একটা সময় ঢাকায় ব্যান্ড পার্টি ছাড়া বিয়েই হতো না। ধনী-গরিব নির্বিশেষে সব শ্রেণিপেশার মানুষের বিয়েতেই থাকতো ব্যান্ড পার্টি। কিন্তু আধুনিকতার ছোঁয়ায় সেই চিত্র পাল্টে গেছে। এখন ব্যান্ড পার্টির দেখা খুব একটা যায় না। বিয়েবাড়িতে নেই ব্যান্ড পার্টির সেই প্যাঁ পো আওয়াজ। ঐতিহ্যবাহী ব্যান্ড পার্টির এমন উৎসব থেকে ক্রমেই হারিয়ে যাচ্ছে সুরের ফেরিওয়ালারা। কালেভদ্রে দু'একজায়গায় ব্যান্ড পার্টির দেখা মিললেও এখন বেশিরভাগই জায়গা পেয়েছে সাউন্ড সিস্টেম, ডিজে।
খুব বেশি দিন আগের কথা নয়। যখন রাজধানীতে বিয়ের আয়োজনে বাদ্য-বাজনা আর ঢাক ঢোলের আওয়াজ থাকতো। ব্যান্ড পার্টির সদস্যদের মাথায় থাকতো রং বেরঙের টুপি। গায়ে ঝলমলে রাজকীয় পোশাক। হাতে একেক ধরনের বাদ্যযন্ত্র দিয়ে সাজানো বহর। যেকোনো উৎসবে নজর কাড়তো এরা। শুধু বিয়ে নয়ই নয়, কারও জন্মদিনে, মাজারে সিন্নির দিনে, আকিকা, সুন্নতে খাৎনাসহ যেকোনো অনুষ্ঠানে সবার আগে ডাক পড়তো ব্যান্ড পার্টির। কিন্তু সময়ের সঙ্গে বিলীন হয়ে যাচ্ছে সুরের এ ধ্বনি তরঙ্গ। ডিজিটাল যুগে এসে কেউ ব্যান্ড দল ভাড়া করতে চায় না। ডিজিটালাইজেশনের এই যুগে ডিজে ছাড়া পুরনো ব্যান্ড পার্টি কেউ নিতে চায় না বিয়ে বাড়িতে। এর ফলে কর্মহীন হয়ে পড়ছে এই পেশার সঙ্গে যুক্তরা।
ব্যান্ড দল বিয়েবাড়ি'র সদস্য ভৈরব চন্দ্র রায়। ১৯৬০ সাল থেকেই ব্যান্ড দলের সঙ্গে কাজ করে আসছেন। তাঁর বাবাও ছিলেন এ পেশায় ৷ ১৫ বছর বয়সে বাবার সঙ্গে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যেতেন তিনি। সেখান থেকে আস্তে আস্তে হয়ে যান ব্যান্ড দলের সদস্য। এখন তাঁর বয়স ৮০র কাছাকাছি। এখনোও যুক্ত আছেন ব্যান্ড দলের সঙ্গে। আগের মতো কাজ করতে না পারলেও ভালোবাসার পেশাটাকে কখনো ছাড়তে পারেননি।
ভৈরব চন্দ্র বলেন, ‘মানুষ যত বড়ই হোক না কেন তাঁর শেকড় যেন ভুলে না যায়। আমি জীবনের প্রায় ৬০ বছর মানুষকে আনন্দ দিয়ে পার করেছি। যতদিন বেঁচে আছি ততদিন মানুষকে আনন্দ দিতে চাই। যখন কারও বিয়ে হয় আর আমি সানাই বাজাই তখন আমার খুব ভালো লাগে। আমি কাজকে কখনো ছোট করে দেখিনি। দুই বেলা পরিবার নিয়ে খেতে পেয়েছি এটিই আমার জন্য যথেষ্ট ছিল। আগে অনেক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতাম। কিন্তু এখন সেভাবে ডাক পাইনা। বয়সও এখন বড় বাধা। তবুও মাঝেমধ্যে সানাই বাজাই। ঢোল তবলায় সুরের মুর্ছনা তুলি। মানুষকে আনন্দ বিলিয়ে বেড়াই।’
ব্যান্ড পার্টির সঙ্গে যুক্ত অনেকেই এখন জীবিকার তাগিদে অন্য পেশায় চলে গেছেন। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, যেখানে আগে সপ্তাহে ৩ থেকে ৪টা অনুষ্ঠানে ডাক পড়ত, সেখানে এখন মাসে একবারও ডাক পড়ে না। তাই বাধ্য হয়েই অনেকেই অন্য পেশায় নিজেকে জড়িয়েছেন। অক্টোবর থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত সবচেয়ে চাহিদা থাকতো তাদের। অনেক সময় সিরিয়ালও পাওয়া যেতো না। আর এখন উৎসবের ভরা মৌসুমেও ডাক পড়ে না! তবুও অনেকেই এখনো এই ঐতিহ্যবাহী ব্যান্ড পার্টিকেই শেষ সম্বল হিসেবে আকড়ে ধরে রেখেছেন। কারণ তাদের পুর্বপুরুষেরাও এই পেশার সঙ্গেই যুক্ত ছিলেন। বাপ দাদার এই পেশাকে ছাড়তে নারাজ অনেকেই। তাই অনেক কম রোজগারের ফলেও কেউ কেউ আগলে ধরে আছেন ঐতিহ্যবাহী পেশাটিকে।
