
জয়পুরহাট প্রতিনিধি:
কৃষির উপর নির্ভরশীল দেশের উত্তরের জেলা জয়পুরহাট। ধান ও আলুর উৎপাদনে উদ্বৃত্ত জেলা জয়পুরহাটের কৃষকরা এবার গ্রীষ্মকালীন তরমুজ ইয়োলো, গ্রিন, বস্ন্যাকবেরি, মধুমালা, জেসমিন ও তইওয়ানের গোল্ডেন ক্রাউনসহ কয়েক রকমের তরমুজ চাষে সফলতা অর্জন করেছে। কম খরচে অধিক লাভ আর বারোমাস ফলন হওয়ায় এ তরমুজ চাষে ঝুঁকছেন এই অঞ্চলের চাষিরা। নিজ জেলার চাহিদা পূরণ করার পাশাপাশি বানিজ্যিকভাবে দিন দিন জনপ্রিয় হয়ে উঠছে মাচা পদ্ধতিতে বিদেশী নানান জাতের এই তরমুজের চাষ।
পাঁচবিবি উপজেলার শিরট্টি, ভূতড়াড়ি ও মাধাইনগর এলাকার কয়েকটি গ্রাম ঘুরে কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কম খরচে বেশি লাভ হওয়ায় অন্য ফসল বাদ দিয়ে অসময়ের ফসল এ তরমুজ চাষে ঝুঁকছেন এলাকার কৃষকরা। সাধারন অসময়ে ক্ষেতে তরমুজ মাচায় মাচায় ঝুলছে চায়না ও থাইলান্ডের মধুমালা আর তৃপ্তি জাতের তরমুজ। বাজার মূল্য অনেক ভালো হওয়ায় ধানসহ অন্যান্য ফসল বাদ দিয়ে কালচে ও হলুদ রঙের তরমুজ চাষে ঝুঁকছেন এখানকার কৃষকরা। খাদ্য গুণাগুণে সমৃদ্ধ এ ফলের ভেতরে দেখতে লাল ও রসাল, খেতেও অনেক সুস্বাদু এবং মিষ্টি। ফলে বাজারে এ তরমুজের চাহিদাও অনেক বেশি। বর্তমানে এ তরমুজ জেলার বিভিন্ন আনাচে-কানাচে বিক্রির পাশাপাশি পাঠানো হচ্ছে ঢাকা সহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে।
জেলার পাঁচবিবি উপজেলার আওলাই ইউনিয়নের ভূতগাড়ি গ্রামের সোহেল, সুজাউল, ডাবলু, দুলু মিয়াসহ অনেকেই বিদেশী জাতের এই তরমুজের চাষ করছেন। জমিতে বেড করে মাটির সঠিক আদ্রতা ধরে রাখতে মালচিং পেপার দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছে। ১৮ ইঞ্চি ফাঁকে জুন মাসে চায়না ও থাইল্যান্ডের মধুমালা আর তৃপ্তি জাতের তরমুজের বীজ রোপন করেন কৃষকেরা। পুরো ক্ষেতে বাঁশের খুঁটির উপরে চিকন দড়ি জালের মতো করে বিছিয়ে মাচা তৈরী করা হয়েছে। মাত্র ৪০ দিনের মধ্যে গাছে ফুল ও কুঁড়ি আসে। আর ৭০-৮০ দিনে পরিপক্ক হয়ে মাচার ডগায় ডগায় ঝুলে পড়ে হলুদ, কালো, ডোরাকাটা নীল রঙের এ তরমুজ। ওইসব তরমুজের ওজন আড়াই থেকে চার কেজি হয়। এখানকার তরমুজগুলো বিষ ও ফরমালিন মুক্ত ও পুষ্টিগুন সমৃদ্ধ বলে দাবী চাষিদের। চহিদা বেশি, ভলো দাম পাওয়ায় খুশি বলেও জানান তারা। অন্যান্য ফসলের মতো তরমুজ বিক্রির জন্য বাজারে যেতে হয় না। ব্যবসায়ীরা ক্ষেত থেকে সরাসরি কিনে নিয়ে যাচ্ছেন।
হাজীপাড়া গ্রামের সফল তরমুজ চাষি পাপ্পু মন্ডল বলেন, পাশের গ্রাম ভূতগাড়ী এলাকায় তরমুজ চাষ হচ্ছে দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে আমার ১০ শতাংশ জমিতে বেড করে চায়না ও থাইল্যান্ডের মধুমালা জাতের তরমুজের বীজ বপন করি। ৪০দিনের মধ্যে গাছে প্রচুর ফুল ও কুড়ি আসে। এখন মাচায় ডোগায় ডোগায় দোল খাচ্ছে আড়াই থেকে চার কেজি ওজনের তরমুজ। তরমুজগুলো কাটলে ভেতরে টুকটুকে লাল, রসাল আর খেতে মিষ্টি ও খুব সুস্বাদু। বর্তমানে বাজারে এ তরমুজের চাহিদা অনেক বেশি, দামও ভালো পাওয়া যাচ্ছে। প্রতিটি তরমুজ গড়ে ২০০ থেকে ২৫০ টাকায় বিক্রী হচ্ছে। খরচ বাদে প্রায় দেড় লাখ টাকার তরমুজ বিক্রী করার আশা করছেন পাপ্পু মন্ডল।
