কর্ণফুলী নদীর তলদেশে দেশের প্রথম টানেলের নির্মাণকাজ শেষের দিকে। তবে দেশের অহং, আবেগ ও আভিজাত্যের জৌলুস কর্ণফুলী টানেলের দুইপ্রান্তের ট্রাফিক ব্যবস্থা নিয়ে জটিলতার আশঙ্কা করছেন বিশ্লেষকরা। কারণ টানেল চালুর ১০ বছর পর যানবাহন ব্যবস্থাপনার রূপরেখা কী হবে সে বিষয়টি এই সমীক্ষায় রাখা হয়নি। ফলে সেখানে যানজটের আশঙ্কা রয়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা দাবি করছেন। এমন পরিস্থিতিতে আইটার রিং রোড, কাটগড় সড়ক, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, এয়ারপোর্টমুখী সড়ক, পতেঙ্গা সৈকতমুখী সড়ক, কর্ণফুলী টানেলের প্রবেশ মুখ— এই পাঁচ সড়কে তীব্র যানজট সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কার কথাও জানানো হয় পুলিশের পক্ষ থেকে।
জানা গেছে, কর্ণফুলী টানেল দিয়ে প্রতিদিন গড়ে সতেরো হাজার গাড়ি চলাচল করবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এবং প্রতি বছর এই সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পাবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। সাত শতাংশ বৃদ্ধির ধারাবাহিকতায় ২০৩০ সালে গাড়ি চলাচলের দৈনিক সংখ্যা দাঁড়াতে পারে ৩৮ হাজারে। এই বিশাল যানবাহনের নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা সম্পর্কে সুস্পষ্ট কোনো পরিকল্পনার কথা জানাতে পারছেন টানেল সংশ্লিষ্টরা। প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা সেতু কর্তৃপক্ষ, নির্মাণকারী সংস্থা চায়না কমিউনিকেশন কনস্ট্রাকশন কোম্পানি লিমিটেড (সিসিসিসিএল) ও অভি অরূপ অ্যান্ড পার্টনার্স হংকং লিমিটেড যৌথভাবে কর্ণফুলী নদীর তলদেশ দিয়ে টানেল নির্মাণের কারিগরি ও অর্থনৈতিক সমীক্ষা করেছিল। টানেল চালুর ১০ বছর পর যানবাহন ব্যবস্থাপনার রূপরেখা কী হবে সে বিষয়টি এই সমীক্ষায় রাখা হয়নি। কর্ণফুলী টানেল চালুর পর সেখান দিয়ে ৬৩ লাখ গাড়ি এবং কক্সবাজারের গভীর সমুদ্রবন্দর ও অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলো চালুর হওয়ার পর ২০৩০ সাল থেকে বছরে এক কোটি ৩৯ লাখ গাড়ি চলাচল করতে পারে বলে ওই সমীক্ষায় ধারণা দেয়া হয়েছে। এসব গাড়ির মধ্যে ৫০ শতাংশই পণ্যবাহী গাড়ি।
ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার পরিকল্পনা অনুযায়ী টানেলের মহানগরের অংশ থেকে পতেঙ্গা সৈকত রোড-আউটার রিং রোড হয়ে যানবাহন যাওয়ার কথা ফৌজদারহাটের দিকে। অন্যদিকে, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে-বিমানবন্দর সড়ক হয়ে মহানগরে প্রবেশ করবে যানবাহন। টানেলের বর্তমান ট্রাফিক ম্যানেজমেন্ট পরিকল্পনা ও নকশা অনুযায়ী প্রকল্পের সংযোগ সড়কের বিভিন্ন পয়েন্টে যে নকশা করা হয়েছে তাতে সুফলের পরিবর্তে সংকট তৈরি আশঙ্কার কথা জানিয়েছেন চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ। সূত্রমতে, ২০১৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কর্ণফুলী নদীর তলদেশে দেশের প্রথম টানেলের নির্মাণকাজ উদ্বোধন করেন। এরপর ট্যানেলের পতেঙ্গা প্রান্ত থেকে প্রথম টিউবটির খননকাজ শুরু হয়। গত বছরের ২ আগস্ট প্রথম টিউবের খননকাজ শেষ হয়। শুরু হয় আনোয়ারা প্রান্তে ২য় টিউব খননের কাজ। এরই মধ্যে গেল বছরের নভেম্বর মাসে ট্রাফিকিং ব্যবস্থার ত্রুটি ধরা পড়ে বড় বাজেটে বাস্তবায়নাধীন এ প্রকল্পে। প্রকল্পের ৭৫ শতাংশ কাজ সম্পন্ন হওয়ার পর এই ত্রুটি শনাক্ত করে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ।
চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের ট্রাফিক বিভাগ আপত্তি তুলে জানিয়েছিল নকশায় উত্তরপ্রান্তের প্রবেশ মুখে পাঁচটি সড়ক মিলিত হলেও ট্রাফিক ব্যবস্থা সম্পর্কে কোনো ধরনের পরিকল্পনার কথা উল্লেখ নেই। আইটার রিং রোড, কাটগড় সড়ক, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, এয়ারপোর্টমুখী সড়ক, পতেঙ্গা সৈকতমুখী সড়ক, কর্ণফুলী টানেলের প্রবেশ মুখ— এই পাঁচ সড়কে তীব্র যানজট সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কার কথাও জানানো হয় পুলিশের পক্ষ থেকে। বিষয়টা নজরে আসার পর প্রকল্পসংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলেছে সিএমপি। এরই মধ্যে কিছু প্রস্তাবও দেয়া হয়েছে প্রকল্পসংশ্লিষ্টদের। তারা সিএমপির প্রস্তাব গ্রহণ করেছে। কিন্তু নকশায় কী ধরনের পরিবর্তন আনা হয়েছে সে সম্পর্কে কিছু জানাতে পারছেন না সংশ্লিষ্টরা। টানেল ঘিরে যানজটের শঙ্কার কথা সেতু কর্তৃপক্ষের নজরে আনার পর সিএমপি কমিশনারের নেতৃত্বে ২৮ সেপ্টেম্বর ‘বঙ্গবন্ধু টানেলের উভয়প্রান্তে ট্রাফিক রুট নির্মাণ’ নিয়ে কমিটি করা হয়।
কর্ণফুলী টানেল নির্মাণ প্রকল্পের পরিচালক মো. হারুনুর রশীদ চৌধুরী জানান, চলতি বছরের মে মাস পর্যন্ত প্রকল্পের কাজ ৮৬ শতাংশ শেষ হয়েছে। বাকি কাজ দ্রুত শেষ করে ডিসেম্বর মাসে উদ্বোধনের মাধ্যমে যান চলাচলের জন্য টানেলটি উন্মুক্ত করার লক্ষ্য নিয়েই আমরা কাজ করছি। প্রকল্পের কাজ শেষ হলে ট্রাফিক ব্যবস্থা নিয়ে বিশেষজ্ঞ দল কাজ শুরু করবে। এরইমধ্যে উভয়প্রান্তের ট্রাফিক রুট নির্মাণ নিয়ে গঠিত কমিটির বেশ কয়েকটি বৈঠক হয়েছে। বৈঠকে অ্যাপ্রোচ রোডসহ টানেলের আশপাশের রাস্তা এমনভাবে তৈরি করার পরামর্শ দেয়া হয়েছে, যাতে যানজটের সৃষ্টি না হয়। সুপারিশের আওতায় পরিকল্পনা গ্রহণ করা হবে।
এদিকে, চলতি মাসে কর্ণফুলী টানেলের দ্বিতীয় টিউব (সুড়ঙ্গ) খননের কাজও শেষ হয়েছে। গত বছরের ১২ ডিসেম্বর চট্টগ্রামের আনোয়ারা প্রান্ত থেকে এ খননকাজ শুরু হয়েছিল। দ্বিতীয় এই টিউবটির খনন করতে ১০ মাস সময় লেগেছে। তথ্যমতে, আশি শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে কর্ণফুলী টানেল প্রকল্পের। শেষ হওয়া ২য় টিউবটি পরিষ্কার করার পর জানুয়ারি মাসে এর ভেতরে গাড়ি চালানোর জন্য স্ল্যাভ বসানোর কাজ শুরু হবে বলে জানিয়েছেন প্রকল্পসংশ্লিষ্টরা।
সিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ট্রাফিক) শ্যামল কুমার নাথ বলেন, ‘টানেলের ট্রাফিক পরিকল্পনায় কিছুটা আপত্তি ছিল সিএমপির। সংযোগ সড়কের নকশাগত ত্রুটির কারণে যানজটের শঙ্কার কথা প্রকল্পসংশ্লিষ্টদের জানানো হয়েছে। তারাও সিএমপির মতামত গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নিয়েছেন।’
