নওগাঁ প্রতিনিধি:
গরমের তীব্রতা আর ঘন ঘন লোডশেডিং এর কারণে কদর বেড়েছে তালপাতার তৈরি হাতপাখার। তালপাতার হাতপাখার কদর বেড়ে যাওয়ায় স্থানীয় অর্ধশতাধিক পরিবারে ফিরে এসেছে কর্মচঞ্চলতা। তালপাতার হাতপাখা তৈরি করে সচ্ছলভাবে জীবিকা নির্বাহের আশায় উপজেলার পাখা গ্রামের অর্ধশতাধিক পরিবার বরাবরই বছরের এ সময় নিজেদেরকে ব্যাপকভাবে নিয়োজিত করেন হাতপাখা তৈরির কাজে। যত গরম তত কদর। এ ছাড়াও বৈশাখে অনুষ্ঠিত গ্রামীণ মেলা গুলোতে পাখার চাহিদা থাকে দেখার মত। আর এ কদর থেকেই ব্যাপক সফলতা পাচ্ছেন পাখা কারিগররা।
রান্না করার পাশাপাশি চলছে হাতপাখা তৈরির কাজ। উঠানে বিশ্রামের সময় গল্প করতে করতেও চলছে পাখা তৈরির কাজ। ১০ বছরের শিশু থেকে ৭০ বছরের বৃদ্ধা পর্যন্ত করছেন এ কাজ। যে গ্রামে প্রতিনিয়তয় এমন দৃশ্য চোখে পড়বে সেই গ্রামের নাম ভালাইন হলেও পাখা তৈরির কাজে নিয়োজিত অর্ধশতাধিক পরিবারের কারণে গ্রামটি এখন পাখা গ্রাম হিসেবেই পরিচিত। নওগাঁর মহাদেবপুর উপজেলা সদর থেকে প্রায় ৭ কিমি. দক্ষিণ-পূর্বে উত্তরগ্রাম ইউনিয়নে অবস্থিত এ ভালাইন গ্রাম। সাজানো-গুছানো এ গ্রামটি যেন হাতপাখার রাজ্যে পরিণত হয়েছে। তালপাতার নানা ডিজাইনের হাতপাখা তৈরি ও বিক্রি করাই এ গ্রামের মানুষের অন্যতম পেশা। এ গ্রামের গৃহবধূরা সারাক্ষণ ব্যস্ত থাকেন তালপাতার নজরকাড়া হাতপাখা তৈরির কাজে। এখানকার অর্ধশতাধিক পরিবারের শত শত সদস্যগণের জীবন-জীবিকা নির্ভর করে তাল পাতার তৈরি হাত পাখায়। প্রতি বাড়িতেই এ সময় চলে ধুম করে পাখা তৈরির কাজ। এ সময়গুলোতে যেন কারো ফুরসত নেই। বাড়ির মেয়েরা ব্যস্ত পাখা তৈরির কাজে। পাখা তৈরি ও সুতা দিয়ে বাঁধাইয়ের কাজটি বাড়ির মেয়েরাই করে থাকেন। বিভিন্ন স্থান থেকে তালপাতা সংগ্রহ, পাতা ছাঁটাই ও তৈরি পাখা বিক্রির কাজ করেন বাড়ির পুরুষ সদস্যরা।
পাখা গ্রামের পাখা কারিগর সালমা বানু জানান, বিয়ের পর শ্বশুর বাড়ির অন্যান্যদের সহায়তায় তিনি এখন পাখা তৈরিতে পারদর্শী হয়ে উঠেছেন। তালের পাতা মাপমত কাটা ও ছাঁটাই থেকে শুরু করে কয়েক ধাপে শেষ হয় পাখা তৈরির কাজ। পাখা তৈরির শেষ ধাপে রয়েছে সুতা দিয়ে বাঁধাই। সালমা জানান, তিনি এখন প্রতিদিন প্রায় ৬০ থেকে ৭০টি পাখা প্রস্তুত করতে পারেন। সালমার এখন প্রতিদিন গড় আয় ৩শ’ থেকে ৩৫০ টাকা। পাখা তৈরি থেকে পাওয়া আয়ের এ টাকা দিয়ে সংসার চালানোর পাশাপাশি সস্তানকে লেখাপড়া