ে মন্ত্রণালয় থেকে তারা
কোনো নির্দেশনা পাননি। সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, বিদ্যমান পরিস্থিতিতে মালয়েশিয়ায় কর্মী
পাঠানোর কার্যক্রম কবে শুরু হবে বা কবে থেকে কর্মী যাবে, তা সম্পূর্ণ নির্ভর করছে বাংলাদেশের
সিদ্ধান্তের ওপর।
সূত্র আরও জানিয়েছে,
মালয়েশিয়ার দিক থেকে সবকিছু দ্রুত ও সাবলীলভাবে এগোলেও অনিয়শ্চয়তা সৃষ্টি হয়েছে বাংলাদেশ
থেকে। গত ১৮ ফেব্রুয়ারি মালয়েশিয়াকে একটি চিঠি দেয় প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান
মন্ত্রণালয়। এতে বলা হয়, মালয়েশিয়া কর্মী নিয়োগের জন্য যে ডিজিটালাইজেশন প্রক্রিয়া
সৃষ্টি করেছে, তাতে যেন বাংলাদেশকে যুক্ত করা হয়। কিন্তু এ বিষয়ে আপত্তি রয়েছে মালয়েশিয়ার।
দেশটি কর্মী নেওয়ার ক্ষেত্রে ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ডসহ ১৪টি
দেশের সঙ্গে বিদ্যমান প্রক্রিয়ার মতোই বাংলাদেশ থেকে কর্মী নিতে চায়।
সংশ্লিষ্টদের
সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এবার সবকিছু স্বাভাবিকভাবে শুরু হলে আগামী দুই বছরে অন্তত
পাঁচ লাখ কর্মীর মালয়েশিয়ায় পাড়ি জমানোর সুযোগ হবে। এ ছাড়া অভিবাসন ব্যয়ও আগের তুলনায়
কমিয়ে আনার চিন্তাভাবনা চলছে। একটি সূত্র জানায়, সরকার এবার কর্মীপ্রতি অভিবাসন ব্যয়
এক লাখ ৬০ হাজার টাকা নির্ধারণ করতে যাচ্ছে।
মন্ত্রণালয়ের
একাধিক সূত্রের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠাতে সরকার আন্তরিক। এ
লক্ষ্যে কারিগরি বিষয়গুলো নির্ধারণে কাজ চলছে। কর্মীদের অভিবাসন ব্যয় কত হবে, ডাটা
ব্যাংকে নিবন্ধন করা প্রয়োজন কি-না, প্রয়োজন হলে কবে থেকে চালু হবে, বাংলাদেশে একটি
অনলাইন পদ্ধতি চালু করা ও মালয়েশিয়া সরকারের কেন্দ্রীয় অনলাইন পদ্ধতির সঙ্গে এই পদ্ধতি
কিভাবে যুক্ত হবে। এ ধরনের বিষয়গুলো নিয়ে চিন্তাভাবনা চলছে। তবে কোনো বিষয়েই সরকার
চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে আসতে পারেনি।
একাধিক রিক্রুটিং
এজেন্সীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এতে বিদেশ গমনেচ্ছু কর্মীদের মাঝে হতাশা বাড়ছে।
করোনার কারণে দীর্ঘ সময় ধরে তাঁরা অপেক্ষমান। প্রায় ৪০ মাস পরে দেশটিতে সম্ভাবনার দুয়ার
খুলেছে। এতে কর্মীদের মাঝে যে আশার সঞ্চার ঘটেছে, সেটি নিমিষেই ডুবতে যাচ্ছে কি-না,
সেই আলোচনা শুরু হয়ে গেছে ইতি মধ্যে।
প্রবাসী কল্যাণ
ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান বিষয়ক মন্ত্রী ইমরান আহমেদ জানুয়ারিতে এক অনুষ্ঠানে বলেছিলেন,
বিএমইটির অধীনে ডাটাব্যাংক থেকে কর্মী পাঠানো হবে। এ বিষয়ে মন্ত্রীর বক্তব্য, ‘মালয়েশিয়ার বাজার নিয়ে অতীতে অনেক
কিছু হয়েছে। আমি দায়িত্ব নেওয়ার পর অতীতকে দূর করার চেষ্টা করছি। আমার আগের যে প্রতিশ্রুতি
ছিল সেটি এখনো আছে। আমি কোনো সিন্ডিকেটের পক্ষপাতী না।’
অন্যদিকে রিক্রুটিং
এজেন্সীগুলোর ভাষ্য, জিটুজি প্লাস-এর আওতায় রিক্রুটিং এজেন্সীগুলো যেসব প্রতিশ্রুতি
দিয়ে কর্মীদের পাঠিয়েছিল, সেগুলো প্রতিটি ক্ষেত্রে বাস্তবায়ন হয়েছিল। কর্মীদের তরফ
থেকে কোনো অভিযোগ ছিল না। সেটিকে মডেল ধরে এবারও একই পদ্ধতিতে কর্মী পাঠানো উচিত। কিন্তু
একটি পক্ষ বিষয়টিকে ঘোলাটে করে তুলেছে। তারা কর্মীদের স্বার্থকে গৌণ রেখে নিজেদের স্বার্থকে
মুখ্য করে তোলার চেষ্টা করছেন। এ জন্য তারা নানাভাবে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে যাচ্ছে।
জানতে জনশক্তি
কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) মহাপরিচালক শহিদুল আলম বলেছেন, তাঁরা মালয়েশিয়া
