আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে এখন থেকেই কৌশল সাজাচ্ছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। বিএনপি যখন জাতীয় সরকারের রূপরেখা নিয়ে ভাবছে, তখন সেটা আমলে না নিয়ে আওয়ামী লীগ ছক সাজাচ্ছে। দলটি অন্তত ২০০ আসন নিশ্চিত করতে চায়। আওয়ামী লীগের নীতি-নির্ধারকদের কয়েকজন বলেন, বিএনপির নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা না-করা নিয়ে একাধিক বিকল্প কৌশল ভেবে রেখেছেন তারা। বিএনপি নির্বাচন বর্জন করলে নিবন্ধিত বেশিরভাগ দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে চায় আওয়ামী লীগ। সে ক্ষেত্রে তাদের ১০০ আসন ছেড়ে দেওয়া হবে। এতে করে নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হয়নি এমন দাবি করার সুযোগ পাবে না কেউ।
আওয়ামী লীগের নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ের কয়েকজন নেতা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্র সফরে গিয়ে বিএনপিকে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে আনতে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন দেশটির সহযোগিতা চেয়েছেন বলে গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়েছে। বিষয়টি আওয়ামী লীগের নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ে ভীষণ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে। তারা বলেছেন, বিএনপিকে নির্বাচনে আনার ব্যাপারে সহযোগিতা চাওয়া আওয়ামী লীগের নীতিবিরুদ্ধ। যদিও পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, তিনি এমন অনুরোধ করেননি।
দলটির নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ের কয়েকজন নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এখন সেই অবস্থান থেকে সরে দাঁড়িয়েছে ক্ষমতাসীনরা। যুক্তরাষ্ট্র সফরে ঘটনা যাই ঘটুক সেখানে সহযোগিতা চাওয়ার ওই বিষয়টি এখন নেতিবাচক হিসেবে না দেখে এটিকে পুঁজি করতে চায় আওয়ামী লীগ। একাধিক নেতা বলেন, নির্বাচন নিয়ে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে বিএনপির অভিযোগ আমলে নেবে না জনগণ। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে বিএনপির অংশগ্রহণ দেখতে চায় আওয়ামী লীগ সেটিই প্রমাণ হয়। যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতা চাওয়ার বিষয়টি দেশের মানুষের কাছে তুলে ধরতে সহজ হবে ক্ষমতাসীনদের। নির্বাচন বর্জন করুক বিএনপি সেটি যে চায় না আওয়ামী লীগ তা বিশ্বাসযোগ্য করাতে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সহযোগিতা চাওয়ার বিষয়টি উদাহরণ হিসেবে সামনে তুলে ধরা যাবে।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর গুরুত্বপূর্ণ একজন সদস্য বলেন, বিএনপিবিহীন আগামী নির্বাচন অনুষ্ঠানে যাতে প্রশ্ন না ওঠে সে জন্য অধিকাংশ নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলকে নির্বাচনে আনার উদ্যোগ নেওয়া হবে। বিকল্প একাধিক কৌশলের একটি এটি। এ ক্ষেত্রে বিএনপির মিত্র রাজনৈতিক দলগুলোকে নির্বাচনে আনার জন্য বেশি চেষ্টা করা হবে। তাদের বশে আনতে ব্যক্তিগত পর্যায়ের যোগাযোগ বাড়ানোর চেষ্টা করবে আওয়ামী লীগ। গণমাধ্যম আয়োজিত ‘টক শো’ থেকে শুরু করে সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের নানা আয়োজনসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ক্ষমতাসীন দলের নেতারা বেশি বেশি অংশ নেবেন, যাতে ওই সব অনুষ্ঠানে বিএনপির মিত্রদের সঙ্গে মিলিত হতে পারেন। এর মাধ্যমে প্রাথমিক আলোচনা এগিয়ে নেওয়ার কাজ করা হবে। আলোচনা চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছালে আওয়ামী লীগের নীতি-নির্ধারণী পর্যায় থেকে বৈঠক করা হবে।
