সাতক্ষীরা থেকে দিলীপ কুমার দেব
সাতক্ষীরার হিমসাগর আম ইউরোপের বাজারে পাড়ি জমিয়েছে। গোবিন্দভোগ ও গোপালভোগ আমের পর এবার সাতক্ষীরার নামকরা সুমিষ্টি আম হিমসাগর যাচ্ছে লন্ডন ও ইটালিতে। আম চাষীরা এবার ইউরোপের যুক্তরাজ্য ও ইতালি ছাড়াও ফ্রান্স, জার্মানি, পর্তুগালসহ মধ্যপ্রাচ্যর দেশগুলোতে আম রপ্তানি করছেন। ১৪টি বায়ার কোম্পানি এসব আম সংগ্রহ করছে এবং সাতক্ষীরার মেসার্স ইসলাম ট্রেডার্স-এর মাধ্যমে এই আম বিদেশে রপ্তানি হচ্ছে। করোনা পরিস্থিতির কারণে এক বছর আম বিদেশে রপ্তানি বন্ধ থাকার পর আবারও বিদেশে আম পাঠাতে পেরে বেশ খুশি সাতক্ষীরার আম চাষিরা।
আম চাষ বদলে দিচ্ছে সাতক্ষীরার আম চাষিদের জীবনযাত্রা। ধানের পরিবর্তে সেই জমিতেই আম চাষ করে লাখ লাখ টাকা আয় করছেন কৃষকরা। জেলার এই ‘আম’ অর্থনীতির চাকা বদলে দিয়েছে। সারাদেশে সাতক্ষীরা জেলার হিমসাগর আমের সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছে। দেশের গন্ডি পেরিয়ে বিদেশে যাচ্ছে সাতক্ষীরার আম। এবছর আম মৌসুমে বড় ধরণের প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবলে না পড়ায় আম চাষে লাভের মুখ দেখছে চাষিরা। কৃষক, দিনমজুর থেকে অনেকেই হয়েছেন ‘আমচাষী’। প্রতি বছরই বাড়ছে আম চাষের পরিধি। তবে যাতায়াত ব্যবস্থার কারণে আমের পরিবহণ খরচ বেশি পড়ায় আমের প্রকৃত মূল্য পাচ্ছে না চাষিরা। রাজশাহী থেকে ঢাকা পৌঁছাতে কেজি প্রতি আমের খরচ পড়ছে মাত্র এক টাকা ১৭ পয়সা। সেখানে সাতক্ষীরা থেকে ঢাকা পৌঁছাতে আমের কেজি প্রতি খরচ পড়ছে ১২ টাকা থেকে ১৫ টাকা। এরপরও গতকাল শুক্রবার থেকে ইউরোপের পথে সাতক্ষীরার আম। এদিকে দ্বিতীয় দফায় দেশের গন্ডি পেরিয়ে ইউরোপে যাচ্ছে সাতক্ষীরার আম। ৫ হাজার কেজি হিমসাগর আম ইতালি, ফ্রান্স ও লন্ডনে রফতানির জন্য সাতক্ষীরা থেকে যাত্রা শুরুর মাধ্যমে এ মৌসুমে এই সাতক্ষীরা থেকে আম রফতানি শুরু হলো। আম চাষিরা বলছেন, বিদেশে আম পাঠাতে পেরে তাঁরা খুবই খুশি।
সাতক্ষীরা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সূত্র জানায়, আগের দুই বছর প্রথমবার যে দামে আম রফতানি হয়েছিল, এবার তার চেয়ে অনেক বেশি আম রফতানি হচ্ছে সাতক্ষীরা থেকে। শুক্রবার সকালে সাতক্ষীরা সদর উপজেলার মাধবকাটি ছয়ঘরিয়া গ্রামের কৃষক মোঃ হাফিজুর রহমানের আম বাগান থেকে সরকারি নিয়ম মেনে ৫ মেট্রিক টন হিমসাগর আম পাঠানো হয়েছে। রফতানি কার্যক্রমের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসক এসএম মোস্তফা কামাল। এসয় তাঁকে সহযোগিতা করেন সাতক্ষীরা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর