রাজধানীর পুরান
ঢাকায় অন্তত ২ হাজার ছিন্নমূল শিশুর বসবাস। এদের বেশিরভাগই ‘ড্যান্ডি’ নামে একধরনের নেশায় আসক্ত। ‘ড্যান্ডি’ হচ্ছে এক ধরনের আঠা বা গাম; যা
জুতা বা সাইকেলের টায়ারে ব্যবহার করা হয়। অল্প খরচে এই গাম কিনে নেশা করা যায় বলে
ছিন্নমূল শিশুরা দিনদিন অনেক বেশি ঝুঁকে পড়ছে এতে। একজনের কাছ থেকে অন্যজনের কাছে ছড়িয়ে
যাচ্ছে। পুরান ঢাকার বাহাদুর শাহ পার্ক, সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনালসহ বিভিন্ন অলিগলিতে
ড্যান্ডি নেশায় আসক্ত এমন অহরহ ছিন্নমূল শিশু দেখা যায়।
পুরান ঢাকার
বাহাদুর শাহ পার্কসহ বেশ কয়েকটি এলাকা ঘুরে ছিন্নমূল শিশুদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়,
সহজলভ্য এই মাদক ক্ষুধামন্দা তৈরি করে। এজন্য খাবারের ‘যন্ত্রণা ভুলে থাকতে’ তারা মাদক গ্রহণ করে। মাদকাসক্ত
এই শিশুদের একজন নবীন (ছদ্মনাম)। জন্মের পর থেকে বাহাদুর শাহ পার্কই তার ঠিকানা। বয়স
জানা নেই, তবে তার অনুমান ৯ বছর হবে। এই বয়সে জীবনের অনেক রূপ দেখেছে সে। প্লাস্টিক
কুড়িয়ে, ছিন্নমূল চারীদের কাছে হাত পেতে, যা পায় তাই দিয়েই খেয়ে না খেয়ে দিন কাটে তার।
মাঝে-মধ্যে ডাস্টবিনে ফেলা উচ্ছিষ্ট খাবারও খায় সে।
ক্ষুধার জ্বালায়
কিছুদিন আগে এক নারীর ব্যাগ নিয়ে দৌড়া দিয়েছিল সে। সেকথাও প্রতিবেদকের কাছে অকপটে
স্বীকার করে এই শিশু। পরে ধরা পড়লে মারও খেয়েছে সে। নেশা করে কেন- জানতে চাইলে সে বলে,
‘মাঝেমধ্যে
খুব খিদা লাগে। কী করবো বুঝি না। তাই এই গাম খাই। এটা খেলে কেমন যেন একটা লাগে। সারাদিন
মাথা ঝিমঝিম করে। আর খিদা লাগে না।’
পুরান ঢাকার
বেশিরভাগ ছিন্নমূল শিশু সিগারেট ও ড্যান্ডির নেশায় আসক্ত। ড্যান্ডি বলতে মূলত পলিথিনের
মধ্যে গাম দিয়ে সেই গাম মুখ দিয়ে টেনে নেশায় মত্ত তারা। এই নেশা করলে নাকি তাদের
আর ক্ষুদা লাগে না। মুক্তা (১৩) নামে এক নেশাগ্রস্ত কিশোরী বলে, ‘আমার কাছে টাকা থাকলে আমি এই গাম
না খেয়ে ভাত খাইতাম। ৪০ থেকে ৫০ টাকার গাম কিনলে তিন দিন খাইতে পারুম। এই তিন দিন
এক বেলা খাইলেও চলে। কিন্তু এই ৫০ টাকা দিয়া কি তিন বেলাতো ভাত খাওন যাইবো?’
