৪০ বছর ধরে
আনা মারিয়া তর্তোরা রোমের বাজারে বিশ্বস্ত গ্রাহকদের কাছে পাকা টমেটো এবং তাজা শসা
বিক্রি করেছেন। তিনি কখনো ধারণাও করেননি ছোট্ট যে মেয়েটি তার দাদার হাত ধরে সেখানে
তরকারি কেনার জন্য এক সময় লাইনে এসে দাঁড়াতো সে এখন ইতালির পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী
হতে চলেছে। মারিয়া তর্তোরা বলেন, তিনি একজন দারুণ মানুষ ছিলেন এবং তার নাতনীকে খুব
ভালবাসতেন।
সেই ছোট্ট মেয়েটি
জর্জা মেলোনি তার দলকে নির্বাচনে প্রথম স্থানে নিয়ে যাওয়ায় আনা মারিয়া গর্বের সঙ্গে
উত্তেজিত ওঠেন। তিনি আরও বলেন, ও আমার শিম খেয়েই বড় হয়েছে। ভালো খেয়েছে সে এবং
ভালোই বেড়ে উঠেছে।
বাজারটি গারবাতেল্লাতে
নামে একটি এলাকায় অবস্থিত। রোমের দক্ষিণাঞ্চলের এই জায়গাটিতে শ্রমজীবী শ্রেণীর বাস
এবং ঐতিহ্যগতভাবে বামদের একটি ঘাঁটি বলে পরিচিত।
বেনিতো মুসোলিনির
পর ইতালির প্রথম উগ্র ডানপন্থী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পথে থাকা একজন রাজনীতিকের বেড়ে
ওঠার জায়গা হিসেবে এলাকাটি একেবারেই বেমানান। ইতালির নির্বাচনের ফলাফল নিশ্চিত হয়ে
যাওয়ার পর দেশটির রাষ্ট্রপতি সার্জিও মাতারেলা একটি স্থিতিশীল সরকারের নেতৃত্ব কে
দিতে পারবেন সেটি নির্ধারণ করতে দলীয় নেতাদের সঙ্গে পরামর্শ করবেন। জর্জা মেলোনি যুক্তি
দেবেন তিনি এই দায়িত্বের জন্যে একদম সম্মুখভাগে রয়েছেন।
ফ্যাসিবাদী
তকমা
'তিনি আমাদের
এই এলাকার প্রতিনিধিত্ব করেন না। জায়গাটি ঐতিহাসিকভাবে বামপন্থী,' সবজির দোকানের পাশ
দিয়ে বাচ্চাদের ঠেলা গাড়ি নিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় বলছিলেন মার্তা নামের একজন ক্রেতা।
তার বৃদ্ধা
মা লুসিয়ানা আমাকে বলছিলেন জর্জা মেলোনির প্রধানমন্ত্রী হয়ে ওঠার সম্ভাবনার কথা ভেবে
তিনি ভয় পাচ্ছেন। 'আমি গভীরভাবে ফ্যাসিবাদবিরোধী,' যোগ করলেন তিনি।
সে যদি সফল
হয় তবে সেটি একটি খুব কুৎসিত সময় হবে, বলেন তিনি। জর্জা মেলোনি ফ্যাসিবাদীর তকমা তীব্রভাবে প্রত্যাখ্যান
করেন।
সম্প্রতি একটি
ভিডিওতে ইংরেজি, স্প্যানিশ এবং ফরাসি ভাষায় কথা বলার সময় তিনি জোর দিয়ে বলেছিলেন
যে ফ্যাসিবাদী আদর্শ ইতিহাস হয়ে গেছে। কিন্তু এই ইতিহাস একটি দেশের সমস্যার অংশ যে
দেশটি বিশ্বযুদ্ধের পরে নাৎসিবাদ উৎপাটনে জার্মানির সমতুল্য ছিল না। যার ফলে ফ্যাসিস্ট
দলগুলি সেখানে বেড়ে ওঠার সুযোগ পেয়েছে।
২০১২ সালে প্রতিষ্ঠিত
ব্রাদার্স অফ ইতালির রাজনৈতিক শিকড় গাঁথা রয়েছে ইতালিয়ান সোশাল মুভমেন্ট এমএসআই'র
সাথে। মুসোলিনির ফ্যাসিবাদ থেকে যার গোড়াপত্তন।
দলটি যুদ্ধ
পরবর্তী অতি ডানপন্থী লোগোর ব্যবহার অব্যাহত রেখেছে। যাতে রয়েছে তিন রঙা অগ্নিশিখা।