উপপরিচালক কৃষিবিদ মোঃ নূরুল ইসলাম। সাতক্ষীরার মেসার্স ইসলাম ট্রেডার্স-এর মাধ্যমে এই আম বিদেশে রপ্তানি হচ্ছে। ১৪টি বায়ার কোম্পানি জেলার প্রান্তিক পর্যায় থেকে এসব আম সংগ্রহ করছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর রপ্তানিকৃত আমের জন্য সাড়ে ৩শ’ চাষীকে আলাদা প্রশিক্ষণ দিয়েছে। রপ্তানিকারকরা ন্যায্য মুল্যে আম ক্রয় করে সকল প্রস্তুতি শেষে বিদেশে পাঠাচ্ছে। ফলে চাষী ও ব্যবসায়ী উভয় লাভবান হওয়ার পাশাপাশি দেশে রেমিটেন্স আসবে বলে জানায় সাতক্ষীরা কৃষি অধিদপ্তর।
সাতক্ষীরা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর জানায়, এর আগে সাতক্ষীরা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ও এফএও এর যৌথ কারিগরী সহায়তায় গত ৯ মে জার্মানীতে রপ্তানীর উদ্দেশ্যে সাতক্ষীরা ছাড়ে এক হাজার কেজি গোবিন্দভোগ ও গোপালভোগ জাতের আম। সাতক্ষীরার মাটি ও আবহাওয়া অনুকূলে হওয়ায় অন্যান্য স্থানের তুলনায় আগেই বাজারজাত করা যায় সাতক্ষীরার আম। আমের স্বাদও বেশ ভালো। এসব কারণে ২০১৪ সাল থেকে সাতক্ষীরার আম রপ্তানি হচ্ছে ইউরোপের ফ্রান্স, জার্মানি, যুক্তরাজ্য, ইতালি ও পর্তুগালে। গত মৌসুমে ঘূর্ণিঝড় আম্পানের কারণে রপ্তানি বিঘ্নিত হলেও কৃষি বিভাগের প্রচেষ্টায় এবং বেসরকারি সংস্থা উত্তরণ ও সলিডারিডাড নেটওয়ার্ক এশিয়ার সফল প্রকল্পের সহযোগিতায় চলতি মৌসুমে ৮ মে থেকে গোবিন্দভোগ ও গোপালভোগ জাতের আম পাঠানোর মাধ্যমে বিদেশে আম রপ্তানি কার্যক্রম শুরু হয়। এদিকে নির্ধারিত সময়ের আগেই অপরিপক্ক হিমসাগর আম বিক্রির অভিযোগ উঠেছে। ২১ মে থেকে সরকারী ভাবে হিমসাগর আম পাড়ার কথা থাকলেও গত ১৫ দিন ধরে সাতক্ষীরার বাজারে দেদারসে হিমসাগর আম বিক্রি হচ্ছে। এসব অপরিপক্ক আমের রং বাড়াতে ক্ষতিকর রাসায়নিক (ক্যামিকেল) মিশিয়ে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্নস্থানে পাঠাচ্ছে মুনাফালোভী আম চাষী ও ব্যবসায়ীরা। বিভিন্ন আম চাষী ও আড়তদারদের সাথে কথা বলে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। বাজার মনিটরিং কমিটিও নিয়মিত তদারকি করলেও আম বাগান বা গাছ তলায় কোন তদারকি না থাকায় আমে ক্যামিকেল মেশানো সহজ কাজ বলে মনে করেন আম চাষীরাও। বেশী লাভের আশায় অনেক আম চাষী অপরিপক্ক আম পেড়ে রাসায়নিক দ্রব্য মিশিয়ে তা বাজারে বিক্রি করছে। গত কয়েকদিনে বেশ কয়েকটি বাজার ঘুরে তথ্যানুন্ধানে এসব জানা গেছে।
