মো: রেদওয়ানুল হক মিলন, ঠাকুরগাঁও
আসমানীরে দেখতে যদি তোমরা সবে চাও, রহিমদ্দির ছোট্ট বাড়ি রসুলপুরে যাও। বাড়ি তো নয় পাখির বাসা ভেন্না পাতার ছানি, একটুখানি বৃষ্টি হলেই গড়িয়ে পড়ে পানি। একটুখানি হাওয়া দিলেই ঘর নড়বড় করে, পেটটি ভরে পায় না খেতে, বুকের ক-খান হাড়, সাক্ষী দিছে অনাহারে কদিন গেছে তার। আসমানীদের দৈন্যতার কথা পল্লীকবি জসীম উদ্দীন তার আসমানী কবিতায় এভাবেই তুলে ধরেছেন। রসুলপুরের আসমানীর সেই বাড়িকেও হার মানিয়েছেন ফাতেমা বেগমের জরাজীর্ণ বাড়িটি।
ঘরটির টিনের ছাউনিতে মরিচা ধরেছে, ছিদ্র হয়েছে অসংখ্য। সেই ছিদ্র দিয়ে গোনা যায় রাতের আকাশের তারা। খুঁটির অভাবে একদিকে হেলে পড়েছে ছোট্ট ঘরটি। যে খুঁটি রয়েছে তাও আবার নড়বড়ে। সামান্য বাতাসেই উল্টে পড়ে যাবে ঘরটি। হেলেপড়া ঘরের দরজা গলিয়ে ঘরে প্রবেশে ও বাইরে যাওয়াই দায়। ঘরে নেই কোনো আসবাব। ঘরটি জরাজীর্ণ পাটখড়ির হলেও মেরামত করার মতো আর্থিক সামর্থ নেই তার।
বলছিলাম ঠাকুরগাঁও সদরের মথুরাপুর এলাকার তিন সন্তানের জননী ফাতেমা বেগম (৪০)'র কথা। যিনি সারাদিন বাসা-বাড়িতে কাজ করে সংসার ও সন্তানকে পড়াশোনা করান। স্বামী মুনসুর আলী (৪৮) শারীরিক অসুস্থ্যতার তেমন কাজ করতে পারে না। তাই সংসারের পুরো ভার এসে পরে ফাতেমা বেগমের কাঁধে। নিজের কোন জমি জায়গা না থাকায় ওই এলাকার রুসুল আলমের জমিতে পাটখড়ি দিয়ে কোন মতো একটি ঘর তৈরী করে বসবাস করছেন। শীত বর্ষায় এ ঘরেই রাতযাপন করেন তারা। তার এক কোণে চলে রান্নার কাজ। এভাবেই অন্যের জমিতে বছরের পর বছর বসবাস করছেন ভূমিহীন ফাতেমা বেগমের পরিবার।
স্থানীয়রা জানান, বছর কয়েক আছে অন্যের জমিতে থাকার জন্য ঘরটি তৈরি করেন ফাতেমার স্বামী মুনসুর আলী। সংসার চলে অন্যের বাড়িতে কাজ করে। শত কস্টের মাঝেও তিনি সন্তানদের পড়াশোনা থেকে বঞ্চিত করেননি। দুই ছেলে ও এক মেয়ে নিয়মিত স্কুলে পাঠায়। কিন্তু ঝড়বৃষ্টিতে অবর্ণনীয় কষ্ট পোহাতে হয় তাদের। কখনো কখনো ঘর ছেড়ে সন্তানদের নিয়ে চলে যায় কোন আত্নীয়ের বাড়িতে। অথচ ভূমিহীন ও গৃহহীনদের জন্য প্রধামন্ত্রীর আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর জোটেনি তাদের ভাগ্যেই।
প্রতিবেশী মাসুমা, আক্তারা বলেন, তারা অনেক (ফাতেমা বেগমের পরিবার) জীবন-যাপন করে। একটি ঘরেই সবাই থাকে। একটু ঝড়বৃষ্টি হলেই ঘরটা ভেঙ্গে যাবে। ঘরের জন্য ভূমি অফিসে আবেদন করলেও একটি ঘর দেওয়া হয়নি। উল্টো যাদের সম্পদ আছে, ঘর আছে, তারাই প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক বরাদ্দ উপহারের ঘর পাচ্ছে। তার কিছুই নেই তার পরেও সরকারি অনেক সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
কথা হয় ফাতেমা বেগমের সাথে, কথার মাঝে তিনি বলেন আমি অনেক গরিব। অন্যের বাসায় কাজ করে কোনমতে জীবনযাপন করি। কোন রকমে থাকার মত একটি ঘর ছাড়া কিছুই নেই আমাদের। তা আবার অন্যের জমিতে ঘর বেঁধে আছি। জানি না কখনো চলে যেতে বলে। তখন ছেলে-মেয়েদের নিয়ে কথায় যাবো। সরকারি ঘরের জন্য আবেদন করেছি। আমাকে বলেছিলো ঘর দিবে। কিন্তু আজ পর্যন্ত সেই ঘর পেলাম না। আমার স্বামী অসুস্থ্য একদিন কাজ করলে তিন দিন কাজ করতে পারে না। বড় ছেলেটা এবার এসএসসি পরিক্ষা দিচ্ছে ছোট ছেলেটা ক্লাশ সিক্স ও মেয়েটা ক্লাশ ফাইভ এ পড়ে। তাদের পড়াশোনার খচর চালাবো না, নিজে খাবো। আমাকে একটি ঘরের ব্যবস্থা করে দিলে খুবই উপকৃত হবো।
কেমন আছেন? দিনকাল কেমন যাচ্ছে এমন প্রশ্নের জবাবে মুনসুর আলী বলেন, ভালো নেই। আমার থাকার ঘর নাই। ছুয়া তিনডা অনেক ব্রেন পড়াবা পারুনা। ছুয়ালার মা কাজ করে যা আয় করে তাই খাই। কুনদিন না খাহেনে থাকি।
স্থানীয় কয়েকজন স্বেচ্ছাসেবী জানান, তাদের স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের মাধ্যমে ফাতেমা বেগমের ঘরটি মেরামতের উদ্যোগ নিলেও অন্যের জমি হওয়ায় তা করতে পারেননি তারা। তাই সরকারিভাবে তাদের জন্য একটি ঘরের দাবি করেন তারা।
ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা আবু তাহের মোঃ সামশুজ্জামান বলেন, বিষয়টি আমি জানতাম না। পরিবারটির ব্যাপারে খোঁজ খবর নিয়ে ঘর দেওয়ার ব্যবস্থা করা হবে।