থেকে চাহিদাপত্রের জন্য অপেক্ষা করছেন। দেশটির চূড়ান্ত চাহিদাপত্র এলে কাজ দ্রুত এগিয়ে
নেওয়া হবে। মালয়েশিয়া থেকে বিষয়টি অনলাইনে যে প্রক্রিয়ায় আসার কথা, সেভাবে আসেনি এখনও।
এ ছাড়া অভিবাসন ব্যয় নির্ধারণ ও নিয়োগদাতাদের চাহিদা অনুযায়ী কার্যক্রম পরিচালনাসহ
অন্যান্য কারিগরি ও নীতি নির্ধারণী কাজ হাইকমিশন করছে।
জনশক্তি রফতানিকারকদের
একমাত্র সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সিজের (বায়রা)
সাবেক সভাপতি বেনজির আহমেদ বলেছেন, আমরা চাই দ্রুত বাজার উন্মুক্ত হোক, বেকার কর্মীরা
বিদেশে যাক। কেননা দীর্ঘদিন ধরে কয়েক লাখ কর্মী মালয়েশিয়ায় যাওয়ার জন্য উন্মুখ। দীর্ঘ
তিন বছর পর দেশটিতে কর্মী পাঠানোর দুয়ার খুললেও দুর্ভাগ্যজনকভাবে জট খুলছে না। পুরো
প্রক্রিয়াটি এখনও অনিশ্চিত। এতে কর্মীদের মাঝে হতাশা বাড়ছে।
তিনি আশঙ্কা
প্রকাশ করে বলেন, উভয় দেশ সরকারি পর্যায়ে দ্রুত আলোচনায় বসতে না পারলে মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশি
কর্মীদের সুযোগ সংকীর্ণ হয়ে আসতে পারে। এমনকি বহুল আকাঙ্খিত বাজারটি হাতছাড়াও হতে পারে।
তিনি বলেন, সমঝোতা স্মারক সইয়ের পর দুই মাস অতিবাহিত হয়ে গেলেও সরকার এখন পর্যন্ত এ
বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্তে আসতে পারেনি। কভিড-১৯ পরিস্থিতিতে সৃষ্ট স্থবিরতা কাটিয়ে মালয়েশিয়ায়
বর্তমানে কর্মীর চাহিদা অনেক বেড়েছে। বাংলাদেশের সামনে অবারিত সুযোগ। আরেকটু বিলম্বিত
হলে এই সম্ভাবনা নেপালের দিকে মোড় নিতে পারে।
বায়রার সদস্য
লেফটেনেন্ট জেনারেল (অবসরপ্রাপ্ত) মাসুদ উদ্দিন চৌধুরী এমপি বলেন, সমঝোতা স্মারক সইয়ের
পর কর্মীরা আশাবাদী হয়েছিল। আমরাও আশাবাদী হয়েছিলাম যে পুরোনো মার্কেটটি খুলল। কিন্তু
এখন পর্যন্ত দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি দেখছি না। পুরো ব্যাপারটি চলছে অত্যন্ত ধীরগতিতে।
এতে বাজার হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার যথেষ্ঠ শঙ্কা দেখা দিয়েছে। অনেক দেশ মালয়েশিয়ায় কর্মী
পাঠাতে মুখিয়ে রয়েছে। তারা এই সুযোগটি কাজে লাগাতে উন্মুখ হয়ে আছে। বাংলাদেশ একটু হোঁচট
খেলেই ওই দেশগুলো এ সুযোগ লুফে নিবে।
মালয়েশিয়ার
মানবসম্পদ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, গত ১৯ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ১ লাখ ৪৬ হাজার ৩২
জন কর্মীর চাহিদা জানিয়ে আবেদন করেছেন নিয়োগদাতারা। এরইমধ্যে ৩০ হাজারের বেশি কর্মীর
চাহিদাপত্রে অনুমোদন দিয়েছে দেশটির সরকার। একইসঙ্গে বাংলাদেশের জন্য মেয়াদোত্তীর্ণ
পুরাতন চাহিদাপত্র নতুন করে অনুমোদন দেয়া হচ্ছে।
এর আগে দীর্ঘ
৪০ মাস বন্ধ থাকার পর মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার খুলতে গত বছরের ১৯ ডিসেম্বর সমঝোতা স্মারকে
সই করে দুই দেশ। এর এক মাস পর থেকেই কর্মী পাঠানো শুরু করার কথা ছিল। কিন্তু এই অনাকাঙ্খিত
কালক্ষেপণে অপেক্ষমান কর্মীদের হতাশা বাড়ছে। অনেকের পাসপোর্টের মেয়াদ শেষ হয়ে যাচ্ছে।
আবার কারো কারো মালয়েশিয়া যাওয়ার নির্ধারিত বয়সসীমা পার হয়ে যাচ্ছে।
অবশ্য মন্ত্রণালয়
সূত্র বলেছে, মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠাতে কারিগরি বিষয়ে কাজ করছেন সংশ্লিষ্টরা। কর্মীদের
দেশটিতে যেতে খরচ বা অভিবাসন ব্যয় কত হবে, ডাটা ব্যাংকে নিবন্ধন করা প্রয়োজন কিনা আর
প্রয়োজন হলে কবে থেকে চালু হবে, বাংলাদেশে একটি অনলাইন পদ্ধতি চালু করা এবং মালয়েশিয়া
সরকারের কেন্দ্রীয় অনলাইন পদ্ধতির সাথে এই পদ্ধতি কিভাবে যুক্ত হবে, এমন নানা বিষয়ে
আলোচনা ও কাজ করছে মন্ত্রণালয়।