ব্যবসায়িরা জানান, ক্ষতিকর ক্যামিকেল মেশানো আম সাতক্ষীরার বাজারে বিক্রি হয় না। বাজারে বর্তমানে আমের ভিতরে ৫০ ভাগ কাঁচা ও ৫০ ভাগ পাকা দেখেই পাইকাররা আম কিনে থাকে। ক্রয় করা আম ট্রাকে লোড দিয়ে ঢাকা বা তার বাইরে যেতে ৩/৪ দিন সময় লাগবে। ট্রাক থেকে তিন চার দিন পর আম আনলোড করার পর আমটি সম্পূর্ন পেকে যাবে। এ অবস্থায় আমে ক্ষতিকর কেমিকেল মেশানোর প্রয়োজনই নেই। তারা আরও জানান, বাজারে বর্তমানে প্রতি মন হিমসাগর আম ১৪ থেকে দুই হাজার টাকা, গোবিন্দভোগ ১৬ থেকে ১৮শ’ টাকায়, গোপালভোগ ১৪ থেকে ১৬শ’ টাকায় ও আটিগুটি সাত থেকে আটশ’ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
আমচাষীরা জানান, আম বেচাকেনার জন্য সাতক্ষীরার বিভিন্ন স্থানে সৃষ্টি হয়েছে পাইকারি হাটবাজার ও আড়ত। আমের মৌসুমে ওই আম বাজারের আড়তে স্থানীয় ও পার্শ্ববর্তী এলাকার আমগাছের আম বেচাকেনা হচ্ছে। দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে পাইকররা এখানে এসে ট্রাক ট্রাক আম কিনে নিয়ে যাচ্ছেন। আবার স্থানীয়দের পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন এলাকার আম ব্যবসায়ী অনেকে কয়েক মাস আগে থেকেই এখানে এসে গাছ দেখে অগ্রিম আমসহ গাছ কিনে নেন। অনেকে এখন একেকটি আম গাছ কয়েক বছরের জন্য কিনে নেন, যা ফলন হবে সেটার জন্য। ওই সকল আম গাছের পরিচর্যা, দেখভাল, আমভাঙা, বাজারজাতকরণ, বেচাকেনাসহ সার্বিক এই আমকে ঘিরে তৈরি হয়েছে অনেকের কর্মসংস্থান।
কলারোয়া উপজেলা কৃষি অফিসার কৃষিবিদ মোঃ রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘বাইরে থেকে যারা আম কিনতে আসবেন, তাদেরকে কমপক্ষে তিন দিন কোয়ারিন্টিনে থাকতে হয়। এছাড়া আম চাষিদের সুবিধার্থে ২১ মে হিমসাগর, ২৭ মে ল্যাংড়া, ৪ জুন আম্রপালি ভাঙার তারিখ নির্ধারণ করা হয়েছে।’ তিনি আরো জানান, ‘আমের মৈৗসুমের শুরু থেকে মাঝামাঝি পর্যন্ত কলারোয়ায় ঝড়-বৃষ্টি হয়নি। তবে তাপদাহে আম কিছুদিন আগে থেকে পরিপক্ক হয়েছে। তাই আমভাঙার দিন ও তারিখও এগিয়ে আনা হয়েছে।’
সাতক্ষীরা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপপরিচালক কৃষিবিদ মোঃ নুরুল ইসলাম বলেন, এবার সাতক্ষীরা জেলায় ৪ হাজর ১শ হেক্টর জমিতে ৪০ হাজার মেট্রিক টন আম উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। এর মধ্যে বিভিন্ন জাতের ৫০০ মেট্রিক টন আম বিদেশে রফতানি করা হবে।
সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসক এসএম মোস্তফা কামাল বলেন, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের সহযোগিতায় সফল প্রল্পের মাধ্যমে সাতক্ষীরা অঞ্চল থেকে নিরাপদ স্বাস্থ্যসম্মত আম রফতানি হচ্ছে। আশা করছি এই আম রফতানি ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকবে।