প্রথম দুই ওয়ানডেতে
পাত্তাই পায়নি ওয়েস্ট ইন্ডিজ। শেষটিতে এসে কিছুটা লড়াই করলো স্বাগতিক দল। ১৭৮ রান নিয়েও
লড়লো ৪৯তম ওভার পর্যন্ত। কিন্তু হিসেবি ক্রিকেট খেলা বাংলাদেশের সামনে সেই লড়াই টিকলো
না। আরও একবার ওয়ানডে ফরম্যাটে টাইগারদের কাছে পর্যদুস্ত হলো ক্যারিবীয়রা। গায়ানায়
সিরিজের তৃতীয় ও শেষ ওয়ানডেতে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে ৪ উইকেট আর ৯ বল হাতে রেখে হারিয়েছে
তামিম ইকবালের দল। এতে করে তিন ম্যাচের সিরিজ ৩-০ ব্যবধানে জিতে নিয়েছে তারা।
টেস্ট আর টি-টোয়েন্টি
সিরিজে ২-০ ব্যবধানে হেরেছিল বাংলাদেশ। ওয়ানডেতে এসে যেন তার শক্ত প্রতিশোধ নিলো। স্বাগতিকদের
হোয়াইটওয়াশের লজ্জায় ডোবাল টাইগাররা।
এবারও বোলাররাই
অর্ধেক কাজ সেরে রেখেছিলেন। বাংলাদেশের সামনে লক্ষ্য ছিল ১৭৯ রানের। আরও একবার হেসেখেলেই
জিতবে টাইগাররা, মনে হচ্ছিল শুরুতে।
২ উইকেটে ছিল
বাংলাদেশের রান ছিল ৯৬। তবে গায়ানার উইকেট বলে কথা! সেখান থেকে আর ২০ রান যোগ করতে
আরও ৩ উইকেট হারিয়ে বসে সফরকারীরা। হঠাৎ লড়াইয়ে ফেরে নিকোলাস পুরানের দল।
এরপর মাহমুদউল্লাহ
আর নুরুল হাসান সোহানের ব্যাটে আবারও স্বস্তি ফেরে টাইগার শিবিরে। ৩৭ বলে তারা যোগ
করেন ৩১ রান। মাহমুদউল্লাহ খেলছিলেন ধীরগতিতে।
শেষ পর্যন্ত তাকে
ওয়াইড বলে বোকা বানিয়েছেন নিকোলাস পুরান। উইকেট ছেড়ে বেরিয়ে আসলে স্টাম্পিং হন ৬১ বলে
২৬ করা মাহমুদউল্লাহ। ১৪৭ রানে ৬ উইকেট হারায় বাংলাদেশ, আবারও আশায় বুক বাঁধে ওয়েস্ট
ইন্ডিজ।
সেই আশায় গুঁড়েবালি
দিয়েছেন সোহান আর মেহেদি হাসান মিরাজ। ঠাণ্ডা মাথায় দেখেশুনে ম্যাচ বের করে নিয়েছেন
এই যুগল। ৫৭ বলে ৩২ রানের অবিচ্ছিন্ন জুটি গড়েন তারা। সোহান ৩৮ বলে ৪ বাউন্ডারিতে ৩২
আর মিরাজ ৩৫ বলে ১৬ রানে অপরাজিত থাকেন।
রান তাড়ায় নেমে
২০ রানে ভেঙেছিল বাংলাদেশের ওপেনিং জুটি। এর মধ্যে সিংহভাগ রানই আসে তামিম ইকবালের
ব্যাট থেকে। ১১ বল খেলে প্রথম রানের খাতা খোলা শান্ত দুই বল পরই আলজেরি জোসেফের ডেলিভারিতে
এজ হয়ে উইকেটরক্ষককে ক্যাচ দিয়ে ফেরেন মাত্র ১ রানেই।
শান্তকে হারানোর
পর লিটন দাসের সঙ্গে ৫০ রানের আরেকটি জুটি (৬২ বলে) গড়েন তামিম। টাইগার দলপতি খেলছিলেন
বেশ আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে। তবে ব্যক্তিগত ৩৪ রানে থামতে হয়েছে তাকে।
৫২ বলে ৪ বাউন্ডারিতে
ইনিংস সাজিয়ে ভুল শট খেলে বসেন তামিম। গোদাকেশ মোতিকে সুইপ করতে গিয়ে ফাইন লেগে ধরা
পড়েন বাঁহাতি এই ওপেনার।
তামিম ফিরলেও
আরও একবার দারুণ এক ইনিংস বেরিয়ে এসেছে লিটন দাসে উইলো থেকে। ডানহাতি এই ব্যাটার তুলে
নেন ক্যারিয়ারের ষষ্ঠ ওয়ানডে ফিফটি।
যদিও ফিফটির পর
বেশিক্ষণ টিকতে পারেননি লিটন। গোদাকেশ মোতির দারুণ এক ফিরতি ক্যাচে সাজঘরের পথ ধরেন
