ইউরো অঞ্চলে মূল্যস্ফীতির গতি কিছুটা ধীর হয়েছে। ইউরো মুদ্রা ব্যবহার করা দেশগুলোয় নভেম্বরে ভোক্তা মূল্য সূচক (সিপিআই) ১০ শতাংশ বেড়েছে। ১৯ দেশের অঞ্চলটিতে অক্টোবরে এ হার রেকর্ড ১০ দশমিক ৬ শতাংশে উন্নীত হয়েছিল। এক বছরেরও বেশি সময় ধরে ঊর্ধ্বমুখী থাকার পর বছরওয়ারি মূল্যস্ফীতির গতি গত মাসে কিছুটা শ্লথ হয়েছে। যদিও তা এখনো দুই অংকের ঘরে রেকর্ডের কাছাকাছি রয়ে গিয়েছে। এ পরিস্থিতি ভোক্তাদের ব্যয় সক্ষমতা কমিয়ে দিয়েছে এবং অর্থনৈতিক মন্দার ঝুঁকি বাড়িয়ে দিয়েছে।
এপির একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইউক্রেনে রুশ আগ্রাসনের পর থেকেই জ্বালানি ও খাদ্যপণ্যের বাজারে অস্থিরতার কারণে ইউরো অঞ্চলের মূল্যস্ফীতি ঊর্ধ্বমুখী ছিল। তবে জ্বালানির দাম কিছুটা কমায় মূল্যস্ফীতির চাপও ধীর হয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) পরিসংখ্যান সংস্থা ইউরোস্ট্যাট জানিয়েছে, নভেম্বরে খাদ্য, অ্যালকোহল ও তামাকপণ্যের দাম গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ১৩ দশমিক ৬ শতাংশ বেড়েছে। এ সময়ে জ্বালানির দাম বছরওয়ারি ৩৪ দশমিক ৯ শতাংশ বেড়েছে। যেখানে অক্টোবরে এ হার ছিল ৪১ দশমিক ৫ শতাংশ।
ইউক্রেনে রুশ আগ্রাসনের পরিপ্রেক্ষিতে জ্বালানি সরবরাহ নিয়ে অনিশ্চয়তায় ইউরোপে প্রাকৃতিক গ্যাসের দাম আকাশচুম্বী হয়েছিল। এরই মধ্যে রাশিয়া ইউরোপে গ্যাস সরবরাহে লাগাম টেনেছে। এতে ইউরোপকে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের ব্যয়বহুল চালানের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র ও কাতার থেকে জাহাজে আসা এ গ্যাস অঞ্চলটির বিদ্যুৎ উৎপাদন ও ঘর গরম রাখার কাজে ব্যবহার হচ্ছে। তরলীকৃত এ গ্যাস দিয়ে অঞ্চলটি শীত মোকাবেলা করতে পারলেও সংকটে পড়েছে ইস্পাত ও সারের মতো শিল্পগুলো। উচ্চমূল্যের গ্যাস প্রতিষ্ঠানগুলোকে লোকসানের মুখে ঠেলে দিয়েছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, অতিরিক্ত জ্বালানি বিল এবং খাদ্যের মতো মৌলিক জিনিসগুলো আরো ব্যয়বহুল হয়ে যাওয়ায় ভোক্তাদের ব্যয় করার সক্ষমতা কমে গিয়েছে। স্বল্পমেয়াদি কেনাকাটার ক্ষেত্রে প্রাকৃতিক গ্যাসের দাম কমলেও আগামী মাসগুলোয় উচ্চ পর্যায়ে থেকে যাবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। অর্থাৎ ব্যয়বহুল জ্বালানি ইউরো অঞ্চলের অর্থনীতিকে ক্রমাগত টেনে ধরতে পারে। ইউরোপিয়ান সেন্ট্রাল ব্যাংকের পূর্বাভাস নিয়ে এক সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, আগামী বছর মূল্যস্ফীতি ৫ দশমিক ৮ শতাংশ হবে। যদিও তিন মাস আগের সমীক্ষায় ৩ দশমিক ৬ শতাংশের পূর্বাভাস দেয়া হয়েছিল।
সম্প্রতি মাংস প্রক্রিয়াকরণ ও সসেজ প্রস্তুতকারকরা ফ্রান্সের পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষের বাইরে জ্বালানির উচ্চ দাম নিয়ে প্রতিবাদ জানিয়েছে। তাদের ফেডারেশনের সভাপতি ক্রিশ্চিয়ান নোসাল বলেন, মাংস হিমায়িত করার জন্য জ্বালানির দাম ক্রমবর্ধমান রয়েছে। আমরা এ মূল্যবৃদ্ধি পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে পারছি না। এমনিতেই জীবনযাত্রার ব্যয় ব্যাপকভাবে বেড়ে গিয়েছে এবং আমরা গুরুতর সমস্যার মধ্যে রয়েছি। আমাদের ভয় হলো, আমরা চলতি বছরের শেষে বা আগামী বছরের শুরুতে অনেক মাংস প্রক্রিয়াজাত কারখানা বন্ধ হতে দেখব। এদিকে এ পরিসংখ্যান ইঙ্গিত দিচ্ছে ইউরোপিয়ান সেন্ট্রাল ব্যাংক (ইসিবি) সুদের হার বৃদ্ধি ধীর করতে পারে। অর্থনীতি গবেষণা প্রতিষ্ঠান অক্সফোর্ড ইকোনমিকসের অর্থনীতিবিদদের মতে, ব্যাংকটি সর্বশেষ দুটি সভায় তিন-চতুর্থাংশীয় পয়েন্ট করে সুদের হার বাড়িয়েছে। তবে ১৫ ডিসেম্বরে অনুষ্ঠেয় বৈঠকে অর্ধ শতাংশীয় পয়েন্ট বাড়ানো হবে বলে আশা করা হচ্ছে। তবে তারা বলেছেন, মূল্যস্ফীতি উচ্চ পর্যায়ে রয়ে যাবে। তবে মূল্যস্ফীতি ধীর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মুদ্রানীতি কঠোর করার গতিও শ্লথ হবে।
সম্প্রতি ইউরোপীয় সংসদে দেয়া বক্তব্যে ইসিবির প্রেসিডেন্ট ক্রিস্টিন লাগার্ড বলেন, এমন কোনো ইঙ্গিত দেখতে পাচ্ছি না যে আমরা মূল্যস্ফীতির সর্বোচ্চ সীমায় পৌঁছে গিয়েছি এবং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এটি কমতে চলেছে। বরং মূল্যস্ফীতির চাপ আরো বাড়ার ঝুঁকি দেখা যাচ্ছে। এজন্য তিনি আগ্রাসীভাবে সুদের হার বাড়ানো অব্যাহত থাকার ইঙ্গিত দিয়েছিলেন।