করোনাকাল শেষে বিশ্বের বৃহত্তম ধর্মীয় অনুষ্ঠান পবিত্র হজ অনুষ্ঠিত হচ্ছে আজ মঙ্গলবার। তিন বছর আগে বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাস শুরুর পর এ বছরই প্রথমবারের মতো পূর্ণ সক্ষমতায় ফিরেছে হজের আনুষ্ঠানিকতা। সৌদি আরবের পাসপোর্ট অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, এবার বিশ্বের প্রায় ২৩ লাখ লোক হজ পালন করছেন।
সৌদি আরবের পাসপোর্ট অধিদপ্তর জানিয়েছে, রবিবার সন্ধ্যা থেকে বিদেশি হজযাত্রী আসা বন্ধ রয়েছে। এ পর্যন্ত আকাশ, স্থল ও জলপথ ব্যবহার করে ১৬ লাখ ৫৫ হাজার ১৮৮ জন বিদেশি হজ পালনের জন্য সৌদি আরব পৌঁছেছেন। হজ পালনের জন্য সৌদি আরবের নাগরিক ও প্রবাসীসহ অন্তত ১২ লাখ মানুষ আবেদন করেছেন। এর মধ্যে বিদেশি হজযাত্রীর ৪০ শতাংশ অর্থাৎ সাড়ে ছয় লাখের মতো আবেদন গ্রহণ করা হয়েছে। সে হিসাবে এবার ২৩ লাখের মতো লোক হজ পালন করছেন।
৪৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রাকে সঙ্গী করে আজ সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত আরাফাতের ময়দানে অবস্থান করবেন হজ পালনকারীরা। তবে সৌদি আবহাওয়া অফিস জানিয়েছেন, আজ বৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
আরাফাতের ময়দানে অবস্থিত নির্দিষ্ট তাঁবুতে হজযাত্রীরা মহান আল্লাহর জিকিরসহ, কোরআন তেলাওয়াত, দোয়া ও নফল নামাজে মশগুল থাকবেন। পবিত্র হজ ইসলামের মূল পাঁচটি স্তম্ভের একটি। আর্থিক ও শারীরিকভাবে সমর্থ পুরুষ ও নারীর জন্য হজ ফরজ। আরাফাতের ময়দানে অবস্থান করাই হজের মূল কাজ। তাই হজ ভিসা নিয়ে যারা সৌদি আরবে গিয়ে অসুস্থতার জন্য হাসপাতালে চিকিৎসাধীন, তাদেরও অ্যাম্বুলেন্সে করে আরাফার ময়দানে অল্প সময়ের জন্য আনা হবে।
আজ ফজরের নামাজের পর মিনা থেকে আরাফার ময়দানে যাওয়ার কথা থাকলেও রাস্তার ভিড় এড়াতে অনেক হজ এজেন্সি গতকাল এশার নামাজের পর থেকেই হজযাত্রীদের আরাফাতের ময়দানে পৌঁছে দেওয়া শুরু করে। যারা রাতে পৌঁছাননি, তারা জোহরের নামাজের আগে আরাফাতের ময়দানে পৌঁছাবেন।
মক্কা থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত দুই মাইল দৈর্ঘ্য ও দুই মাইল প্রস্থের বিরাট সমতল ময়দানের নাম আরাফাত। এর তিন দিক পাহাড়বেষ্টিত। জাবাল মানে পাহাড়। জাবালে রহমত হলো রহমতের পাহাড়। এই পাহাড়ে হজরত আদম (আ.) ও হজরত হাওয়া (আ.)-এর দেখা হয়েছিল। আর হজরত মুহাম্মদ (সা.) জাবালে রহমত পাহাড়ের কাছে দাঁড়িয়ে বিদায় হজের ভাষণ দিয়েছিলেন। এই পাহাড়ে একটি উঁচু পিলার আছে। একে কেউ কেউ দোয়ার পাহাড়ও বলেন।
