চট্টগ্রামে
কর্ণফুলী নদীর তীর ঘেঁষেই এস আলম গ্রুপের চিনি পরিশোধন কারখানা। দুদিন আগে সেখানে গুদামে
আগুন লাগার পর অপরিশোধিত চিনির পোড়া-গলিত বর্জ্য কারখানার ড্রেন দিয়ে কর্ণফুলী নদীতে
গিয়ে পড়ছে। এতে নদীর পানিতে বিষাক্ত কেমিক্যাল মিশে ভেসে উঠছে নদীর মাছ।
মঙ্গলবার থেকে
নদীতে মারা যাচ্ছে মাছ, কাঁকড়াসহ নানা জলজ প্রাণী। স্থানীয় লোকজন নদীতে নেমে মাছ ধরছে।
বুধবার সকাল থেকে নদীতে মরা মাছ ভেসে উঠতে দেখা যাচ্ছে। সেই মরা মাছ ধরার জন্য অনেকে
জাল নিয়ে গেছেন কর্ণফুলী নদীর দক্ষিণ পাড়ে সেতুর নিচে ব্রিজঘাট এলাকায়।
এস আলম সুগার
রিফাইনারির অবস্থান নদীর দক্ষিণপাড় থেকে ৭০০ মিটার দূরত্বে। সেতু পার হয়ে মইজ্জারটেক
এলাকায় চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের পাশে কারখানাটি। এস আলমের নিজস্ব জেটি আছে।
সাগরে বড় জাহাজে পণ্য আনার পর ছোট জাহাজে করে প্রথমে সেই ঘাটে ভেড়ানো হয়। সেই ঘাট
থেকে মাটির নিচে স্থাপিত পাইপলাইনে ভোজ্যতেল এবং ট্রাকে করে অপরিশোধিত চিনি কারখানার
ভেতরে নেওয়া হয়।
সোমবার বিকালে
আগুন লাগে কারখানার চিনির গুদামে ১ লাখ টন চিনি পুড়ে গেছে বলে এস আলম কর্তৃপক্ষ জানায়।
আগুন নেভাতে ফায়ার সার্ভিসের ১৪ ইউনিট ঘটনাস্থলে গিয়ে পানি ছিটাচ্ছিল। পরে যোগ দেয়
সেনাবাহিনী, নৌ বাহিনী, বিমানবাহিনীও। বুধবার সকালেও আগুন পুরোপুরি নেভানো যায়নি।
কর্ণফুলী হচ্ছে
জোয়ার-ভাটার নদী। ফলে পোড়া চিনি নালা দিয়ে কর্ণফুলী নদীতে পড়লে একটি স্থানে সীমাবদ্ধ
থাকছে না। জোয়ার-ভাটার সঙ্গে পুরো নদীর অন্তত দুই কিলোমিটার জুড়ে ছড়িয়েছে চিনি।
মঙ্গলবারও এস
আলম গ্রুপ দাবি করেছিল যে, নদীতে মিশলেও আমরা এখন বিশেষজ্ঞ সাথে বসে একটা প্ল্যান করবো।
কর্ণফুলীতে আগেও মাছ কি মরতো না। তবে এখন অপরিশোধিত চিনি গিয়ে পোড়া চিনি নদীতে ছড়ালেও
মাছ মরার সম্ভাবনা কম।
কর্ণফুলী নদীতে
ছোট জাহাজের শ্রমিক মো: বেলাল বুধবার জাল দিয়ে মাছ ধরছিলেন কর্ণফুলী নদীতে। তিনি বলেন,
মঙ্গলবার বিকাল থেকেই দেখেছি নদীর পানি কিছুটা কালো রঙ ধারণ করেছে। জোয়ার থাকা পানি
একস্থানে স্থির ছিল না। সকাল থেকেই দেখি জাহাজের পাশেই চিংড়ি, মইল্লা মাছ ভেসে উঠেছে।
পরে জাহাজের পাশে থাকা ছোট ডিঙ্গিতে নেমে জাল নিয়েই মাছ ধরেছি। বেশ কিছু মাছ ধরা পড়েছে
জালে।
নদী পাড়ের
বাসিন্দারা বলেন, সবচেয়ে বেশি মাছ ধরা পড়েছে শিকলবাহা খালের পাশে। কারণ পোড়া চিনি
সরাসরি সেখানেই নদীতে পড়েছে।
সকাল মাছ ধরা
পড়ার খবর পেয়ে এলাকার সবাই নদীতে যায়। কেউ আবার জাল নিয়ে গেছে। কিন্তু বেশিরভাগ
মাছ ধরা পড়েছে ।
নদীতে মাছের
মরার খবর দেখেছেন বলে জানান চট্টগ্রাম জেলা মৎস্য কর্মকর্তা শ্রীবাস চন্দ। তিনি বলেন,
নদীর পাশেই কারখানা গড়ার আগে দূষণ ঠেকানোর ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন ছিল।
কর্ণফুলী নদীর
পাড়ে গিয়ে দেখা যায়, আগুনে পুড়ে যাওয়া কেমিক্যাল মিশ্রিত অপরিশোধিত চিনির বিষাক্ত পানি
সোজা কর্ণফুলী নদীতে পড়ছে। এরপর নদীতে কেমিক্যাল মিশে পানি দূষিত হচ্ছে। এতে নদীর মাছ
মারা যাচ্ছে। নদী থেকে স্থানীয়রা হাত দিয়ে টেংরা, পোয়া ও চিংড়িসহ ভেসে ওঠা নানা ধরনের