আওয়ামী লীগ দলীয় সূত্রে জানা গেছে, বিএনপির জাতীয় সরকারের ধারণা নিয়ে তার মিত্র কয়েকটি দলের সঙ্গে ভিন্নমত রয়েছে। ওই দলগুলো চায় নির্বাচনের আগে জাতীয় সরকার। আর বিএনপি চায় নির্বাচনের পরে জাতীয় সরকার করতে। এ নিয়ে এখনো তাদের দূরত্ব ঘোচেনি। ধর্মভিত্তিক একটি নিবন্ধিত দলও ইতিমধ্যে নির্বাচনের আগে জাতীয় সরকারের দাবি তুলেছে। এই সুযোগটি নিতে চায় আওয়ামী লীগ।
আওয়ামী লীগের সম্পাদকমন্ডলীর গুরুত্বপূর্ণ এক সদস্য বলেন, আগামী নির্বাচনে ধর্মভিত্তিক দলগুলোর অংশগ্রহণ বাড়াতে চেষ্টা করবে ক্ষমতাসীনরা। এ ক্ষেত্রে ক্ষমতাসীন জোটের শরিক নেতাদের কাজে লাগানো হবে। ওই নেতা আরও জানান, সরকারবিরোধী কিছু বামপন্থী দল আছে তাদের সঙ্গেও আলোচনা করবে সরকার সমর্থক বামদলগুলো। আওয়ামী লীগের একাধিক গুরুত্বপূর্ণ নেতা বলেন, নিবন্ধিত সব দল আসবে এমনটা নয়, যত বেশি দলকে নির্বাচনে আনা যায়, সেই চেষ্টা করবে সরকারি দল। তাতে করে বিএনপির নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার বিষয়টি মাটিচাপা পড়ে যাবে। আর এভাবে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে দেশে-বিদেশের সমালোচনা মোকাবিলা করা হবে।
আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন বলেন, ‘পররাষ্ট্রমন্ত্রীর আমেরিকা সফরে বিএনপিকে নির্বাচনে আনার সহযোগিতার বিষযটি প্রসঙ্গক্রমে আসতে পারে। নিছক বাত কা বাত। সেটি আওয়ামী লীগের কোনো অফিশিয়াল উদ্যোগ নয়।’ তিনি বলেন, ‘দেশের অভ্যন্তরীণ সমস্যা নিয়ে বিদেশিদের কাছে ধরনা আওয়ামী লীগ কখনোই দেবে না। বাঙালির আপন প্রধানমন্ত্রী একজন জগদ্বিখ্যাত পলিটিশিয়ান, রাষ্ট্রনায়ক। তিনি থাকতে আমাদের অন্য রাষ্ট্রের দ্বারস্থ হতে হবে না। তা ছাড়া বিএনপিকে নির্বাচনে আনার দায়িত্ব আওয়ামী লীগের নয়। আমরা বিএনপির নির্বাচনে আসার পথ রুদ্ধ করতে আগ্রহী নই। তবে জাতীয় নির্বাচনে এত বড় মনোনয়ন-বাণিজ্য বিএনপি মিস করবে না।’
আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের একাধিক নেতা বলেন, বিএনপি নির্বাচনে না এলে অন্য দলগুলোকে নির্বাচনে নিয়ে আসার মধ্য দিয়ে প্রমাণ করা যাবে অংশগ্রহণমূলক হয়েছে নির্বাচন। গত নির্বাচনে ২৫৯টি আসন পাওয়া আওয়ামী লীগ ভাবছে এবার কৌশলগত কারণে প্রয়োজনে ১০০ আসন ছেড়ে দেবে তারা। অন্য দলগুলোকে নির্বাচনমুখী করতে ওই ১০০ আসন ছোট-বড় দলগুলোকে ভাগাভাগি করে দেবে আওয়ামী লীগ। এতে বেশি সংখ্যক দলকে নির্বাচনে আনতে তেমন বেগ পেতে হবে না ক্ষমতাসীনদের। বাকি ২০০ সংসদীয় আসন নিশ্চিত করে রাখা হবে। যাতে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে সরকার গঠন করতে কোনো অসুবিধা না হয় আওয়ামী লীগের।
