দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের জন্য দলের ঐক্য ধরে রাখা বড় একটি চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াতে পারে বলে ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। এমপি-মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগের তীর ছোড়ার মধ্য দিয়ে সম্প্রতি শেষ হওয়া দলের বিশেষ বর্ধিত সভা থেকেই এমন বার্তা মিলেছে।
সারা দেশ থেকে আসা তৃণমূলের নেতারা কোনো রাখঢাক ছাড়াই ওই সভায় দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনার সামনে এমপি-মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে বিস্তর অভিযোগ তুলে ধরেছেন। তাদের সেই বক্তব্য গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছেন দলের নীতিনির্ধারকরা। ভাবা হচ্ছে প্রতিকারের উপায়ও।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, তৃণমূলের নেতাদের উত্থাপিত অভিযোগ ও সমস্যাগুলো সমাধান করে ঐক্যবদ্ধভাবে নির্বাচনী কার্যক্রম শুরুর লক্ষ্যে সেপ্টেম্বর মাসের শুরু থেকে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় আট বিভাগীয় টিমকে মাঠে নামানোর কথা ভাবছে দলের হাইকমান্ড। নির্বাচন সামনে রেখে দলকে প্রস্তুত করার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে আজ শনিবার সন্ধ্যায় গণভবনে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের সভা ডাকা হয়েছে। সেখানে সাংগঠনিক সম্পাদকদের রিপোর্টের ওপর আলোচনা করে বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের কর্মপরিকল্পনা নির্ধারণ করা হবে।
সূত্র জানায়, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় টিমগুলো প্রতিটি জেলায় বিশেষ বর্ধিত সভা করে সবার সঙ্গে কথা বলবে। প্রয়োজন হলে পর্যায়ক্রমে উপজেলা, পৌরসভা এমনকি ইউনিয়ন পর্যায়েও বর্ধিত সভা করা হতে পারে। এভাবে সবাইকে আগামী নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীর পক্ষে কাজ করতে উদ্বুদ্ধ করা ও ঐক্যবদ্ধ থাকার ক্ষেত্র প্রস্তুত করা হবে। শনিবারের বৈঠকে এসব বিষয়েই মূলত আলোচনা হবে।
একাধিক কেন্দ্রীয় নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত ৬ আগস্ট আওয়ামী লীগের বিশেষ বর্ধিত সভায় তৃণমূলের নেতারা এমপি-মন্ত্রীদের বিষয়ে যেসব অভিযোগ করেছেন তা নতুন কোনো বিষয় নয়। বেশিরভাগ বিষয়ই নানা মাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে। এমপিদের অনেকেই নিজেদের আধিপত্য বিস্তার করতে দলের ত্যাগী নেতাদের বাদ দিয়ে ভুঁইফোঁড় ও অন্য দল থেকে আসা লোকজনকে নিয়ে নিজস্ব বলয় সৃষ্টি করেছেন। এর ফলে দলের ভেতরে উপদল সৃষ্টি হয়েছে। জন্ম নিয়েছে অভ্যন্তরীণ কোন্দল। এমনকি এই দ্বন্দ্ব বিভিন্ন সময় সংঘাতে রূপ নিয়েছে। নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষের অধিকাংশ ঘটনার পেছনে রয়েছে এমপিদের সঙ্গে তৃণমূলের মতপার্থক্য।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে আওয়ামী লীগের একজন শীর্ষ পর্যায়ের নেতা বলেন, এমপি-মন্ত্রীদের অনেকের মধ্যে এই ধারণা তৈরি হয়েছে যে, নির্বাচনে জয়ী হতে দলের সর্বস্তরের নেতাকর্মীর প্রয়োজন নেই। নিজস্ব কর্মীবাহিনী ও প্রশাসনকে পক্ষে আনতে পারলেই এমপি হওয়া সম্ভব। তবে এই সুযোগ এবার আর কাউকে দেওয়া হবে না। যোগ্যতা কষ্টিপাথরে যাচাই করেই এবার প্রার্থী মনোনয়ন দেওয়া হবে। দলীয় সভাপতি যেসব জরিপ চলিয়েছেন তাতে অনেক বর্তমান এমপির বিরুদ্ধে নানা অভিযোগের তথ্য উঠে এসেছে। ফলে শুধু দলের নেতাকর্মীদের কাছে নয়, নানা অনিয়ম ও স্বজনপ্রীতির কারণে যেসব এমপি জয়প্রিয়তা হারিয়েছেন আগামীতে তাদের বিকল্প নিয়ে চিন্তাভাবনা চলছে। দলীয় মনোনয়ন দেওয়ার ক্ষেত্রে আগামীতে জরিপকে গুরুত্ব দেওয়ার কথা বর্ধিত সভাতেও পরিষ্কার করে দিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি।