পথেই ঠিকানা
হওয়ায় বেশিরভাগ ছিন্নমূল শিশুর থাকে পথেই। ঠিকমতো গোসলও হয় না। এজন্য হোটেলে বসে খেতেও
দেওয়া হয় না বলে জানায় এই কিশোরী। সে আরও বলে, ‘আমরা পরিষ্কার থাকবো ক্যামনে? সারাদিন থাকি ধুলাবালি আর ময়লার মধ্যে।
না আছে ঘর না আছে বাড়ি। বাপে দুই বিয়ে করার পর সৎ মা অভাবের কারণে আমাকে ছোট থাকতেই
ঢাকা শহর এক খালার কাছে দিয়ে দিছে, তাদের বাসায় কাজ করার জন্য। তারা কিছু থেকে কিছু
হইলেই অনেক মারতো। তাই তাদের বাসা থেকে পালাই আসছি। তারপর বাড়িতে জানানোর পর বললো
বাড়ি গেলে নাকি হাত পা ভাইঙ্গা দিবে। তাই আর বাড়ি যাওয়া হয় নাই। আজ পাঁচ বছরের
বেশি সময় আমি এখানে। মানুষের কাছে ভিক্ষা করে যা পাই, তাই দিয়াই চলি। কিন্তু এই অল্পতে
তো আর ভাত কেনা যায় না। তাই নেশা কইরাই দিন কাটে।’
এই ছিন্নমূল
শিশুরা কেউ কেউ একটু বড় হয়ে দোকান বা রেস্তোরাঁয় কাজ নেয়। তবে সবাই সেই কাজেরও সুযোগ
পায় না। জীবন (১৪) নামে আরেকজন ছিন্নমূল শিশু বলে, ‘আমরা কাজ চাইলেও কেউ কাজ দেয় না। যার যখন মন চায় অকারণেই কিল-ঘুষি
মারে। মানুষের দ্বারে-দ্বারে ঘুইরাও কোনও লাভ নাই। কেউ এক বেলা ভাত খাইতে দেয় না।
এখন আপনারাই বলেন, ভাত না খায়া কি মরুম? আমার বন্ধু সিফাত একটা বুদ্ধি দিল, এইটা
(ড্যান্ডি) খাইলে নাকি আর খিদা লাগে না। তারপর থাইকা আমি এই গাম খাওয়া শিখছি। আগে
খাইতে পারতাম না, বমি আসতো। এখন এইটা না খাইলে আর ভাল্লাগে না ভাই। এই জীবনডাই আর ভাল্লাগে
না। আমাদের কেউ যদি খাবার ও থাকার ব্যবস্থা কইরা দেয়, এসব নেশা করা ছাইড়া দিমু। পারলে
আমাদের কাজ করার সুযোগ করে দেন।’
এসব বিষয়ে
কথা হয় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক আকবর হোসেনের
সঙ্গে। তিনি বলেন, সারা বিশ্বে যে পরিমাণ খাদ্য উৎপাদিত হয়, তা কিন্তু সারা বিশ্বের
মানুষের জন্য পর্যাপ্ত হওয়ার কথা। কিন্তু দুঃখজনক হলেও মানুষের অসম বণ্টনের যে ব্যবস্থা
তৈরি হয়েছে, এ জন্য খাদ্যের অভাব হয়ে যায়। কেউ কেউ খাদ্য অপচয় করে, কেউ আবার প্রচুর
খাদ্য মজুদ করে রেখেছে। এই অসম বণ্টন যদি না থাকতো, তাহলে বিশ্বে খাদ্যের অভাব হতো
না। আমাদের দেশেও অনেকে খাদ্যের অপচয় করেন। এখানে যে সরকারি ব্যবস্থাপনা রয়েছে সেটা
যদি কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারতো, তাহলে এর সমাধান হতো।’
তিনি আরও বলেন,
‘একটা
রাষ্ট্র যখন কল্যাণমূলক হয়ে ওঠে, তখন তার দায়িত্ব হচ্ছে মানুষের মৌলিক অধিকারগুলো
পূরণ করা। খাদ্যের সংস্থান করা, এটা একটা মৌলিক চাহিদার মধ্যে পড়ে। রাষ্ট্রের দায়িত্ব
এটা পূরণ করা। সব ছিন্নমূল শিশুদের একটা প্লাটফর্মে নিয়ে আসা দরকার। এদের কিন্তু জন্মসূত্রে
এদেশের যে পাঁচটি মৌলিক অধিকার আছে তা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব।’
একবিংশ শতাব্দীর
এই যুগে মানুষ যেখানে চাঁদে যাচ্ছে, মঙ্গল গ্রহে যাচ্ছে, আরও বড় বড় অভিযান করছে সেখানে
কিছু মানুষ খেতে পারবে না; এত দূরত্ব তৈরি হওয়ার তো কথা না উল্লেখ করে এই শিক্ষক বলেন,
‘আমি
ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, এই জায়গাটাতে রাষ্ট্রের প্রচুর ভূমিকা রয়েছে, সেই ভূমিকা
পালন করার ক্ষেত্রে সিস্টেমেটিক কিছু সমস্যা আছে। সেগুলো যদি সমাধান করা যায় এবং দুর্নীতি
দূর করা যায়; তাহলে ছিন্নমূল শিশু বলে আর কেউ থাকবে না।’