মাটির তৈরি বিশেষ চুলায় খেজুরের রস জ্বালানো হচ্ছে। ইনসেটে হাজারী গুড়।মাটির তৈরি বিশেষ চুলায় খেজুরের রস জ্বালানো হচ্ছে। ইনসেটে হাজারী গুড়। লোকজ গান আর হাজারী গুড়, মানিকগঞ্জের প্রাণের সুর। জেলার ঐতিহ্য বহন করায় এভাবেই হাজারী গুড়ের নামে মানিকগঞ্জ জেলাকে ব্রান্ডিং করা হয়েছে। মানিকগঞ্জের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সঙ্গে মিশে আছে এ গুড়ের নাম। অতুলনীয় স্বাদ আর মনমাতানো সুগন্ধের কারণে শুধু দেশেই নয়, বিদেশেও রয়েছে এ গুড়ের চাহিদা। সুদূর ইউরোপেও ছড়িয়েছে হাজারি গুড়ের ঘ্রাণ ও স্বাদ।
হাজারী গুড়ের উৎপত্তি জেলার হরিরামপুর
উপজেলার ঝিট্কা অঞ্চলে। এ অঞ্চলের কিছু পরিবার এখানো হাজারী গুড় তৈরি করছে। একসময় ব্যাপকভাবে
হাজারী গুড়ের উৎপাদন হলেও খেজুর গাছের স্বল্পতা ও বৈরী আবহাওয়ার কারণে তা কমে এসেছে।
জনশ্রুতি আছে, ইংল্যান্ডের রানি এলিজাবেথকেও এই গুড় উপহার দেওয়া হয়েছিল। রানি এলিজাবেথ গুড় খেয়ে অভিভূত হয়েছিলেন। গুণমুগ্ধতা প্রকাশ করতে আগ্রহী হয়ে ‘হাজারী’ নামে একটি সিলমোহরও তৈরি করে দিয়েছিলেন রানি। তিনি নিজেই ছড়িয়ে দিয়েছিলেন এ গুড়ের নাম।
হাজারী গুড়ের ইতিহাস: হাজারী গুড় নিয়ে
এলাকায় প্রচলিত গল্প থেকে জানা যায়, প্রায় দেড়শ বছর আগে হরিরামপুর উপজেলার ঝিট্কা অঞ্চলে
মো. হাজারী প্রামানিক নামে একজন গাছি ছিলেন। যিনি খেজুরের রস দিয়ে গুড় তৈরি করতেন।
একদিন বিকেলে খেজুর গাছে হাঁড়ি বসিয়ে গাছ থেকে নামামাত্রই একজন দরবেশ তার কাছে রস খেতে
চান। তখন হাজারী প্রামানিক ওই দরবেশকে বলেছিলেন, সবেমাত্র গাছে হাঁড়ি বসানো হয়েছে।
এতো অল্প সময়ে বড় জোর ১০-১৫ ফোঁটা রস হাঁড়িতে পড়েছে। তবুও দরবেশ তাকে গাছে উঠে হাঁড়ি
নামিয়ে রস খাওয়ানোর অনুরোধ জানান। দরবেশের অনুরোধে আবারো খেজুর গাছে ওঠেন হাজারী প্রামানিক।
তিনি দেখতে পান, রসে হাঁড়ি ভরে গেছে। রসভর্তি হাঁড়ি নিয়ে তিনি গাছ থেকে নেমে দরবেশকে
রস খাওয়ান এবং দরবেশের পা জড়িয়ে ধরেন। তখন দরবেশ তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলেন, তুমি যতো
গুড় তৈরি করবে, তার সুনাম দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে পড়বে। এরপর থেকেই গাছি হাজারী প্রামানিকের
নামেই এই গুড়ের নাম ‘হাজারী গুড়’ নামে প্রচলিত
হয়।
যেভাবে তৈরি হয় হাজারী গুড়: কয়েকজন গাছি
জানান, আগের দিন বিকেলে গাছ কেটে হাঁড়ি বেঁধে দেওয়া হয়। পরদিন ভোরে গাছ থেকে রস নামিয়ে