মারকুটে এই ব্যাটার। ৬৫ বলে গড়া তার ৫০ রানের ইনিংসটি ছিল ৫ বাউন্ডারি আর ১ ছক্কায়
সাজানো।
এর ঠিক এক বল
পরই আরেক ব্যাটার আফিফ হোসেনকেও (০) বোল্ড করে বাংলাদেশকে চাপে ফেলে দেন মোতি। ২৫তম
ওভারে ডাবল উইকেট মেইডেন নেন ক্যারিবীয় বাঁহাতি এই স্পিনার।
মোসাদ্দেক হোসেন
খেলছিলেন দারুণ আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে। টানা দুই ওভারে একটি করে চার-ছক্কা হাঁকিয়ে দেন
ভালো কিছুর ইঙ্গিত। কিন্তু ১৪ রানেই থামতে হয়েছে ডানহাতি এই ব্যাটারকেও।
দারুণ বোলিং করা
মোতিকে ডাউন দ্য উইকেটে খেলতে গিয়ে লংঅফ ফিল্ডারের হাতে ধরা পড়েন মোসাদ্দেক। ১১৬ রানে
৫ উইকেট হারিয়ে চাপে পড়ে বাংলাদেশ। শেষ পর্যন্ত সেই চাপ কাটিয়ে জয় নিয়েই মাঠ ছেড়েছে
টাইগাররা।
ক্যারিবীয় বোলারদের
মধ্যে সবচেয়ে সফল ছিলেন গোদাকেশ মোতি। ১০ ওভারে মাত্র ২৩ রানে তিনি নেন ৪টি উইকেট।
এর আগে তাইজুল
ইসলামের দুর্দান্ত বোলিংয়ে ১৭৮ রানেই গুটিয়ে যায় ওয়েস্ট ইন্ডিজ। ১০ ওভারে ২৮ রান খরচ
করে টাইগার দলের বাঁহাতি স্পিনার একাই নেন ৫ উইকেট।
গায়ানার প্রভিডেন্স
স্টেডিয়ামে সিরিজে তৃতীয়বারের মতো টস জিতেছেন তামিম ইকবাল। আগের দুই ম্যাচের মতো এবারও
আগে ফিল্ডিংয়ের সিদ্ধান্ত নেন তিনি। বোলিং করতে নেমে প্রথম ওভার তুলে দেওয়া হয় আগের
ম্যাচের সেরা নাসুম আহমেদের হাতে।
প্রথম ওভারে ৪
রান খরচ করেন নাসুম। তবু তাকে আক্রমণ থেকে সরিয়ে নেন তামিম। দ্বিতীয় ওভার মোস্তাফিজকে
দিয়ে করানোর পর বল তুলে দেওয়া হয় তাইজুলের হাতে। নিজের প্রথম বলেই দারুণ এক টার্নিং
ডেলিভারিতে ফ্রন্ট ফুট ডিফেন্স করা কিংকে বোল্ড করেন তাইজুল।
নিজের পরের ওভারে
আবারও দৃশ্যপটে হাজির এ বাঁহাতি স্পিনার। এবারও কিংয়ের মতোই দারুণ এক ডেলিভারি করেন
হোপকে। সামনে পা বাড়িয়ে খেলতে গিয়ে ব্যাটে-বলে করতে পারেননি হোপ। ক্ষণিকের জন্য তার
পা বেরিয়ে যায় পপিং ক্রিজ থেকে।
সেই কয়েক মুহূর্ত
সময়টাই যথেষ্ট ছিল সোহানের জন্য। তড়িৎ বেগে বেলস ফেলে দিয়ে স্টাম্পিংয়ের আবেদন করেন
সোহান। রিপ্লেতে দেখা যায়, খুবই অল্প সময়ের ব্যবধানে হোপের বিদায়ঘণ্টা বাজিয়ে দিয়েছেন
টাইগারদের উইকেটরক্ষক। যার সুবাদে তাইজুল পেয়ে যান দ্বিতীয় উইকেট।
অন্য প্রান্তে
বোলিং করতে থাকা মোস্তাফিজ দেখছিলেন তাইজুলের ঘূর্ণি জাদু। ইনিংসের ষষ্ঠ ও ব্যক্তিগত
তৃতীয় ওভারে তিনিও যোগ দেন উইকেট শিকারের উৎসবে। ওভারের তৃতীয় বলটি ছিল মিডল স্টাম্পের
ওপর হালকা ভেতরে ঢোকা ডেলিভারি। যেটি ব্যাটে-বলে করতে পারেননি ব্রুকস।
বাংলাদেশের বোলার-ফিল্ডারদের
জোরালো আবেদনে আঙুল তুলে দেন আম্পায়ার। কিছুক্ষণ ভেবে রিভিউ নেন ব্রুকস। রিপ্লেতে দেখা
যায় মিডল স্টাম্পের ভেলসে হালকা ছুঁয়ে যেতো ডেলিভারিটি। মাঠের আম্পায়ার আউট দিয়ে দেওয়ায়
