‘হেইদিন সকাল ১০টা বাজেও আমার লগে কথা হইছে।
বলছিলো অফিস থেকে ফিরা আমারে নিয়া মার্কেটে যাইবো। সে আর ফিরা আইলো না। আমার নাহিদকেতো
আর ফিরা পামু না। মরে গিয়াও সে আমাগো ভবিষ্যত ঠিক করে দিয়া গেছে। বসুন্ধরা গ্রুপের
সহায়তা পাইয়া বাঁইচা থাকার স্বপ্ন দেখতাছি।’ বুধবার বসুন্ধরা গ্ৰুপের সহায়তা হাতে
পেয়ে এ কথা বলছিলেন নিহত নাহিদ হাসানের স্ত্রী শিলা মনি।
প্রসঙ্গত, নিউমার্কেট এলাকার ঘটনার পর
গণমাধ্যমে নাহিদ ও মোরসালিনের পরিবারেরর অসহায়ত্বের বিষয় জানতে পারেন বসুন্ধরা গ্রুপের
চেয়ারম্যান আহমেদ আকবর সোবহান। বিশেষ করে মোরাসালিন শেষবার বাসা থেকে বের হওয়ার সময়
মেয়ের ঈদের জামা চাওয়ার বিষয়টি ওনাকে কষ্ট দেয়। তিনি মোরসালিন ও নাহিদের দুই পরিবারকে
সহায়তা দেওয়ার সিন্ধান্ত নেন।
বুধবার বিকেল তিনটায় বসুন্ধরা গ্রুপের
ব্যবস্থাপনা পরিচালক সায়েম সোবহান আনভীর নিজ বাসভবনে দুই পরিবারকে ১০ লাখ করে ২০ লাখ
টাকার আর্থিক সহায়তার চেক তুলে দেন।
নাহিদ হাসানের বাবা মো. নাদিম মিয়ার হাতে
তিন লাখ, মা নার্গিসকে তিন লাখ, স্ত্রী শিলা এবং শিলার বাবা ডালিমের হাতে চার লাখ টাকার
চেক এবং মোরসালিনের মা নূরজাহানের হাতে ৩ লাখ ও তাঁর স্ত্রী অনি আক্তার মিতুর হাতে
দুই সন্তান ও তার জন্য সাত লাখ টাকার চেক তুলে দেন বসুন্ধরা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক।
এসময় উপস্থিত ছিলেন ইস্ট ওয়েস্ট মিডিয়া গ্রুপের পরিচালক ইমদাদুল হক মিলন, বসুন্ধরা
গ্রুপের গণমাধ্যম বিষয়ক উপদেষ্টা মোহাম্মদ আবু তৈয়ব, নিউজ২৪ এর নির্বাহী সম্পাদক রাহুল
রাহা।
ইমদাদুল হক মিলন বলেন, ‘নিউমার্কেটের
ঘটনায় নিহত নাহিদ ও মোরসালিনের পরিবারের পাশে দাঁড়িয়েছে বসুন্ধরা গ্রুপ। এমন পাশে দাঁড়ানো
অতুলনীয় একটি উদ্যোগ। দুটি পরিবারকে যে ১০ লাখ করে টাকা দেওয়া হয়েছে এটি অসহায় পরিবার
দুটির ভবিষ্যতের জন্য কাজে আসবে।’
সরেজমিনে দেখা যায়, বিকেল তিনটার মধ্যেই
নাহিদ ও মোরসালিনের পরিবারের সদস্যরা বসুন্ধরা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের বাসভবনে
উপস্থিত হন। এসময় সবার চোখে-মুখে প্রিয় মানুষ হারানোর বেদনায় অশ্র“সজল চোখ দেখা
যায়। পরে আর্থিক সহায়তা পেয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন কেউ কেউ। মোরসালিনের পরিবার জানায়,
ঘটনার দিন বাসা থেকে বের হওয়ার সময় ছোট্ট মেয়ে লামহা বাবাকে (মোরসালিন) বলেছিলো ঈদের
জামা নিয়ে বাসায় আসতে। কিন্তু মোরসালিনের আর বাসায় ফেরা হয়নি। মেয়ের জন্য জামাও নেওয়া
হয়নি। মোরসালিনের এক ছেলে এক মেয়ে। ছেলে হাবীব হামজার বয়স সাড়ে তিন বছর। আর মেয়ে হুমায়রা
ইসলাম লামহা (৭) কামরাঙ্গিরচরের একটি মাদ্রাসায় নার্সারিতে পড়ছে।
মোরসালিনের স্ত্রী অনি আক্তার মিতু বলেন,
‘আমার মেয়েটা এখনো
রাতে বাবাকে খোঁজে। ও জানে না ওর বাবা আর ফিরবে না। এখনো বাবা ঈদের জামা নিয়ে আসবে
বলে সে ভাবে। কিভাবে বলি তাঁর বাবা আর দুনিয়াতে নেই। আমাদের ছেড়ে চলে গেছে। তারে মেরে
ফেলছে।’
ছেলে হত্যার সঙ্গে জড়িতদের বিচার চেয়ে
নিহত মোরসালিনের মা নূরজাহান বলেন, ‘আমার পোলাডারে
যারা মেরে ফেলছে তাগো বিচার আল্লাহ করব। দুনিয়ার মধ্যেও যেনো তাগো বিচার দেখতে পারি।
আমার বুকে (হার্ড) রোগ আছে। প্রতিমাসে দুই আড়াই হাজার টাকার ওষুধ লাগে। আমার পোলা কত
কষ্ট করে সে টাকা জোগাইতো। আমারে অনেক ভালোবাসতো। এহন আরেক পোলা আছে বসুন্ধরার দেওয়া
টাকা দিয়া তার লাইগা কিছু করে দিতে চেষ্টা করমু।’
তিনি বলেন, ‘আমার বাবাটা এইভাবে
চইলা যাইবে জীবনেও ভাবতাম পারি নাই। আমার দুই ছেলে এক মেয়ে আছিলো। এহন একজন একজন হইয়া
গেছে। বড় পোলাডা গাউসিয়ায় কাপড়ের দোকানে কাজ করে। তাঁর জন্য ভয় লাগে।’
মোরসালিনের শশুর মকবুল বলেন, ‘এই টাকা (সহায়তা)
দিয়ে আমার মেয়েটার জন্য তাঁর ভবিষ্যতের জন্য কিছু একটা করার চিন্তা আছে। হয়তো তারে
কয়েকটা সেলাই ম্যাশিন কিনে দিব। যাতে নিজে ও দুইটা বাচ্চারে নিয়ে চলতে পারে।’
নাহিদের মা নার্গিস বলেন, ‘শেষবার যখন পোলাডার
কথা শুনছি আমার সামনেই আছিলো কিন্তু ভালো করে দেখতেও পারি নাই। মারা যাওনের আগের দিন
সেহরির সময় আমারে ভাত খাইতে ডাকলো। তখন লাইট বন্ধ আছিলো ঠিক মতো দেখিও নাই। পোলাডারেতো
আর ফিরা পামু না। যতদিন দুনিয়ায় আছিলো ততদিন আমাগো কথাই চিন্তা করছে। এমন বিপদের সময়
কাউরে পাশে পাইতেছিলাম না। মইরা গিয়াও আমাগো পাশেই আছে নাহিদ। বসুন্ধরা গ্ৰুপ আইশা
পাশে দাঁড়াইলো, আল্লাহ তাগোরে আরো বড় করুক।’
পাশে থাকা নাহিদের বাবা নাদিম হোসেন বলেন,
‘এমন পুতুলের মতো
পোলাডারে মাটিতে রাইখা আসলাম। আমার বাজানরে আমি মরার আগ পর্যন্ত ভুলতে পারমু না। এমন
কইরা পোলাডা মইরা যাইবো। রাস্তায় মাইরা ফালাইবো কোন শত্রুর জন্যও এমনটা ভাবি নাই। ছোট ছেলেরে এহন ঘর থেকে বাইর
হইতে দিতে মন চায় না, ভয় হয়।’
তিনি বলেন, ‘বসুন্ধরার দেওয়া
টাকা দিয়া ভালো কিছু করার চেষ্টা করমু। ছেলেহারা আমার অসহায় পরিবারের পাশে কেউ ছিল
না।’
প্রসঙ্গত, গত ১৮ই এপ্রিল সোমবার রাতে নিউমার্কেটের
ব্যবসায়ীদের সঙ্গে ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষ বাঁধে। রাত ১২টা থেকে আড়াটা পর্যন্ত
চলে সংঘর্ষ। এরপর পরের দিন মঙ্গলবার সকালে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আবারও সংঘর্ষ শুরু হয়
ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীদের, থেমে থেমে চলে সংঘর্ষ। এই ঘটনায় গুরুতর আহত নাহিদ ও মোরসালিন
পরে হাসপাতালে মারা যায়।