পাশের তরমুজ চাষি দোলন কুমার বলেন, এক ময় ধান, আলু, বেগুনসহ অন্যান্য ফসল আবাদ করতাম। অনেকেই বিদেশী জাতের তরমুজ চাষ করছে দেখে আমি এবার পরীক্ষামূলকভাবে ১ বিঘা জমিতে তিন রকম জাতের তরমুজ চাষ করেছি। ১ বিঘায় খরচ হয়েছে ১২ হাজার টাকা। এ পর্যন্ত প্রায় এক লাখ টাকার তরমুজ বিক্রি হয়েছে বলে জানান দোলন কুমার। তিনি বলেন- জমিতে থাকা তরমুজ বিক্রি হবে আরও প্রায় ২০ থেকে ৩০ হাজার টাকা। সবকিছু মিলিয়ে খরচ বাদে প্রতি বিঘা জমিতে লাভ থাকবে প্রায় ১ লাখ ২৫ হাজার টাকা।
এদিকে দেখা গেল তরমুজের ক্ষেত দেখতে ভিড় করছেন বিভিন্ন এলাকার লোকজন। আবার কেউ কেউ তরমুজ কিনে নিয়ে যাচ্ছেন জমি থেকে। অসময়ে এ তরমুজ বাজারে বিক্রি হয় ৮০-৯০ টাকা কেজি দরে এবং জমির পাশে রাস্তায় বিক্রি হয় প্রতি কেজি ৪০-৫০ টাকা দরে।
কথা হয় তরমুজ ক্ষেত দেখতে আসা ইলিয়াস, আলমগীর হোসেন, কনকসহ বিভিন্ন উপজেলা থেকে আসা বেশ কয়েক জনের সঙ্গে। তারা বলেন, অসময়ে তরমুজ চাষ হচ্ছে এবং এর ফলনও বেশ ভালো। এছাড়া স্বাদ ও গুনগতমান ভালো হওয়ায় এখন আগ্রহভরে তরমুজ চাষের জন্য পরমর্শ নিতে আমাদের মতো অনেকেই আসছেন।
জয়পুরহাট পৌরশহরের তরমুজ ব্যবসায়ী সুমন কুমার বলেন, আওলাই ইউনিয়নের উৎপাদিত তরমুজগুলোর গুনগত মান অনেক ভালো। এ এলাকার তরমুজগুলো বিষ ও ফরমালিন মুক্ত হওয়ায় ক্রেতাদের চাহিদা অপনেক বেশি। বর্তমানে প্রতি মণ তরমুজ ১ হাজার ৮শ থেকে ২ হাজার টাকা পর্যন্ত কিনে ঢাকা, রাজশাহী, বগুড়া, নওগাঁ, নাটোর সহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পাঠানো হচ্ছে।
জানা গেছে, ২০১৮ সালে স্থানীয় বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থা এহেড সোস্যাল অর্গানাইজেশন এসো সর্ব প্রথম জয়পুরহাট জেলার পাঁচবিবি উপজেলার আওলাই ইউনিয়নের ভাড়াহুত গ্রামের কৃষক আবু মুসা মাত্র আড়াই শতক জমিতে মাচায় বস্ন্যাকবেরি মধুমালা তরমুজ চাষ শুরু করেন। মাত্র ৫ থেকে ৬ হাজার টাকা খরচ করে এ তরমুজের চাষ করে ৭০ দিনে লাভ হয় ২২ হাজার টাকা। তার এ সাফল্য দেখে জেলার বিভিন্ন এলাকায় তরমুজ চাষ চড়িয়ে পড়ে। বর্তমানে জেলার তিনটি উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় প্রায় ৪০০ বিঘার বেশি জমিতে এই তরমুজের চাষ চলছে।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মোঃ শফিকুল ইসলাম ও এসো এনজিও নির্বাহী পরিচালক মোঃ মতিনুর রহমান বলেন, কৃষি অফিস ও এনজিওর উদ্বুদ্ধকরনের মাধ্যমে এলাকার কৃষকেরা অসময়ে মাচায় তরমুজ চাষ করে সফলতা পেয়েছেন। ফলে আগামী বছরে এ জাতের তরমুজ চাষে কৃষকদের আগ্রহ আরও বৃদ্ধি পাবে বলে আশা করা যাচ্ছে।
তিনি জানান, জেলার তিনটি উপজেলয় প্রায় ৪০০ বিঘারও বেশি জমিতে এবার মাচায় তরমুজ চাষ হয়েছে। ইয়োলো, গ্রিন, বস্ন্যাকবেরি, মধুমালা, জেসমিন ও তাইওয়ানের গোল্ডেন ক্রাউনসহ কয়েক জাতের তরমুজ চাষ এখানে হচ্ছে। এলাকারয় তরমুজ চাষের জন্য কৃষকদের উন্নত জাতের বীজ সংগ্রহের পরামর্শ এবং বালাইনাশক ব্যবহারের ক্ষেত্রে উপযুক্ত প্রশিক্ষণের মাধমে উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে। নতুন পদ্ধতির এ তরমুজ চাষ করে বাড়তি আয় হওয়ায় অর্থনৈতিকভাবেও স্বাবলম্বী হচ্ছেন জেলার কৃষকরা। সফল হওয়ায় এ তরমুজ চাষ নিয়ে এলাকার কৃষকের মাঝে ব্যাপক সাড়া পড়েছে।