আওয়ামী লীগের নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক নেতা আরও বলেন, সংসদীয় আসন ছেড়ে দেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে নিবন্ধিত দলগুলোকে নির্বাচনমুখী করা হবে। নির্বাচনমুখী করার কৌশলটি হবে, যে দলের একটি আসনে নির্বাচন করার সক্ষমতা নেই সেই দলকে ২-৩টি আসন দেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হবে। যে দলের পাঁচটি আসনে নির্বাচন করার সক্ষমতা রয়েছে, সেই দলকে ৭-৮টি আসন ছেড়ে দেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হবে। ফলে নির্বাচনের বাইরে কোনো দল থাকবে না বলে মনে করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ।
সরকারদলীয় নেতারা বলছেন, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪-দলীয় জোটকে নির্দিষ্টসংখ্যক আসন ছেড়ে দেওয়ার পর অন্য নিবন্ধিত দলগুলোকে বাকি আসন দেওয়ার প্রস্তাব দেবে। তাতে বিএনপির সঙ্গে থাকা দলগুলো নিশ্চয়ই নির্বাচনে আসবে। আওয়ামী লীগের নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ের নেতারা বলছেন, বিএনপি নির্বাচনে আসবে ধরে নিয়ে একধরনের কৌশল নেওয়া হচ্ছে। আর না এলে আরেক ধরনের কৌশলে আগামী নির্বাচন করা হবে। নির্বাচনে মূল লক্ষ্য হবে ক্ষমতায় টিকে থাকা। নেতাদের মতে, বিএনপি না এলেও ওই দলটি নির্বাচন ঠেকাতে পারবে, সেটা বিশ্বাস করে না অন্য দলগুলো। ফলে নির্বাচনে অংশ নেওয়া, সংসদে যাওয়া ও সংসদ সদস্য হওয়ার সুযোগ কোনো দলই হারাতে চাইবে না। সভাপতিমন্ডলীর সদস্য কাজী জাফরউল্যাহ বলেন, বিএনপি নির্বাচনে আসবে কি আসবে না, সেটা নিয়ে আওয়ামী লীগ ভাবছে না।’ তিনি বলেন, ‘তারা না এলেও সব রাজনৈতিক দল নির্বাচনে আসবে সে লক্ষ্যেই এগিয়ে যাচ্ছে সরকার। বিএনপি না এলেও অন্য দলগুলো আগামী নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে।
আওয়ামী লীগের একাধিক কেন্দ্রীয় নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রকাশ্যে না হলেও আড়ালে-আবডালে ছোট দলগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলার চেষ্টা বিভিন্নভাবে শুরু হয়েছে। কৌশলগত কারণে সম্পর্ক গড়ে তোলার চেষ্টা জোরদার করা হচ্ছে না। সেই প্রক্রিয়া আপাতত স্বাভাবিক পর্যায়ে রাখা হয়েছে। বছরের শেষদিকে ছোট দলগুলোর সঙ্গে আন্তরিক সম্পর্ক গড়ে তুলতে জোর চেষ্টা শুরু করা হবে। ওই দলগুলোর নেতাদের সঙ্গে ধারাবাহিক বৈঠক-সাক্ষাতের আয়োজন করা হবে। তত দিনে নির্বাচনও ঘনিয়ে আসবে, আর তখন আসন ছাড়ার প্রস্তাবও দেওয়া হবে। এই মিশন বাস্তবায়নে প্রয়োজনে গণভবনেও ছোট দলগুলোর নেতাদের ডাকবেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
এমন পরিকল্পনার কথা শোনা যাচ্ছে জানিয়ে ক্ষমতাসীন দলের নেতারা বলেন, সব ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করে দশম ও একাদশ সংসদ নির্বাচন তুলে আনতে সক্ষম হওয়ায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনও সম্পন্ন করতে পারবেন এই বিশ্বাস সবার মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে। ফলে নির্বাচনের বাইরে থাকতে চাইবে না অন্য কোনো দল। বিএনপিও নির্বাচনের বাইরে থাকার ঝুঁকি নেবে না।
এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য ও কৃষিমন্ত্রী ড. মো. আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ‘বিএনপি নির্বাচনে আসবে কি আসবে না, সেটা একান্তই তাদের ব্যাপার। তবে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন যথাসময়ে অনুষ্ঠিত হবে। সব দলের অংশগ্রহণেই হবে।’