এটা মোটামুটি নিশ্চিত যে, এতকাল দলীয় নেতাকর্মীদের গুরুত্ব না দিয়ে যারা চলেছেন এবং জনগণের মধ্যে পরিচ্ছন্ন অবস্থান যারা তৈরি করতে পারেননি তারা এবার মনোনয়ন পাবেন না। দেখা গেছে, গত ছয়টি জরিপে শতাধিক আসনের এমপির অবস্থান খুবই খারাপ, তাদের মধ্যে বেশ কয়েকজন মন্ত্রীও রয়েছেন। নির্বাচনের আগে তারা যদি এলাকায় নিজেদের অবস্থান উন্নতি করতে না পারেন তাহলে অনেকের কপালেই মনোনয়ন জুটবে না।
এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর অন্যতম সদস্য কাজী জাফরউল্লাহ বলেন, ‘আওয়ামী লীগের নেত্রী সেদিন (বিশেষ বর্ধিত সভা) কীভাবে কী করবেন তার সবটাই বলে দিয়েছেন। তিনি সকলকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে বলেছেন। যারা বাড়াবাড়ি করবেন তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তৃণমূল থেকে মন্ত্রী-এমপিদের বিষয়ে যেসব অভিযোগ উঠে এসেছে সেগুলো তিনি গ্রহণ করেছেন। ওখানেই সেগুলো সমাধানের কমিটমেন্ট করেছেন। কাজেই এখন আর আমরা এসব সমস্যা নিয়ে চিন্তিত নই। তা ছাড়া এরকম বড় দলের মধ্যে এই ধরনের কিছু সমস্যা থাকেই। আর টানা ক্ষমতায় থাকার কারণে অনেকেই স্ট্যাটাস চায়। এসব সমস্যা আছে। এসব বিষয়ে আমরা নেত্রীর নির্দেশ অনুযায়ী এগিয়ে যাব।’
আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম বলেন, বিশেষ বর্ধিত সভায় তৃণমূলের নেতাদের বক্তব্যে তাদের ক্ষোভ, দুঃখ, বঞ্চনার কথা বেরিয়ে এসেছে। এসব সমস্যা দূর করার জন্য যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে সেই জনপ্রতিনিধিদের এগিয়ে আসতে হবে। কারণ তারা সবাই সেখানে উপস্থিত ছিলেন। তিনি মনে করেন, ওই সভার মধ্য দিয়ে দলে ঐক্য প্রতিষ্ঠায় সবার মধ্যে একটা তাগিদ সৃষ্টি হয়েছে। কার কোথায় ভুল সেগুলো সামনে চলে এসেছে। যেহেতু নির্বাচনের এখনও কয়েক মাস বাকি রয়েছে, তাই এসব বিষয় কাটিয়ে উঠতে সবাই সচেষ্ট হবেন বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।
প্রসঙ্গত, গত ৬ আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন গণভবনে আওয়ামী লীগের বিশেষ বর্ধিত সভা অনুষ্ঠিত হয়। দলের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদ, উপদেষ্টা পরিষদ, জেলা, উপজেলা ও পৌরসভা (জেলা সদরের) ও সহযোগী সংগঠনের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক, সব মিলিয়ে প্রায় তিন হাজারের মতো নেতা এই সভায় উপস্থিত ছিলেন।
আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা ও সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ছাড়াও সারা দেশ থেকে আসা তৃণমূলের প্রায় ৪৩ নেতা এই সভায় বক্তব্য দেন। তৃণমূলের নেতাদের কেউ কেউ অভিযোগ করেন, মন্ত্রী-এমপিরা তাদের এলাকার নেতাকর্মীদের খোঁজ রাখেন না। নিজস্ব বলয় সৃষ্টি করে তাদেরকে পাশ কাটিয়ে চলেন। দলের দুস্থ ও অসহায় নেতাকর্মীদের পরিবর্তে নিজের ঘনিষ্ঠজনদের সব সুযোগ-সুবিধা দেন।