ছেঁকে ময়লা পরিষ্কার করে মাটির তৈরি পাত্রে (জালা) অথবা টিনের তৈরি পাত্রে (তাপাল)
চুলায় জ্বাল দিয়ে বিশেষ পদ্ধতিতে গুড় তৈরি করতে হয়। মিষ্টি ও টলটলে রস ছাড়া এ গুড় হয়
না। এক কেজি হাজারী গুড় তৈরিতে প্রায় ১২ থেকে ১৫ কেজি রস প্রয়োজন। প্রচুর চাহিদা থাকায়
গুড় নেওয়ার জন্য আগে থেকেই গাছিদের বলে রাখতে হয়। প্রতি কেজি গুড় বিক্রি হয় ১৪০০-১৬০০
টাকায়।
ঝিট্কা গাছিপাড়া এলাকার আব্দুস সালাম গাছি
বলেন, দিন দিন খেজুর গাছের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। নানা কারণে কমে যাচ্ছে রসের পরিমাণও।
যে কারণে চাহিদা মোতাবেক গুড় তৈরি করা যাচ্ছে না। এছাড়া বছরের অল্প কিছু সময় খেজুরের
রস থেকে গুড় তৈরি করা যায়। বাকি সময় গাছিদের প্রায় বেকারই থাকতে হয়। তাই অনেকে পেশাও
বদল করেছে। এখন ঝিটকা এলাকায় ১০-১২টি পরিবার এই গুড়ের ঐহিত্য টিকিয়ে রাখতে সংগ্রাম
করে যাচ্ছে বলেও জানান তিনি। প্রতিনিয়ত গাছ ও গাছির সংখ্যা কমে যাওয়ার কারণে অদূর ভবিষ্যতে
হাজারী গুড় অস্তিত্ব সংকটে পড়তে পারে বলেও জানান তিনি।
সিদ্দিক প্রামানিক নামের এক গাছি বলেন,
চাহিদা বেশি থাকায় অসাধু কিছু ব্যবসায়ী নকল সীল ও অল্প দামে ভেজাল গুড় তৈরি করে হাজারী
গুড় বলে বিক্রি করে আসছে। এতে নষ্ট হচ্ছে হাজারী গুড়ের সুনাম।
‘হাজারী প্রোডাক্টস,
মানিকগঞ্জ’-এর স্বত্ত্বাধিকারী শফিকুল ইসলাম হাজারী শামীম বলেন,
ঝিট্কা এলাকার ১০ থেকে ১২টি পরিবার প্রতিদিন ৪০ থেকে ৫০ কেজি গুড় তৈরি করেন। খেজুর
গাছ কমে যাওয়ায় গুড়ের উৎপাদনও কমছে। ভেজাল প্রতিরোধ করতে গতবছর থেকে রেজিস্টার্ড ট্রেডমার্কযুক্ত
প্যাকেটের মাধ্যমে গুড় বাজারজাত করা হচ্ছে। হাজারী গুড় টিকিয়ে রাখতে হলে রাস্তাঘাট
ও পতিত জমি এবং ভিটে-বাড়ির আঙিনায় বেশি বেশি করে খেজুরগাছ রোপণ করতে এলাকাবাসীর প্রতি
আহ্বান জানান তিনি।
হরিরামপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো.
সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘ঐতিহ্যবাহী হাজারী গুড়কে টিকিয়ে রাখতে
হলে খেজুর গাছের পরিমাণ বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। আমরা সে লক্ষ্যে কাজ করছি। এছাড়া, গুড়ের
মান বজায় রাখতে প্রবীণ কারিগরদের সঙ্গে আলোচনা করে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’ শীত আগমনের শুরুতেই
খেজুর রস সংগ্রহে ব্যস্ত সময় পার করছে জেলার
বিভিন্ন উপজেলার গাছিরা।