ফিরোজ মাহমুদ
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় বাচ্চাদের মধ্যে মোবাইল আসক্তি বাড়ছে। তাদের মেধা-মননে জায়গা করে নিচ্ছে ভার্চুয়াল এক অস্বাভাবিক জগত, যে কারণে অনেক শিশুর মধ্যেই আচরণগত পরিবর্তন দেখা দিচ্ছে। এমন অবস্থায় বিপাকে পড়েছেন মা-বাবারা।
অভিভাবকরা বলছেন, স্কুল খোলা থাকলে পড়াশোনা কিছুটা হয়। কিন্তু স্কুল বন্ধ থাকায় বাচ্চারা সারাক্ষণ মোবাইল নিয়ে পড়ে থাকে। গেমস ছাড়া তারা কিছুই বোঝে না।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মেধাশূন্য ও পঙ্গু এক ভবিষ্যতের দিকে ঝুঁকছে বাংলাদেশ। তাই স্বাস্থ্যবিধি মেনে দ্রæত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার তাগিদ দেন তারা।
করোনা ভাইরাসের কারণে দু’বছরের বেশি সময় ধরে বন্ধ রয়েছে সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, দীর্ঘসময় স্কুলের বাইরে থাকার কারণে অনেক শিশুর মধ্যেই আচরণগত পরিবর্তন আসতে পারে। একের পর এক নয়া প্রজাতির দাপটে বিপন্ন শৈশব, প্রায় দু’বছরের বেশি সময় ধরে স্কুলের গেটে তালা ঝুলছে। অনলাইন ক্লাস, আর বাড়ির একঘেয়ে পরিবেশ শিশুদের মানসিক বিকাশ অনেকাংশেই ব্যাহত হচ্ছে বলে দাবি করছেন চিকিৎসকরা। জোরালো হচ্ছে স্কুল খোলার দাবিও।
গবেষণায় দেখা গেছে, শিশুরা বাড়ি থেকে স্কুলের পরিবেশে অনেকে বেশি স্বচ্ছন্দ। সম্প্রতি শিশুদের মানসিক বিকাশের উপর করা এক সমীক্ষায় জানা গেছে, শিশুর জীবনে পরিবারের থেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে তার স্কুল জীবন। যুক্তরাজ্যে করা এক গবেষণায় এমনটাই বলা হয়েছে। গবেষণায় জড়িত গবেষকরা দেখেছেন যে স্কুলে শিশুরা নিরাপত্তা এবং সম্মানের পরিবেশ উপভোগ করেছে, তাদের শিক্ষকদের সঙ্গে ভাল সংযোগ ছিল, সেই স্কুলের শিশুদের সামগ্রিক কর্মক্ষমতা ভালো ছিল। কিছু শিশু বাড়ির নেতিবাচক পরিবেশ ইতিমধ্যে তাদের অনেক মানসিক চাপ বাড়ছে। তারা বলছেন, এমন পরিস্থিতি একদিকে যেমন তাদের সঠিক মানসিক বিকাশে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারে অন্যদিকে নিয়মতান্ত্রিক জীবনে অনভ্যস্ত হওয়ার প্রবণতা তৈরি হতে পারে শিশুদের মধ্যে।
এর মধ্যে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানই অনলাইনে ক্লাস পরিচালনা করছে। চিকিৎসা মনোবিজ্ঞানীরা আশঙ্কা প্রকাশ করে বলছেন, অনলাইন ক্লাসের কারণে শিশুদের মোবাইল এবং ইন্টানেটের প্রতি আসক্তি বাড়ছে।
রোকেয়া বেগম, চাকরি করেন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে, স্বামী সরকারি কর্মচারী। তার এক সন্তান, ক্লাস টু’তে পড়ে। তার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, করোনা ভাইরাসের কারণে স্কুল বন্ধ থাকায় সারাক্ষণই প্রায় বাড়িতে থাকছে তার সন্তান। আসক্ত হয়ে পড়ছে মোবাইল এবং ইন্টারনেটের প্রতি। মনোযোগ হারাচ্ছে পড়াশোনার ক্ষেত্রেও। অনেক বেশি খিটখিটে স্বভাবের হয়ে পড়ছে সে। সারাক্ষণই ওদের মাথায় থাকে যে কখন মোবাইলটা নিয়ে গেমস খেলতে বসবে। পড়াশোনার কথা বললে সেখানে কোন কান দেয় না। যেটুকু সময় অনলাইন ক্লাস চলছে সেটুকু সময় ধরে বেধে পড়াতে হয়, বাকি সময়ে চলে দস্যিপনা!