মাছ ধরছেন। এছাড়া স্থানীয়রা হাত জাল ফেলেও মাছ ধরছেন। প্রায় ৫ থেকে ৬ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে
এভাবে মাছ ধরতে দেখা গেছে।
বিশেষজ্ঞরা
বলছেন, কর্ণফুলীর ইছানগর এলাকার সুগার মিলে পুড়ে যাওয়া চিনি ও কেমিক্যাল নদীতে গিয়ে
পড়ায় মাছ মারা যাচ্ছে। অপরিশোধিত চিনি আগুনে পুড়ে গিয়ে বর্জ্য হিসেবে কর্ণফুলী নদীতে
পড়েছে। নালার মাধ্যমে সরাসরি নদীতে পড়ায় পরিবেশগত প্রভাব পড়বে। পানির মাত্রা মান
কমে গিয়ে ইকোলজিক্যাল অসামঞ্জস্যতা তৈরি হয়েছে। আর পানিতে অক্সিজেন লেভেল কমে যাওয়ায়
মাছগুলো মারা পড়ছে। চিনির দাহ্য পদার্থ যখন ৩৮০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে থাকে তখন বিষাক্ত
কেমিক্যালে রূপ নেয়। আর সেখানে পানি ছাড়া হলে অক্সিজেন ও হাইড্রোজেন কার্বন তৈরি হয়।
যার কারণে কারখানায় আগুন দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠে। সেই আগুনে অপরিশোধিত চিনি গলে সেই
লাভা নদীতে এসে পড়েছে। এতেই পানি দূষিত হয়ে মাছ মরছে। চিনির কেমিক্যালে নদী দূষণ তো
হয়েছে। এছাড়া নদী দূষণের অন্যতম কারণ হলো ১৭টি খালের বর্জ্য।
স্থানীয় ইছানগর
এলাকার বাসিন্দাদের অভিযোগ, আগুনে পোড়া চিনিতে কারখানার পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়া কঠিন
হয়ে পড়েছে। ফায়ার সার্ভিসের ছিটানো পানি চিনির সঙ্গে মিশে নদীতে পড়েছে।
এস আলম গ্রুপের
মানবসম্পদ কর্মকর্তা মো: হোসেন বলেন, আগুনে পোড়া চিনি কর্ণফুলীতে কিছুটা গেছে। এসব
নিজস্ব জমিতে ডাম্পিং করা হচ্ছে। নদীতে গেলেও জীব-বৈচিত্র্যের কোনও ক্ষতি হবে না। এখানে
কোনও ক্ষতিকর রাসায়নিক নেই।
এ প্রসঙ্গে
পরিবেশ অধিদফতর চট্টগ্রাম জেলা কার্যালয়ের পরিচালক ফেরদৌস আনোয়ার বলেন, ‘সুগার মিলের পোড়া চিনি কর্ণফুলী
নদীতে পড়ছে এমন তথ্য পেয়ে মঙ্গলবার আমাদের ল্যাব থেকে লোকজন গিয়ে ঘটনাস্থল পরিদর্শন
করেছে। বিভিন্ন স্থান থেকে নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে। ল্যাবের রিপোর্ট পাওয়ার পর বিষয়টি
সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যাবে। পানিতে অক্সিজেনের পরিমাণ কমে যাওয়ার কারণে মাছসহ অন্যান্য
জীববৈচিত্র্য মারা যাচ্ছে বা দুর্বল হয়ে পড়ছে। অবশ্যই এটি নদীর জন্য ক্ষতির কারণ।
চট্টগ্রাম ফায়ার
সার্ভিসের সহকারী পরিচালক এম ডি আবদুল মালেক বলেন, ‘চট্টগ্রামের কর্ণফুলীতে সুগার মিলের আগুন ছড়িয়ে পড়া রোধ করতে ব্যবহার
করা হচ্ছে অগ্নিনির্বাপক রোবট ‘লুফ-৬০’। এ
রোবট দিয়ে মিনিটে এক হাজার লিটার স্পিডে পানি ছিটানো হচ্ছে। চিনির কাঁচামালে দাহ্য
পদার্থ থাকায় গুদামের ভেতরের আগুন নেভাতে বেগ পেতে হচ্ছে। সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে আনতে
আরো ৭২ ঘণ্টা লাগতে পারে।’
উল্লেখ্য, গত
সোমবার বিকেল ৪টার দিকে কর্ণফুলীর ইছাপুর এলাকার একটি মিলে আগুন লাগে। আগুন নিয়ন্ত্রণে
প্রথমদিকে কাজ করে ফায়ার সার্ভিসের পাঁচটি স্টেশনের ১৫টি ইউনিট। পরে তাদের সঙ্গে আগুন
নেভাতে যোগ দেয় বিমান, নৌ, সেনাবাহিনী ও আইনশৃঙ্খলা বাহনীর সদস্যরা।