জাপানি মা এরিকো নাকানো নাকি বাংলাদেশি বাবা ইমরান শরীফ, কে হবেন শিশু জেসমিন মালিকা ও লাইলা লিনার অভিভাবক। সে বিষয়ে আগামী ২৯ জানুয়ারি রায় দেওয়া হবে। আজ রোববার ঢাকার ১২ নম্বর পারিবারিক আদালতের বিচারক দুরদানা রহমান মামলার যুক্তি তর্ক শুনানি শেষে এ কথা জানান।
আজ মামলার যুক্তি তর্ক শুনানি শেষ হয়। বড় মেয়েসহ মা এরিকো নাকানো আদালতে উপস্থিত ছিলেন। বাবা ইমরান শরীফও আদালতে উপস্থিত ছিলেন। মা এরিকোর পক্ষে শুনানি করেন অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ শিশির মনির। বাবা ইমরানের পক্ষে শুনানি করেন অ্যাডভোকেট নাসিমা আক্তার। উভয় পক্ষই আদালতে দুই সন্তানের অভিভাবকত্ব দাবি করে যুক্তি তর্ক তুলে ধরেন। দেশ-বিদেশের উচ্চ আদালতের বিভিন্ন নজির তুলে ধরেন। পরে আদালত বলেন, রায়ের তারিখটা পরে জানানো হবে।
জাপানি মা এরিকোর পক্ষে তাঁর আইনজীবী বলেন, দুই সন্তানের বাবা ইমরান শরীফ জাপানে বসবাস করেন। তিনি এরিকোকে ভালোবেসে বিয়ে করেন। ১০ বছর ঘর সংসার করেন। দুজনের মধ্যে মনোমালিন্য হওয়ায় একপর্যায়ে ডিভোর্স হয়। এরপর ইমরান শরীফ জাপানে পারিবারিক আদালতে মামলা করেন। তিনি এক মেয়েকে বাংলাদেশে নিয়ে আসতে চান। সেখানকার পারিবারিক আদালত তাঁকে অনুমতি দেননি। এরপর একদিন বাচ্চারা স্কুল থেকে ফেরার সময় তিনি দুই সন্তানকে অপহরণ করেন। তাঁদের নিয়ে পাসপোর্ট করেন। তাঁদের নিয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে আসেন। ইমরান শরীফ দুই সন্তানকে নিয়ে যেভাবে বাংলাদেশের চলে এসেছেন সেটা কোনো সভ্যতার নিদর্শন না। শিশুদের মঙ্গলের জন্য আদালত আদেশ দেবেন। মায়ের কাছে শিশুরা যেভাবে থাকবে বাবা সেভাবে রাখতে পারবে না। দুই মেয়ে টোকিওর স্কুলে পড়াশোনা করে। তারা সেখানে বড় হচ্ছে। এ দেশে তাদের পড়াশোনার পরিবেশ সৃষ্টি হবে না।
আইনজীবী আরও বলেন, মায়ের আর্থিক কোনো সমস্যা নেই, লাখ লাখ টাকা বেতনে চাকরি করেন। তিনি তাঁর আদর, স্নেহ, ভালোবাসা দিয়ে বাচ্চাদের মানুষ করবেন।
অপরদিকে ইমরান শরীফের পক্ষে তাঁর আইনজীবী বলেন, জাপানে যখন বিয়ে হয় এরিকো ও ইমরান শরীফের তখন ইসলামি শরিয়ত মতে বিয়ে হয়েছিল। বিয়ের আগে অঙ্গীকার করেছিলেন তিনি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করবেন। করেছিলেনও তাই। কিন্তু বিয়ের কিছুদিন পরেই তিনি আবার ধর্মচ্যুত হয়ে যান। এরিকো যথেষ্ট টাকা পয়সার মালিক নন। আর্থিক অনটনের কারণে তিনি সন্তানদের লেখাপড়া করাতে পারবেন না মানুষের মতো মানুষ করতে পারবেন না।
এরিকো এডিক্টেড পারসন বলেও আদালতকে বলেন ইমরান শরীফের আইনজীবী।
আইনজীবী বলেন, জাপানে একটি প্রথা রয়েছে, যদি মা বা বাবা জাপানি না হয়ে অন্য কোনো ভিনদেশি হয় তাদের সন্তানদের উচ্চতর শিক্ষা এবং ভালো কর্মসংস্থান থেকে দূরে রাখা হয়। এখানে এই দুই শিশুর উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ বলে কিছু হবে না। কাজেই বাবার কাছে এই দুই শিশুসন্তান নিরাপদ থাকবে এই দাবি করেন আইনজীবী। দুই পক্ষেই বিভিন্ন আইনগত বিষয়ে যুক্তি তুলে ধরা হয়। তিন ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। পরে আদালত রায়ের তারিখ ধার্য করেন। এর আগে গত ১৫ জানুয়ারি উভয় পক্ষের সাক্ষ্য গ্রহণ শেষ হয়।
প্রসঙ্গত, ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে দুই মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে এরিকো নাকানোর স্বামী ইমরান জাপান থেকে দেশে আসেন। এরপর মেয়েদের অভিভাবক দাবি করে ঢাকার পারিবারিক আদালতে মামলা করেন। একই বছরের ১৮ জুলাই বাংলাদেশে আসেন এরিকো। তাদের ফিরে পেতে ১৯ আগস্ট হাইকোর্টে রিট করেন তিনি। পরে আদালতের নির্দেশে শিশু দুটিকে তেজগাঁওয়ে পুলিশের ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারে রাখা হয় কিছুদিন। সব পক্ষের শুনানি নিয়ে ৩১ আগস্ট হাইকোর্ট গুলশানের ফ্ল্যাটে মায়ের হেফাজতে শিশুদের রাখার আদেশ দেন। কিন্তু এই দেশেই সন্তানদের নিয়ে থাকতে হবে বলে হাইকোর্ট বলেন।
ইমরান শরীফ আদালতকে জানান, স্ত্রীর সঙ্গে ডিভোর্স হয়ে যাওয়ায় তিনি মেয়েদের নিয়ে বাংলাদেশে আসেন। তিনি বাংলাদেশের নাগরিক। তিনি বাংলাদেশেই বসবাস করবেন। তার শিশুসন্তানদের অভিভাবক হিসেবে তিনি এই মামলা দায়ের করেছেন। যেহেতু মা ভিনদেশি তাই তিনি একমাত্র অভিভাবক। এই আদালতে মামলা চলাকালীন তার সাবেক স্ত্রী বাংলাদেশে এসে হাইকোর্টে রিট আবেদন করেন। হাইকোর্টও মেয়েদের বাংলাদেশে রাখার নির্দেশ দিয়েছেন।
উল্লেখ্য, দুই সন্তান নিয়ে জাপানে পালানোর চেষ্টার অভিযোগে জাপানি নারী নাকানো এরিকোর বিরুদ্ধে ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মামলা হয় গত ২৯ ডিসেম্বর। ইমরান শরীফ এই মামলা দায়ের করেন। আদালত এ মামলার ঘটনাটি তদন্ত করার জন্য পিবিআইকে নির্দেশ দেন।