তার কথায়, অবিলম্বে স্কুল খোলা দরকার, না হলে বাচ্চাদের পড়াশোনার অভ্যাসটাই নষ্ট হয়ে যাবে। বিপন্ন হবে শৈশব!
সবরকম ক্লাস কোচিং অনলাইনে হওয়ার কারণে সারাক্ষণই ঘরবন্দি, ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্রী তিশা। তার সঙ্গে কথা বলতেই তার গলায় শোনা গেল আক্ষেপের সুর, তিশা জানালো, ‘কতদিন বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হয়না। এভাবে আর ভালো লাগছে না। কবে যে স্কুলটা খুলবে। সারাদিন প্রায় দুবছর ধরে একঘেয়ে রুটিনে বিরক্ত হয়ে পড়েছে ছোট্ট তিশা। বাবা-মায়েরা বলছেন, শিশুরা বাড়িতে থাকলেও নিয়মতান্ত্রিক জীবনে আর অভ্যস্ত নয় তারা।
ইউনেসকোর তথ্য অনুযায়ী, করোনায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের তালিকায় বিশ্বে সবার ওপরে বাংলাদেশ। কিন্তু উল্টো অবস্থা আক্রান্তের হারে। শিক্ষার্থীদের বেশির ভাগ টিকাও দেওয়া হয়ে গেছে। তারপরও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কেন বন্ধ, এমন প্রশ্ন অনেকের।
ইউনিসেফের তথ্য বলছে বিশ্বে প্রতি তিনজন ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর একজন শিশু। আর প্রতিদিন এক লাখ ৭৫ হাজার অর্থাৎ প্রতি আধা সেকেন্ডে একজন শিশু নতুন করে ইন্টারনেটের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে। ফেসবুক ব্যবহারকারীদের ২৫ শতাংশের বয়সই ১০ বছরের কম এবং ফেসবুকসহ সব ধরনের সোশ্যাল মিডিয়ার ৯০ শতাংশ ব্যবহারকারীর বয়সই ১৮ থেকে ২৯-এর মধ্যে। বাংলাদেশেও ইন্টারনেট প্রসারের মধ্য দিয়ে প্রতিনিয়ত বেড়ে চলেছে বিপুল সংখ্যক ব্যবহারকারী, যার মধ্যে শিশুরাও আছে। বিটিআরসির তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে ১৫ থেকে ১৯ বছর বয়সী ছেলেমেয়েদের প্রায় ৩.৫ শতাংশ নিয়মিত ইন্টারনেট ব্যবহার করে থাকে, যার বড় একটা অংশই যুক্ত থাকে নানা ধরনের সোশ্যাল মিডিয়া সাইটের সঙ্গে।
শিশু ও কিশোরদের ভার্চুয়াল জগতের প্রতি এই আসক্তি কতটা বিপদ ডেকে নিয়ে আসছে, সেটা কি আমরা কখনও গভীরভাবে ভেবে দেখেছি?
মনোরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. এম এ মোহিত কামাল বলেন, ‘শিশুদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হচ্ছে বিনোদনের জায়গা। কিন্তু করোনাভাইরাসের কারণে স্কুল বন্ধ থাকায় সেই বিনোদন আর পাচ্ছে না। এতে শিশুরা দীর্ঘদিন ঘরবন্দি থাকার কারণে বিরক্তি প্রকাশ করছে, রেগে যাচ্ছে। অল্পতেই ভাঙচুর করছে। শিশুদের শান্ত করতে গিয়ে বাবা-মা তাদের সামনে বিভিন্ন ধরনের ডিজিটাল ডিভাইস তুলে দিচ্ছেন। ফলে টেলিভিশন ও ভিডিও গেমে আসক্ত হয়ে পড়ছে শিশুরা। এর ফলে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত ও হীনমন্যতার শিকার হচ্ছে তারা। এতে অনেকের অটিজম, মনোযোগ হ্রাস ও তীব্র বিষণœতায় আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে।’
তার কাছে আসা রোগীদের মধ্যে একাধিক কেস স্টাডির কথা উল্লেখ করে দেশের খ্যাতনামা এই মনোরোগ বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘কোনো গেমসের মধ্যে ঢুকে পড়লে তার ব্রেন নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। তখন গেমস ছাড়া অন্য কিছু কাজ করে না। সৃজনশীলতা নষ্ট হয়ে যায়।’
