মিয়ানমারের অভ্যন্তরে ঠিক কী হচ্ছে পরিষ্কার জানে না বাংলাদেশের সীমান্ত এলাকায় বসবাসকারীরা। তবে সংঘাত ক্রমাগত তীব্র হয়ে উঠেছে তা বোঝা যাচ্ছে। থেমে থেমে বিকট শব্দ শোনা যাচ্ছে। মর্টার শেল ও বুলেট এসে আঘাত করছে বাংলাদেশের ভেতরে। এমনকি বাংলাদেশে বাড়িঘরেও আঘাত করছে সেসব গোলাগুলি। এতে সীমান্তবাসীর মনে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বাড়ছে। এমন পরিস্থিতিতে রবিবার (২৮ জানুয়ারি) সীমান্ত এলাকা পরিদর্শন করেছেন বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) মহাপরিচালক মেজর জেনারেল একেএম নাজমুল হাসান।
টেকনাফের হোয়াইক্যং ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান নংর আহমেদ আনোয়ারী বলেন, মিয়ানমারের অভ্যন্তরে ঠিক কী হচ্ছে বলা মুশকিল। তবে কয়েক দিন ধরে বিকট শব্দ শোনা যাচ্ছে। ইতোমধ্যে মিয়ানমার থেকে ছোড়া মর্টার শেল ও বুলেট বাংলাদেশের অভ্যন্তরে এসেছে। উলুবনিয়ার সীমান্তের কাছাকাছি রবিবার বেশ কয়েকবার হেলিকপ্টার চক্কর দিতে দেখা গেছে। এতে সীমান্তের মানুষ উদ্বিগ্ন রয়েছে।
একইভাবে ঘুমধুম সীমান্তে হেলিকপ্টারের চক্কর ও বিকট শব্দ শোনা যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন ঘুমধুম ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য শফিকুল ইসলাম।
বিজিবি-৩৪ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক কর্নেল মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, বিজিবিপ্রধান যখন সীমান্তের হোয়াইক্যং এলাকায় অবস্থান করছেন তখন বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী মিয়ানমারের আকাশে চক্কর দিচ্ছিল হেলিকপ্টার। একই সঙ্গে থেমে থেমে গোলাবারুদের বিকট শব্দও শোনা গেছে। বিজিবি মহাপরিচালক হেলিকপ্টার চক্কর দেওয়ার দৃশ্য দেখতে পেয়েছেন একাধিকবার। একই সঙ্গে তিনি শুনেছেন বিকট শব্দও।
অধিনায়ক জানিয়েছেন, মিয়ানমারের অভ্যন্তরে মিয়ানমার আর্মি ও বিজিপির সঙ্গে আরাকান আর্মির সংঘর্ষ চলমান রয়েছে। এ পরিস্থিতি শনিবার থেকে এ পর্যন্ত মিয়ানমার থেকে ফায়ার করা অন্তত ১৩টি মর্টার শেল ও একটি বুলেট বাংলাদেশে এসে পড়েছে। এ নিয়ে বিজিবির পক্ষ থেকে তাৎক্ষণিকভাবে মিয়ানমারের বিজিপিকে প্রতিবাদলিপি পাঠানো হয়েছে।
মিয়ানমারের মংডু এলাকার সোজাপাড়া গ্রামের একজন রোহিঙ্গা বলেছেন, ‘মিয়ানমারের রাখাইন ও চিন রাজ্যের অধিকাংশ এলাকা এখন আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণে। পুনঃনিয়ন্ত্রণের জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। ফলে কয়েক দিন ধরে রোহিঙ্গা গ্রামে গোলাবারুদ বর্ষণ, আগুন ধরিয়ে দেওয়া শুরু করেছে। এতে রোহিঙ্গারা নিরাপদ স্থানের আশায় গ্রাম ছাড়ছে।’ ইতোমধ্যে মংডু শহরের দলিয়াপাড়া, সোজাপাড়া এলাকায় আগুন দেওয়া হয়েছে বলে জানান তিনি।