আরাফাতের ময়দানে হজের খুতবার পর জোহর ও আসরের নামাজ আদায় করবেন মুসল্লিরা। আরাফাতের ময়দানে অবস্থিত মসজিদে নামিরা থেকে হজের খুতবা দেওয়া হবে। এ বছর খুতবা দেবেন দেশটির সর্বোচ্চ উলামা পরিষদের সদস্য শায়খ ড. ইউসুফ বিন মোহাম্মদ বিন সাঈদ। খুতবা বাংলাদেশ টেলিভিশনসহ বিভিন্ন বেসরকারি টেলিভিশন সরাসরি সম্প্রচার করবে। আর সৌদি সরকারের উদ্যোগে আরাফাতের খুতবার অনুবাদ বাংলাসহ ২০ ভাষায় সরাসরি সম্প্রচারের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এবার খুতবার বাংলা অনুবাদ করবেন ড. খলীলুর রহমান, আ ফ ম ওয়াহিদুর রহমান মক্কি, মুবিনুর রহমান ফারুক ও নাজমুস সাকিব। তারা সবাই বাংলাদেশি ও মক্কার উম্মুল কুরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছেন।
হাজিরা আজ সূর্যাস্ত পর্যন্ত আরাফার ময়দানে অবস্থানের পর মুজদালিফায় গিয়ে মাগরিব ও এশার নামাজ একসঙ্গে আদায় করবেন। রাতে সেখানে অবস্থান করবেন খোলা মাঠে। শয়তানের প্রতিকৃতিতে পাথর নিক্ষেপের জন্য প্রয়োজনীয় পাথর (৭০টি) সংগ্রহ করবেন সেখান থেকে। মিনা, আরাফাত ও মুজদালিফায় সৌদি সরকারের পক্ষ থেকে সব হাজিকে বিনামূল্যে খাবার, বিশুদ্ধ পানিসহ সব সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। পাশাপাশি বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা ও প্রতিষ্ঠান হাজিদের নানা উপহার দিচ্ছে।
সৌদি আরবের রাজকীয় অতিথি হিসেবে পবিত্র হজ পালনে সৌদি আরব পৌঁছেছেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন ও তার স্ত্রী ড. রেবেকা সুলতানা। এবার বাংলাদেশ থেকে ১ লাখ ২২ হাজার ৮৩৩ হজযাত্রী সৌদি আরব পৌঁছেছেন। এ পর্যন্ত অসুস্থ হয়ে ২৬ জন বাংলাদেশি মারা গেছেন।
হজ পালনের প্রয়োজনীয় অনুমতি ছাড়া কেউ মাশায়েরে মুকাদ্দিসায় (মিনা, আরাফাত ও মুজদালিফায়) প্রবেশ করতে পারবে না। হজযাত্রীদের নিরাপত্তার জন্য কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে সৌদি কর্র্তৃপক্ষ। আকাশপথে হেলিকপ্টার চক্কর দিচ্ছে। রাস্তায় বিশেষ ব্যবস্থাপনায় পানি ছিটিয়ে পরিবেশ ঠাণ্ডা রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছে।
মক্কা কর্র্তৃপক্ষ ২৩ হাজার পরিচ্ছন্নতাকর্মী হাজিদের চলাচলের রাস্তা পরিষ্কার রাখার কাজে নিয়োগ দিয়েছেন। মক্কার আটটি হাসপাতাল, মিনা, মুজদালিফাও আরাফাতের ২৫টি মেডিকেল সেন্টার প্রস্তুত থেকে হাজিদের চিকিৎসাসেবার জন্য। এ ছাড়া ৫৭টি বড় ও ১২০টি মিনি অ্যাম্বুলেন্স সার্বক্ষণিক প্রস্তুত। এসব অ্যাম্বুলেন্সে নিবিড় পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র (আইসিইউ)ও চিকিৎসক রয়েছে। সেবার জন্য পাঁচটি হাসপাতালে এয়ার অ্যাম্বুলেন্স অবতরণের জন্য পাঁচটি হেলিপ্যাড তৈরি করা হয়েছে। এ ছাড়া জরুরি সেবার জন্য রেড ক্রিসেন্টের এয়ার অ্যাম্বুলেন্স মোতায়েন থাকবে। সৌদি কর্র্তৃপক্ষ জানিয়েছে, হিটস্ট্রোক, ডিহাইড্রেশন কিংবা ক্লান্ত হয়ে গেলে সহযোগিতার জন্য রাস্তায় রাস্তায় প্রস্তুত রাখা হয়েছে সেবাকর্মী।
করোনা শুরু হলে ২০২০ সালে মাত্র ১০ হাজার লোক হজের অনুমতি পেয়েছিলেন। ২০২১ সালে কিছুটা শিথিল করে ৫৯ হাজার জনকে অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। গত বছর প্রায় ১০ লাখ লোক হজ পালন করেন।