করোনাকালে শিশুর এসব সমস্যা থেকে উত্তরণের উপায় বলতে গিয়ে মোহিত কামাল বলেন, ‘স্মার্টফোনে কবিতা আবৃত্তি, চিত্র আঁকা, গান ও ছড়া পরিবেশন করে শিশুর সৃজনশীলতা বাড়ানো যেতে পারে। অর্থাৎ ডিজিটাল ডিভাইসের ইতিবাচক দিকগুলোতে শিশুদের ব্যস্ত রাখতে পারেন অভিভাবকরা। এক্ষেত্রে ডিজিটাল ডিভাইস ব্যবহারে অভিভাবকদের নিয়ন্ত্রণ রাখার কোনো বিকল্প নেই। এ ছাড়া করোনাভাইরাস সম্পর্কে বেশি আতঙ্কিত না করে এ বিষয়ে শিশুদের বুঝিয়ে বলতে হবে।’
এডুকেশন ওয়াচের গবেষক ড. মোস্তাফিজুর রহমান জানান, আমরা পঙ্গু এক ভবিষ্যতের দিকে ঝুঁকে যাচ্ছি। তাই স্বাস্থ্যবিধি আরও শক্তিশালী করে হলেও স্কুলগুলো খুলে দিতে হবে।
মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা অধিদফতরের সাবেক মহাপরিচালক প্রফেসর ড. সৈয়দ মো. গোলাম ফারুক বলছেন, করোনার সঙ্গে যুদ্ধ করেই বেঁচে থাকতে হবে; যার কারণে বৃহত্তর পরিকল্পনার দিকে যাচ্ছে সরকার। ইতোমধ্যে অনেকগুলো প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে টিভি ক্লাস, অনলাইন ক্লাস ও অ্যাসাইনমেন্ট রয়েছে।
তবে জাতির অপূরণীয় ক্ষতি হওয়ার আগেই প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করে শিগগিরই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার পক্ষে অভিভাবক, শিক্ষকসহ সংশ্লিষ্টদের।
নাক, কান ও গলা বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. প্রাণগোপাল দত্ত শিশুদের মোবাইল ফোন আসক্তি বিষয়ে বলেছেন, এটি শরীরের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। মোবাইল ফোন থেকে নির্গত রশ্মি শিশুদের দৃষ্টিশক্তির ভীষণ ক্ষতি করে। যেসব শিশু দৈনিক পাঁচ-ছয় ঘণ্টা মোবাইল ফোনে ভিডিও গেমস খেলে, খুব অল্পবয়সে তাদের চোখের সমস্যা হবে। সেদিন খুব বেশি দূরে নয়, যখন মোবাইল ফোনকে সিগারেটের চেয়েও বেশি ক্ষতিকর হিসেবে চিহ্নিত করা হবে।
করোনার প্রাদুর্ভাবে আগের চেয়ে বেশি শিশুরোগী পাচ্ছি। একথা জানিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের রেটিনা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. তারিক রেজা আলী বলেন, চোখের জ্বালাপোড়া, চোখ লাল হওয়া, চোখ পিটপিট করা, চোখ দিয়ে পানি পড়া এসব অভিযোগই বেশি শিশুদের।
তিনি বলেন, এটা নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে শিশুদের চোখের মাইনাস পাওয়ার বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা বেশি। যাকে বলে মায়োপিয়া। এ রোগে আক্রান্ত শিশুরা কাছের জিনিস ভালো দেখলেও দূরের জিনিস দেখতে পায় না। এ সমস্যা বাড়লে দূরের বস্তু আর দেখবেই না। দূর থেকে আসা যানবাহনও দেখতে পাবে না।
জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. গোলাম মোস্তফা বলেন, একটানা কম্পিউটার, মোবাইল বা যে কোনো ইলেকট্রনিক ডিভাইসে তাকিয়ে থাকাটা বড় ছোট সবার চোখের জন্যই ক্ষতিকর। ছোটদের বেলায় সেটা আরও বেশি বিপজ্জনক। অভিভাবকদের অনেকে ভাবেন, শিশুদের চোখের সমস্যা বোধহয় কম হয়। এই ধারণা থেকে তারা ওদের চোখ পরীক্ষাও করান না। এসব শিশুর জন্য তখন সমস্যাটা আরও প্রকট হয়।
তিনি জানান, গত কয়েক মাস ধরে শিশুরা চোখ আর মাথাব্যথা নিয়ে হাসপাতালে বেশি আসছে। এর কারণ, রিফ্লেক্টিভ এরর। অর্থাৎ তাদের চশমার প্রয়োজন হচ্ছে।