অনেকেই এটিকে মুসোলিনির সমাধিতে জ্বলন্ত আগুন হিসাবে তুলনা করেন।
রোমের সাপিয়েঞ্জা
ইউনিভার্সিটির রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক জিয়ানলুকা প্যাসারেলি বলছিলেন, জর্জা মেলনি
এই প্রতীকটি বাদ দিতে চান না। কারণ এই রাজনীতির পরিচয় থেকে তিনি পালাতে পারবেন না,
এটি তার যৌবন।
তার দল ফ্যাসিবাদী
নয়, তিনি ব্যাখ্যা করেন। 'ফ্যাসিবাদ মানে ক্ষমতা অর্জন করা এবং সবকিছু ধ্বংস করা।
তিনি তা করবেন না, করতে পারবেন না। কিন্তু তার দলে নব্য-ফ্যাসিবাদী আন্দোলনের সাথে
যুক্ত অংশ রয়েছে। তিনি সর্বদা কোন না কোনভাবে এর মধ্যে থেকে খেলে গেছেন।'
তার যৌবন অতি
ডানপন্থী কিনারায় নোঙর করেছে এবং সাধারণ মানুষের কাতারে বেড়ে ওঠা তাকে জনগণের একজন
নারী হিসাবে চিত্রিত করে তুলেছে। যা তার ইমেজের প্রধান বৈশিষ্ট্য।
বামপন্থী বাবা
আর ডানপন্থী মা
রোমে জন্মগ্রহণ
করা জর্জা মেলোনির বয়স যখন মাত্র এক বছর তখন তার বাবা ফ্রান্সেসকো পরিবারকে ছেড়ে
ক্যানারি দ্বীপপুঞ্জে চলে যান। ফ্রান্সেসকো ছিলেন বামপন্থী আর তার মা আনা ডানপন্থী
ছিলেন। অনেকে মনে করেন বাবার অনুপস্থিতিতে প্রতিশোধে অনুপ্রাণিত হয়ে তিনি তার রাজনীতির
পথ বেছে নিয়েছেন।
তার পরিবার
নানাবাড়ির কাছে গারবাতেল্লায় চলে যায়। সেখানেই ১৫ বছর বয়সে নব্য ফ্যাসিবাদী দল
ইতালিয়ান সোশাল মুভমেন্টের যুব ফ্রন্টে যোগ দেন তিনি। পরে দলটির উত্তরসূরি ন্যাশনাল
অ্যালায়েন্সের ছাত্র শাখার সভাপতি হন তিনি।
মার্কো মার্সিলিও
গারবাতেল্লার এমএসআই অফিসে একটি সভা করছিলেন। ঠিক তখন ১৯৯২ সালে জর্জা মেলোনি তার দরজায়
কড়া নেড়েছিলেন। বয়সে দশ বছরের বড় মার্সিলিও তার একজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু এবং রাজনৈতিক
মিত্র হয়ে ওঠেন। মার্সিলিও আজ আবরুজো অঞ্চলের প্রেসিডেন্ট।
হালকা পাতলা
একটা মেয়ে ছিল। কিন্তু সবসময় খুব গুরুগম্ভীর এবং দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, তিনি বলেছেন। তিনি
আরও বলেন, ছাত্র সভাগুলিতে সে নজর কাড়তো। তার হাত থেকে মাইক্রোফোন নিয়ে নিতে চাইলে
যে কাউকে সে থামিয়ে দিত।
বছরের পর বছর
ধরে মার্সিলিও এবং মেলোনি পারিবারিক ছুটি, সামাজিক অনুষ্ঠান এবং বিতর্কের দিনগুলি একসঙ্গে
কাটিয়েছেন। মার্সিলিও তাকে আত্মবিশ্বাসী হয়ে বেড়ে উঠতে দেখেছেন।
নিজের নিরাপত্তাহীনতা
ঢেকে রাখতো সে, বলছিলেন মার্সিলিও। তিনি আরও
বলেন, কিন্তু সম্ভবত এটি তার একটি শক্তি ছিল। কোন একটি সমস্যা মোকাবেলা করার আগে সে
বিষয়ে আরো বেশি জানার জন্য বেশি করে পড়তো।
কমবয়সী মন্ত্রী
২০০৮ সালে ৩১
বছর বয়সে জর্জা মেলোনি ইতালির সর্বকনিষ্ঠ মন্ত্রী হন। তিনি সিলভিও বারলুসকোনির যুব