করানোর দায়িত্ব বহন করেন তিনি। শুধু সালমা নয়, এ গ্রামের ফাতেমা, শিউলি, মোরশেদা, আসিয়া, পারুলসহ অধিকাংশ পরিবারই পাখা তৈরি ও বিক্রির উপর নির্ভরশীল। পাখা কারিগর পারুল জানান, গরমকালে পাখার চাহিদা ও দাম দুটোই বাড়ে। শীতকালে পাখার চাহিদা না থাকার কারণে ও মজুদ করে রাখারমত সামর্থ্য না থাকায় পেটের দায়ে অল্প দামে মহাজনদের কাছে তারা পাখা বিক্রি করতে বাধ্য হয়। কারিগররা জানান, একটি পাখা তৈরি করতে ৭ থেকে ৮ টাকার উপরে খরচ হয়। সেই পাখা তারা ২ থেকে ৩ টাকা লাভে মহাজনদের কাছে বিক্রি করে দেন। মহাজনরা রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন বাজারে ওই পাখা ১৫ থেকে ২০ টাকায় বিক্রি করেন। এতে পাখার মহাজনরা শুধুমাত্র পুঁজি খাটিয়ে বেশি লাভবান হলেও হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করে পাখা তৈরি করেও লাভবান হতে পারে না তারা।
পাখার মহাজন ওসমান আলী জানান, এখানে তৈরিকৃত পাখার মান ভালো হওয়ায় বাজারে চাহিদা বেশি। এতে শীত মৌসুমে পাখার বাজারে চাহিদা না থাকায় অতি কম মূল্যে কারিগরদের কাছ থেকে প্রায় ৫ হাজার পাখা ক্রয় করে রেখেছেন। বর্তমানে ক্রয় করে রাখা পাখা বাজারে দ্বিগুণ মূলে বিক্রি হচ্ছে।
প্রবীণ পাখা তৈরির কারিগর কাশেম আলী জানান, বিদ্যুৎ আসার আগে হাতপাখার আলাদা একটা কদর ছিল। বাজারে পাখার মূল্যও ভালো পাওয়া যেত। এখনো পাখার চাহিদা আছে তবে আগের মত নয়। এক সময় এ জেলায় প্রচুর পরমান তালপাতা পাওয়া যেত। যা এখন আর তেমন পাওয়া যায় না। ফলে অনেক দূর-দূরান্ত থেকে তালপাতা সংগ্রহ করতে হয়। ফলে খরচ বেশি হয় লাভ কমে যায়।
স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান হাসান আলী জানান, পাখা গ্রামের বাসিন্দারা সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত অনেক কষ্ট করে এক একটি পাখা তৈরী করে। তবে তাদের কষ্টের তুলনায় তারা সঠিক মূল্য পায়না। অভাব-অনটনের সংসারে শীত মৌসুমে তাদের তৈরি পাখা বাজারে তেমন চাহিদা থাকে না ফলে মহাজনদের কাছে অল্প দামে পাখা বিক্রয় করে দেয়। কেউ কেউ আবার দাম ধরে আগাম টাকা নেয়। পাখার কারিগরদের অভাবের কারনে পাখা মজুদ করে রাখা সম্ভব হয় না। এতে লাভের অংশ চলে যায় মহাজনদের ঘরে। সরকারি ও বেসরকারিভাবে সহজ শর্তে কারিগরদের ঋণ সুবিধা দিতে পারলে মহাজনদের হাত থেকে রেহায় পাবেন হাত পাখায় জীবন জীবিকা বাঁধা এ মানুষগুলো।