সাজঘরে ফিরে যেতে হয় ৪ রান করা ব্রুকসকে।
মাত্র ১৬ রানে
৩ উইকেট হারিয়ে গভীর খাদে পড়ে গিয়েছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ। সেখান থেকে দ্রুত রান তোলার বদলে
উইকেটে টিকে থাকা দিকে মনোযোগ দেন নিকোলাস পুরান ও ক্যাসে কার্টি। ইনিংসের ১৬তম ওভারে
গিয়ে পূরণ হয় ক্যারিবীয়দের দলীয় পঞ্চাশ।
চতুর্থ উইকেটে
দেখেশুনে ১২৮ বল খেলে দেন এই যুগল। যোগ করেন ৬৭ রান। থিতু হয়ে যাওয়া এই জুটিটি অবশেষে
ভাঙেন নাসুম আহমেদ। কিছুতেই কিছু হচ্ছিল না। অবশেষে ইনিংসের ২৭তম ওভারে ফের নাসুমকে
বোলিংয়ে আনেন তামিম।
অধিনায়কের আস্থার
প্রতিদান দিতে দেরি করেননি পুরো সিরিজেই দুর্দান্ত বোলিং করা নাসুম। বাঁহাতি এই স্পিনারকে
তুলে মারতে গিয়ে মিডঅনে তামিমের হাতে ক্যাচ তুলে দেন কার্টি (৬৬ বলে ৩৩)।
এরপর রানের গতি
আরও কমে যায় ওয়েস্ট ইন্ডিজের। ৩৪ ওভারে ১০০ ছোঁয় ক্যারিবীয়রা। ওই সময় ৪৩ বলে মাত্র
১৬ রান তুলেছিলেন পুরান-রভম্যান পাওয়েল। পানি পানের বিরতির পর রানের গতি বাড়ানোর চেষ্টা
করেন এই যুগল।
৩৫তম ওভারে তাইজুলকে
পুরানের এক বাউন্ডারিসহ ৮, পরের ওভারে মিরাজকে পাওয়েলের একটি ছক্কাসহ ৯ রান আসে। তবে
তার ঠিক পরের ওভারেই দুর্দান্ত এক ডেলিভারিতে পাওয়েলকে (২৯ বলে ১৮) বোল্ড করেন তাইজুল।
এরপর আরও একটি
সোহান-তাইজুল জুটির উইকেট। এক ম্যাচে দুই ব্যাটারকে স্টাম্পিং করে নজর কাড়েন সোহান।
তাইজুলের করা ক্যারিবীয় ইনিংসের পঞ্চম ওভারে শাই হোপের পা একটু বেরিয়ে গিয়েছিল, চোখের
পলকে তাকে স্টাম্পিং করেছিলেন সোহান।
একইভাবেই ৩৯তম
ওভারে কেমো পলের (৬) পা বেরিয়ে গিয়েছিল তাইজুলের ঘূর্ণি সামলাতে গিয়ে। সোহান আরও একবার
বিদ্যুৎগতিতে করেছেন স্টাম্পিং। ১২৫ রানে ৬ উইকেট হারায় ওয়েস্ট ইন্ডিজ।
একটা প্রান্ত
ধরে ছিলেন ক্যারিবীয় অধিনায়ক নিকোলাস পুরান। তাকেই নিজের পঞ্চম শিকার বানান তাইজুল।
১০৯ বলে ৪ বাউন্ডারি আর ২ ছক্কায় ৭৩ রান করা পুরানকে দুর্দান্ত এক ডেলিভারিতে বোল্ড
করেন টাইগার স্পিনার।
এরপর শেষ উইকেটে
২৯ বলে ২৫ রান যোগ করেন আলজেরি জোসেফ আর রোমারিও শেফার্ড। জুটিটা থামতো পারতো ১৬ রানেই,
১৬৯ রানে অলআউট হয়ে যেতো ওয়েস্ট ইন্ডিজ। মোস্তাফিজুর রহমানের করা ৪৮তম ওভারের প্রথম
বলেই আকাশে বল তুলে দিয়েছিলেন শেফার্ড, কভারে সহজ ক্যাচ ফেলে দেন তামিম।
১২ রানে জীবন
পাওয়া শেফার্ড শেষ ব্যাটার হিসেবে বোল্ড আউট হন ১৯ করে। শেষ উইকেটটি নেন নাসুম। ওয়েস্ট
ইন্ডিজ থামে ৪৮.৪ ওভারে ১৭৮ রানে।
নাসুম
৩৯ রানে নেন ২ উইকেট। ২৪ রানে ২ উইকেট মোস্তাফিজের। মোসাদ্দেক এক উইকেট পেলেও ১০ ওভারে
খরচ করেন মাত্র ২৩ রান। এছাড়া আফিফ হোসেন ২ ওভারে ২, মেহেদি হাসান মিরাজ ৮ ওভারে ৬১
রান দিয়ে ছিলেন উইকেটশূন্য।