ইরানে নারীর পোশাকের স্বাধীনতাসহ বিভিন্ন দাবিতে প্রায় এক মাস ধরে গণ-আন্দোলন চলছে। পাশাপাশি কেউ কেউ সরকার পতনের দাবিও জানাচ্ছেন। দেশটির সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনিকে সরানোর দাবিতে স্লোগান পর্যন্ত উচ্চারিত হয়েছে। কিন্তু সেটা খুব সহজ কাজ নয়। খামেনি তো কেবল ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা নন, তার হাতেই রয়েছে দেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, এমনকি সামরিক নির্দেশনা দেয়ার মূল চাবিকাঠি।
খামেনি কার্যত ইরানকে পরিচালনা করেন। কারণ, তার নির্দেশনাতেই দেশটির প্রেসিডেন্ট সিদ্ধান্ত নেন এবং সেগুলোর বাস্তবায়ন করেন। বিবিসির প্রতিবেদন অনুযায়ী, ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি সরাসরি পাঁচটি বিভাগ নিয়ন্ত্রণ করেন। দেশের প্রেসিডেন্টের কার্যালয়, বিচার বিভাগ, আইন পরিষদ, উপদেষ্টা পরিষদ (গার্ডিয়ান কাউন্সিল) ও সামরিক বিভাগ খামনির নিয়ন্ত্রণাধীন। আর সামরিক বিভাগে রয়েছে সেনাবাহিনী, পুলিশ এবং ইসলামি রেভ্যুলেশনারি গার্ড। আবার এই রেভ্যুলেশনারি গার্ডের রয়েছে দুটি শাখা। একটি হলো নৈতিকতা পুলিশ (মোরালিটি পুলিশ) আর অন্যটি হলো আধা সামরিক স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী বাসিজ।
বর্তমানে মধ্যপ্রাচ্যের অন্যতম ক্ষমতাধর দেশ ইরানের রাজনৈতিক ক্ষমতার শীর্ষে আছেন ৮৩ বছর বয়স্ক আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি। কাজেই তার উত্তরসূরি কে হতে পারেন, সেই প্রশ্নের উত্তর জানাটা ইরানের জন্য গুরুত্বপূর্ণ তো বটেই, এমনকি গোটা বিশ্বের জন্যও তাৎপর্যপূর্ণ। তবে প্রশ্ন হলো- ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা যদি কখনো স্বেচ্ছায় নিজের পদ ছেড়ে দেন কিংবা মারা যান, তাহলে কে হতে পারেন পরবর্তী সর্বোচ্চ নেতা।
সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা কীভাবে নির্ধারণ করা হয়: এই পদে কে থাকবেন তা নির্ধারণ করে বিশেষজ্ঞমণ্ডলী বা অ্যাসেম্বলি অব এক্সপার্টস নামের ৮৮ জন ধর্মীয় নেতার একটি পরিষদ। ১৯৭৯ সালে ইসলামি বিপ্লবের প্রথম সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা রুহুল্লাহ খোমেনির মৃত্যুর পর আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি এই পদে আসীন হন। এই বিশেষজ্ঞমণ্ডলীর সদস্যদের নির্বাচন করা হয় প্রতি আট বছর অন্তর। কিন্তু গোষ্ঠীর সদস্য পদের জন্য কারা প্রার্থী হতে পারবেন তা নির্ভর করে দেশটির গার্ডিয়ান কাউন্সিল নামে একটি উপদেষ্টা পরিষদের অনুমোদনের ওপর। আর এই গার্ডিয়ান কাউন্সিলের সদস্যরা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে নির্বাচন করেন দেশটির সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা। অর্থাৎ এই দুটি পরিষদের বিশেষজ্ঞমণ্ডলীর ওপর সর্বোচ্চ নেতার প্রভাব থাকে। গত তিন দশক ধরে আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি নিশ্চিত করেছেন যে, বিশেষজ্ঞমণ্ডলীর নির্বাচিত সদস্যরা যেন অনুগত হন; যারা তার উত্তরসূরি নির্বাচনের সময় তারই নির্দেশ মেনে চলবেন।
