চলতি বছর সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার জিতেছেন নরওয়ের সাহিত্যিক জন ফসে। জন ফসে সম্পর্কে নোবেল কমিটি এই বাক্যে বলেছে, এ হচ্ছেন সেই লেখক যার লেখার উদ্ভাবনী শক্তি তাদের কথা বলে যারা কথা বলতে পারেন না। সমাজের নিপীড়িত মানুষের কণ্ঠস্বর হয়ে বিশ্ব দরবারে সর্বোচ্চ পুরস্কারের স্বীকৃতি পেয়েছেন ফসে।
বৃহস্পতিবার (৫ অক্টোবর) বিকালে নোবেল জেতার পরপরই ফসেকে নিয়ে ইউরোপের সাংস্কৃতিক প্রতিবেদক অ্যালেক্স মার্শাল সংবাদমাধ্যম নিউইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলেছেন, খুব বেশিদিন হয়নি ইংরেজি ভাষাভাষীরা ফসেকে চিনতে শুরু করেছে। কিন্তু চিনতে পারার পর খুব বেশিদিন অপেক্ষা করতে হয়নি ফসের নামের পাশে নোবেলজয়ীর তকমা যোগ করতে। নরওয়েজিয়ান উচ্চারণে জন ফসের নামের উচ্চারণ 'ইউন ফসেহ'।
এশীয় মানুষের কাছে ফসে সুপরিচিত না হলেও, পশ্চিমে ২০১০ সালের পর থেকেই ফসের নাম উচ্চারণ হয়ে আসছে সম্মানের সঙ্গে। ২০১৩ সালে যে বছর কানাডার সাহিত্যিক এলিস মুনরো ছোটগল্পের জন্য নোবেল জিতলেন, সে বছর ফসে নোবেল জিতবে এ সংক্রান্ত বাজি ধরার কারণে ব্রিটেনের কয়েকটি প্রকাশনীকে শাস্তির মুখোমুখি পর্যন্ত হতে হয়েছিল।
গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ এবং অনুবাদ সাহিত্যে ফসে সমান তালে লেখালেখি চালিয়ে গেলেও, ফসে নোবেল পেয়েছেন মূলত তার নাট্যসাহিত্যের জন্য। ইউরোপের অনেকেই ফসের লেখার ঢংকে সাবেক নোবেলজয়ী কিংবদন্তী সাহিত্যিক স্যামুয়েল ব্যাকেট এবং হারলড পিন্টারের সঙ্গে তুলনা করে থাকেন।
এবারের নোবেল জয়ে সম্মান এবং জনপ্রিয়তার পাশাপাশি ফসে পাচ্ছেন ১১ মিলিয়ন সুইডিশ ক্রোনা, মার্কিন মুদ্রায় যার মূল্যমান দাঁড়ায় ৯ লাখ ৯১ হাজার ডলার।
১৯৫৯ সালে নরওয়ের পশ্চিম উপকূলে। আশির দশকে ধীরে ধীরে নিজের লেখার মাধ্যমে জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করেন ফসে। নোবেল কমিটির নিজস্ব ওয়েবসাইটে ফসেকে সম্পর্কে বলা হয়েছে, নাট্য রচনায় ফসে নিজেকে বাকি লেখকদের চেয়ে অনেক বেশি আলাদা করতে পেরেছেন। অসহায় মানুষের অসহায়ত্ব, সমাজের হিংসা-বিদ্বেষ, জীবনের অন্তঃসারশূন্যতাকে এতটা শক্তিশালীভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন যা উত্তরাধুনিক যুগে অনন্য।
ফসের নাটক সম্পর্কে থিয়েটার সমালোচক বেন ব্রান্টলি বলেছেন, বেশি না মাত্র ১০-১৫ মিনিট ফসের নাটক দেখলে বোঝা যায় কী মারাত্মক তার লিখনশৈলী। কুশীলবদের দিয়ে সব কিছু বলিয়েও যেন অনেক কিছু উহ্য রেখে দেন ফসে। শিউরে ওঠার মতো একেকটি শব্দ, চমকে ওঠার মতো কাহিনী, হতাশায় ডুবে যাওয়ার মতো বার্তা। একই ঘটনা বারবার ঘটতে থাকে তবু মনে হয় নতুন। নতুন নতুন কিছুর উদ্ভাবন ঘটতে থাকে কিন্তু বারংবার মনেহয় একই জিনিসের পুনরাবৃত্তি হচ্ছে।
ফসের ‘একটি গ্রীষ্মের দিন’ কিংবা ‘এইতো জীবন’ নাটকে কুশীলবদের জীবনে একই ঘটনা ঘটতে থাকে। মঞ্চের বিপরীতে বসে থাকা মানুষগুলো এক পর্যায়ে বুঝতে পারে ইউরোপের সারহীন জীবনের ছবিই যেন দেখছে তারা। তারা যেন বসে আছে একটি দর্পণের সামনে, যেখানে নিজেদের কার্যকলাপ দেখে দেখে তারা বুঝতে পারে সভ্যতা এবং সীমাহীন সুযোগের মধ্যেও তাদের জীবন কতটা অসহনীয়।
নাটকের পাশাপাশি ২০২১ সালে ফসের লেখা বিখ্যাত উপন্যাস সেপটোলজি অনেকের নজর কেড়েছে। বিশেষ করে ১২৫০ পৃষ্ঠার এই সিরিজ উপন্যাসে ফসের বিরমাচিহ্নের ব্যবহার সমালোচকদের কাছে প্রশংসিত হয়েছে। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম গার্ডিয়ান ফসের সেপটোলজি উপন্যাসের একটি অংশ প্রকাশ করেছে যেখানে পঁচিশ লাইনের কোথাও ফুলস্টপ ব্যবহার করেননি ফসে। কমা আর প্রশ্নবোধক চিহ্নে সম্বলিত এই লাইনগুলো হয়তো উত্তরাধুনিক যুগের মানুষের ক্লান্তিকর জীবনেরই প্রতিচ্ছবি।
থমকে যাওয়া, আবার চলতে থাকা, চলতে চলতে আবার প্রশ্ন করা কেন এই পথচলা, কোনদিকে গন্তব্য। উত্তর না পেয়ে আবারও কিছুক্ষণ থমকে গিয়ে চলতে থাকা। এই যে বেদনাদায়ক পুনরাবৃত্তি, এই যে বলতে না পারার ব্যথা, নিজে কী চাই বুঝতে না পারার অসহনীয় যন্ত্রণা, এই অন্তর্মুখী এবং বহির্মুখী নিপীড়নের নীরবতাই কণ্ঠস্বর পেয়েছে ফসের লেখার মাধ্যমে। যে ফসেকে এতদিন ইউরোপবাসী চিনতো, নোবেল পুরস্কারের বদলে এক বিকেলের ব্যবধানে সেই জন ফসে এখন বিশ্বে সমাদৃত।