এই বক্তব্য কক্সবাজারের উখিয়ার রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বসবাসকারী মাস্টার মোহাম্মদ রফিক। বার্মিজ ভাষায় পারদর্শী তিনি। রফিক বলেন, ‘আরাকান আর্মির নিজস্ব বিবৃতি, ছবি ও রাখাইন অঞ্চলে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের দেওয়া তথ্যমতে বিদ্রোহীদের সশস্ত্র লড়াই ক্রমাগত তীব্র হয়ে উঠেছে। বিদ্রোহীরা একে একে সেনাবাহিনীর ঘাঁটি দখল করে নিচ্ছে। আত্মসমর্পণ করছে সেনাবাহিনীর অনেক সদস্য। ফলে তাদের সেনাবাহিনী ক্রমাগত দুর্বল হয়ে গেছে।’
মিয়ানমারে সংঘাতের একটি চিত্র পাওয়া যায় আমদানি-রপ্তানির তথ্যেও। টেকনাফ স্থলবন্দর পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান ইউনাইটেড ল্যান্ড পোর্ট লিমিটেডের মহাব্যবস্থাপক (হিসাব) মো. জসিম উদ্দিন চৌধুরী বলেন, ‘টানা ৪২ দিন বন্ধ থাকার পর গত ২৬ ডিসেম্বর সকালে টেকনাফ স্থলবন্দর দিয়ে মিয়ানমার থেকে পেঁয়াজ ও শুকনা সুপারি নিয়ে একটি ট্রলার এসেছিল। আকিয়াব বন্দর থেকে আসা ট্রলারটিতে ১২০ মেট্রিক টন পেঁয়াজ ও ৮০ মেট্রিক টন শুকনা সুপারি ছিল। এর পর থেকে নতুন করে আর কোনো পণ্যবাহী ট্রলার মিয়ানমার থেকে টেকনাফ আসেনি।‘
বিজিবিকে সতর্ক থাকার নির্দেশ
পরিস্থিতি বিবেচনা করে মিয়ানমার-বাংলাদেশ সীমান্ত এলাকায় বিজিবিকে সতর্ক থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সীমান্ত এলাকা পরিদর্শনে গিয়ে বিজিবি মহাপরিচালক এ নির্দেশনা দেন। এ সময় তিনি ৩৪ বিজিবির বিওপি এলাকায় দায়িত্ব পালনকারী বিজিবি সদস্য ও কর্মকর্তাদের দিকনির্দেশনা দিয়েছেন বলে বিজিবি সূত্র জানিয়েছে।
বিজিবি মহাপরিচালক বিজিবি-৩৪ ব্যাটালিয়নের পালংখালী বিওপি ও বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির তুমব্রু বিওপি, ঘুমধুম সীমান্ত এলাকা ও বিজিবি-২ ব্যাটালিয়নের হোয়াইক্যং বিওপিসহ তৎসংলগ্ন সীমান্ত এলাকা পরিদর্শন করেন। সে সময় তিনি সীমান্তে দায়িত্বরত সকল পর্যায়ের বিজিবি সদস্যের সঙ্গে মতবিনিময় করেন। তিনি সবাইকে সর্বোচ্চ পেশাদারত্বের সঙ্গে দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি সীমান্তে উদ্ভূত যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবিলায় সর্বোচ্চ সতর্ক থাকার নির্দেশ দেন। পরিদর্শনকালে তার সঙ্গে বিজিবি সদর দপ্তরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, কক্সবাজার রিজিওন কমান্ডার, রামু সেক্টর কমান্ডার ও সংশ্লিষ্ট ব্যাটালিয়নসমূহের অধিনায়কসহ বিজিবির অন্যান্য কর্মকর্তা উপস্থিত ছিলেন।