ইরানের প্রভাবশালী বিশেষজ্ঞমণ্ডলী সর্বোচ্চ নেতাকে নিয়োগ করেন এবং তাকে অপসারণের ক্ষমতাও তাত্ত্বিকভাবে তাদেরই হাতে। নির্বাচিত হওয়ার পর সর্বোচ্চ নেতা তার পদে আজীবন বহাল থাকতে পারেন। ইরানের সংবিধান অনুযায়ী, সর্বোচ্চ নেতা হবেন একজন ‘আয়াতুল্লাহ’, অর্থাৎ যিনি শিয়া সম্প্রদায়ের একজন শীর্ষস্থানীয় নেতা। কিন্তু আলি খামেনিকে যখন নির্বাচন করা হয়েছিল, তিনি ‘আয়াতুল্লাহ’ বা শিয়া সম্প্রদায়ের শীর্ষ নেতা ছিলেন না। তখন তিনি যাতে এই দায়িত্ব গ্রহণ করতে পারেন, তার জন্য আইন পরিবর্তন করা হয়েছিল। কাজেই প্রয়োজনে আইন আবার পরিবর্তন করা সম্ভব। যখন নতুন নেতা নির্বাচনের সময় আসবে, তখন রাজনৈতিক পরিস্থিতির আলোকে আইন পরিবর্তনের রাস্তা খোলা রয়েছে।
কেন এই নির্বাচন গুরুত্বপূর্ণ: ইরানে চূড়ান্ত ক্ষমতার অধিকারী দেশটির সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতার পদাধিকারী ব্যক্তি। দেশটির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোতে তার নির্দেশই শেষ কথা। দেশটির নীতিমালার রূপকার তিনি, বহির্বিশ্বের সঙ্গে ইরানের সম্পর্কের মূল নির্দেশকও তিনি। ইরান বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী শিয়া মতাবলম্বী দেশ এবং আলি খামেনির নেতৃত্বে ইরান মধ্যপ্রাচ্যে তার প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছে। তার মৃত্যু গোটা মধ্যপ্রাচ্যে ইতিহাসের মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারে। ইরানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের এবং ইসরায়েলের বিরোধের ফলে বহু বছর ধরে অস্থিতিশীল ও উত্তেজনাময় পরিস্থিতি বিরাজ করছে, যার প্রধান কারণ এই দুটি দেশের ব্যাপারে আলি খামেনির ব্যক্তিগত অপছন্দ। তবে দেশটিতে তার উত্তরসূরি নির্বাচনের যে প্রক্রিয়া রয়েছে তার পরিচালনা পদ্ধতির কারণে এটা স্পষ্ট, যিনিই এই পদে আসুন না কেন, তিনি আলি খামেনির নির্ধারিত পথেই চলবেন।
কে হতে পারেন পরবর্তী সর্বোচ্চ নেতা: ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের রাজনৈতিক উপদলগুলো পরবর্তী উত্তরসূরি কে হবেন তা জানতে বেশ আগ্রহী। কিন্তু ইরানে এমন কোনো ক্ষমতাধর ব্যক্তি নেই যিনি একটা সংকট প্রতিরোধ করার জন্য নেতৃত্ব দিতে পারেন। আলি খামেনির অনুগত মহলে তার একটা বড় প্রভাব রয়েছে। এদের বেশির ভাগই ইরানের সবচেয়ে ক্ষমতাধর বাহিনী রেভল্যুশনারি গার্ডের সদস্য।
ইরানের পরবর্তী সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা হিসেবে সম্ভাবনাময় অনেকের নাম নিয়ে জল্পনা চলছে। তবে তাদের মধ্যে রেভল্যুশনারি গার্ডের নেতা মেজর জেনারেল হোসেইন সালামি, খামেনির ছেলে মোজতাবা এবং বর্তমান প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসির মধ্যে থেকে কাউকে বাছাই করা হবে বলে ধারণা করা হয়। কিন্তু রেভল্যুশনারি গার্ড যদি কোনো প্রার্থীকে পরবর্তী সর্বোচ্চ নেতা হিসেবে দেখতে না চায় বা তারা যদি কোনো প্রার্থীকে অপছন্দ করে, তাহলে তাকে ঠেকানোর চেষ্টা করতে পারে। তবে পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে বা বিভিন্ন ঘটনার নিরিখে বলা যায়, আলি খামেনির পছন্দের উত্তরসূরির হতে পারেন মোজতোবা ও রাইসি। সম্ভাব্য প্রার্থীদের অত্যন্ত গোপনীয় একটি তালিকা ইতিমধ্যে তৈরি করা হয়েছে বলে গুজব রয়েছে। তবে ওই তালিকায় কার কার নাম আছে তা জানার উপায় নেই, সেই দাবিও ইরানে কেউ করেন না।