ও ক্রীড়ামন্ত্রী নিযুক্ত হন। ২০১২ সালে নিজের দল গঠন করার পর ২০১৮ সালের নির্বাচনে
তিনি মাত্র চার শতাংশ ভোট পেয়েছিলেন।
এখন মারিও দ্রাঘির
জাতীয় ঐক্যজোট সরকারের বাইরে থাকা একমাত্র প্রধান দল হিসাবে ব্রাদার্স অফ ইতালি ২২
থেকে ২৬ শতাংশ ভোট জিততে পারে বলে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে। সিলভিও বারলুসকোনির সাথে
তার ডানপন্থী জোট এবং প্রাক্তন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ম্যাটিও সালভিনির লিগ পার্টি মিলে
পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠতার পথে আছে।
মিজ মেলোনি
যদিও ইতালির পশ্চিমা মিত্রদের আশ্বস্ত করার চেষ্টা করছেন। যেমন দ্রাঘি সরকারের ইউক্রেনপন্থাকে
জোরালোভাবে সমর্থন করেছেন, কিন্তু তার কঠোর রক্ষণশীল সামাজিক নীতিগুলি অনেককে উদ্বিগ্ন
করছে।
স্পেনের অতি
ডানপন্থী ভক্স পার্টির এর সাম্প্রতিক সমাবেশে তিনি জোরালো কণ্ঠে বলেছিলেন "প্রাকৃতিক
নিয়মের পরিবারের প্রতি হ্যাঁ আর এলজিবিটি লবিদের জন্য না।"।
লিবিয়া থেকে
আসা অভিবাসীদের নৌকা বন্ধ করতে তিনি নৌ অবরোধের আহ্বান জানিয়েছেন। মেলোনি গণতন্ত্রের
জন্য একটা বিপদ নয়, কিন্তু ইউরোপীয় ইউনিয়নের জন্য বিপদ, বলেছিলেন অধ্যাপক প্যাসারেলি।
তিনি জর্জা
মেলোনিকে হাঙ্গেরি এবং ফ্রান্সের জাতীয়তাবাদী নেতাদের কাতারে ফেলেছেন। তিনি মেরিন ল্য পেন বা ভিক্টর অরবানের মতো একই
দিকে আছেন এবং তিনি 'এক জাতির ইউরোপ' চান। ইতালি পুতিনের ট্রোজান হর্স হয়ে উঠতে পারে।
সে ইউরোপকে দুর্বল করতে কাজ করে যাবে।
ইতালির প্রথম
নারী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার জন্য মিজ মেলোনি তার নারী পরিচয়টি ব্যবহার করেছেন। কিন্তু
প্রফেসর পাসেরেলি বিশ্বাস করেন সেটি তিনি করছেন পুরুষালি রাজনৈতিক ধাঁচে।
'ইতালীয় পরিবারের
আধিপত্য থাকে মায়েদের হাতে। যা একটি পুরুষালি ব্যক্তিত্ব। যিনি রান্নাঘর নিয়ন্ত্রণ
করেন। মেলনি চমৎকারভাবে এই ইমেজটি ব্যবহার করেছেন। যা সরাসরি আমাদের জীবনের কেন্দ্রে
রয়েছে।'
ইতালির দীর্ঘ
অর্থনৈতিক স্থবিরতা এবং প্রবীণদের রাজনীতির সমাজের পরিপ্রেক্ষিতে তিনি তার মিত্রদের
জন্য তিনি আমূল রাজনৈতিক পরিবর্তনের প্রতিনিধিত্ব করবেন। মার্কো মার্সিলিও বলেছেন,
আমি দারুণ অনুভব করছি। যেন একজন বাবা কন্যা সম্প্রদানের নিয়ে যাচ্ছেন। তার এই সম্ভাবনা
রয়েছে এমনটা না ভাবলে আমরা দল প্রতিষ্ঠা করতাম না।
তার পার্টি
সদর দফতরের যখন উৎসব শুরু হবে, পানীয়র বোতল যখন খোলা হবে তিনি তাকে কী বলার পরিকল্পনা
করেছেন? মার্কো মার্সিলিওর উত্তর, এগিয়ে যাও। আমরা সবাই এটাই খুব চেয়েছিলাম। এখন
তার মুখোমুখি হও।