প্রকল্পসংশ্লিষ্ট সূত্র জানান, টানেলের ট্রাফিক ম্যানেজমেন্টের নকশা পরিবর্তনের জন্য সিএমপির ট্রাফিক বিভাগ কিছু প্রস্তাব দিয়েছে। সেই সব প্রস্তাবের আলোকে কাজ করছে টানেল বাস্তবায়নকারী সংস্থার প্রকৌশল বিভাগ।
চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামস বলেন, ‘ টানেল চালু হলে চট্টগ্রাম নগরীতে যানবাহনের চাপ আরো বাড়বে। এ কারণে আমরা ভবিষ্যতের কথা মাথায় রেখে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ বেশ কিছু উন্নয়ন কর্মকাণ্ড হাতে নিয়েছে। চলতি বছরের ডিসেম্বর মাসের মধ্যে পুরো কাজ শেষ হওয়ার কথা বলছেন প্রকল্পসংশ্লিষ্টরা। এরই মধ্যে এই প্রকল্পের ব্যয় বেড়েছে ৮৪ শতাংশ, আর এখন পর্যন্ত কাজ শেষ হয়েছে ৮৬ শতাংশ।
জানা গেছে, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই প্রকল্পের ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে। চীনা প্রতিষ্ঠান চায়না কমিউনিকেশন কনস্ট্রাকশন কোম্পানি লিমিটেডের (সিসিসিসিএল) প্রস্তাবনার ভিত্তিতে ২০১৫ সালে জুনে প্রকল্প ব্যয় ধরা হয় সাত হাজার ৭৮৪ কোটি ছয় লাখ টাকা। তবে সিসিসিসিএলের কিছু প্রস্তাবে আপত্তি তোলে প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটি (পিইসি)। তবে এরপর নির্মাণ ব্যয় না কমে উল্টো বেড়ে দাঁড়ায় আট হাজার ৪৪৬ কোটি ৬৪ লাখ টাকা। ২০১৫ সালের নভেম্বরে ওই ব্যয়েই প্রকল্পটি অনুমোদন করা হয়েছিল। যদিও ঋণচুক্তি সম্পাদনে দেরি হওয়ায় টানেলের নির্মাণকাজও শুরু হয় নির্ধারিত সময়ের দুই বছর পর। তবে জমি অধিগ্রহণের পরিমাণ বৃদ্ধি, ভ্যাট ও কর পরিশোধের হার বৃদ্ধি, সেফটি অ্যান্ড সিকিউরিটি, পরিষেবা সংযোগ লাইন স্থানান্তর ইত্যাদি খাতে ব্যয় বৃদ্ধির অজুহাতে ২০২০ সালে টানেলটি নির্মাণ ব্যয় বাড়ানো হয়। সে সময় ব্যয়ের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় ৯ হাজার ৮৮০ কোটি ৪০ লাখ টাকা। ওই সময় প্রকল্পটিতে পাঁচ হাজার ৯১৩ কোটি ১৯ লাখ টাকা ঋণ দেয়ার কথা ছিল চীনের এক্সিম ব্যাংক। বাকি তিন হাজার ৯৬৭ কোটি ২১ লাখ টাকা সরকারের তহবিল থেকে সরবরাহ করার কথা ছিল।
কর্ণফুলী টানেল প্রকল্পের আওতায় তিন দশমিক ৪০ কিলোমিটার মূল টানেল ছাড়াও পূর্ব (আনোয়ারা) প্রান্তে ওপেন কাট ২০০ মিটার, কাট অ্যান্ড কাভারের ১৯৫ মিটার, সংযোগ সড়ক ৫৫০ মিটার এবং ২৫ মিটার ওয়ার্কিং শ্যাফট নির্মাণ করা হবে। আর টানেলের পশ্চিম (পতেঙ্গা) প্রান্তে ওপেন কাট ১৯০ মিটার, কাট অ্যান্ড কভারের ২৩০ মিটার, সংযোগ সড়ক ৪ হাজার ৮০ মিটার এবং ২৫ মিটার ওয়ার্কিং শ্যাফট নির্মাণকে প্রকল্পভুক্ত করা হয়েছে। টানেলটি খুলে দেয়া হলে চট্টগ্রাম শহরের সঙ্গে আনোয়ারা, বাঁশখালী, পটিয়া ও চন্দনাইশসহ দক্ষিণ চট্টগ্রাম তথা কক্সবাজার জেলার যোগাযোগ ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন আসবে। আনোয়ারা থেকে সড়কপথে বিমানবন্দর যেতে আগে যেখানে দুই থেকে তিন ঘণ্টা সময় লাগত, টানেল দিয়ে লাগবে মাত্র ৩০ মিনিট।