পুরান ঢাকায় এখনো কিছু ব্যান্ড দল রয়েছে। তবে, আগের মতো কাজ না থাকায় অধিকাংশ সদস্য ব্যান্ড দল ছেড়ে অন্য কাজ করেন। কোনো অনুষ্ঠানের আমন্ত্রণ পেলে সকল কাজ ফেলে আবার একত্রিত হয় দলের সবাই। অনুষ্ঠানে ডাক পেলে তবেই সবাই একত্রিত হয়ে অনুষ্ঠান সম্পূর্ণ করে।
পুরান ঢাকার ব্যান্ড পার্টি ‘সুরের মেলা’। এর মালিক নির্মল গুহ। তিনিই এখন সুরের মেলা পরিচালনা করেন। ১৯৫০ সাল থেকে নির্মলের দাদা শঙ্কর গুহ সর্বপ্রথম এই ব্যান্ডটি চালু করেন। পুরান ঢাকার নাজিরাবাজার থেকে শুরু হয় এই ব্যান্ডের যাত্রা। এরপর শঙ্করের মৃত্যু হলে নির্মল গুহের বাবা হরিদাস গুহের কাঁধে এসে পড়ে ব্যান্ডের দায়িত্ব। এভাবেই এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মের কাঁধে এসে পড়ছে ব্যান্ডের দায়িত্ব।
নির্মল গুহ জানান, আমাদের এই ব্যান্ড অনেক পুরনো। আমার বাপ দাদাসহ অনেকেই ব্যান্ডের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। আমিও পারিবারিক ব্যান্ডের দায়িত্ব নিয়ে পরিচালনা করছি। আগে ব্যান্ডের অনেক প্রচলন ছিল। কিন্তু সময়ের সঙ্গে হারিয়ে যাচ্ছে ঐতিহ্যবাহী এ শিল্প। আজ থেকে ১০-১৫ বছর আগেও আমাদের এত পরিমাণ কাজ আসতো যে আমরা সব অনুষ্ঠান করতে পারতাম না। কিন্তু এখন সপ্তাহে একটা বা মাসে দুয়েকটা অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ পাই। ব্যান্ডের এই দুর্দশায় রোজগারের পরিমাণ কমে গেছে। তাই অনেকেই বিভিন্ন কাজের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন। অনুষ্ঠানে ডাক পেলে সকলে একত্রিত হই।
সনাতন ধর্মাবলম্বী এক মেয়ের বাবা তার মেয়ের বিয়েতে একটি ব্যান্ড দলকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। বিয়ের আয়োজন নিয়ে বলেন, আমার একমাত্র মেয়ে- তাই ধুমধাম করেছি। ব্যান্ড দলকে আনা হয়েছে দুই দিনের জন্য। তারা দুই দিন টানা ঢোল, বাঁশির সুরে সবাইকে মুগ্ধ রাখবে এই ছিল চিন্তা।
আগেরকার বিয়েগুলো এমনই হতো জানিয়ে তিনি বলেন, আমাদের সময় যখন বিয়ে হয়েছে তখন ঢাক-ঢোল পিটিয়ে, সানাই বাজিয়ে হৈ-হুল্লোড়ের মধ্যে বিয়ে হয়েছে। যেগুলো এখনো মনে পড়লে অন্যরকম এক ভালোলাগা কাজ করে। আগেরকার দিনের বিয়ে মানে ছিল অন্য রকম উত্তেজনা। কিন্তু এখন আর সেসবের দেখা মেলে না। এখন সবাই চায় চুপচাপ কোনো হৈ-হুল্লোড় ছাড়াই বিয়ের কাজটা সেরে ফেলতে। কিন্তু মানুষ একবারই বিয়ে করে আর সেটি যদি ব্যান্ডের তালে তালে উৎসবমুখর না হয় তাহলে তো কোনো আনন্দই থাকবে না। তাই আমার মেয়ের বিয়েতে আমি ব্যান্ড দল ভাড়া করে এনেছি। যেন বিয়েটা জমজমাটভাবে হয়। আমার নাতি-নাতনিরা যেন বলতে পারে আমার বাবা মায়ের বিয়ে কেমন ধুমধাম করে হয়েছিল।
১৫ বছরের মধ্যেই পাল্টে গেলো ব্যান্ড পার্টির স্বর্ণযুগ। ২০০০ সনের পরেও বেশ জনপ্রিয় ছিল এই দলগুলো। কেউ বাবা-কাকাকে দেখে হাতে তুলে নিয়েছিলো ট্রাম্পেট, ক্ল্যারিনেট, স্যাক্সোফোন, সানাই, ড্রাম বা ঝুনঝুনি। অথচ সেই যন্ত্রগুলো সময়ের স্রোতে বড় ভারি লাগে অনেকের কাছে! এই ভারি লাগার কারণ গুরুত্ব কমে যাওয়া, আয় কমে যাওয়া।
জোহর উদ্দিন এখন আর সানাই বাজান না। সুর তোলেন না। তবে ভালোবাসার কমতি নেই। ঢাকা মেইলকে তিনি বলেন, সানাই বাজানো ছেড়েছি আরেও পাঁচ বছর আগে। বাবা-চাচারা যে শিক্ষা দিয়েছিল অনেকদিন সেই সুর তুলেছি এখন আর সাউন্ড সিস্টেমের কাছে এই সুর ভালো লাগে না। তাই ছেড়ে দিয়ে ব্যবসা করছি। সময় যাচ্ছে বয়ে। পরিবর্তন আসছে জগৎ সংসারে। এর মধ্যে কতো কিছু যুক্ত হয়ে আবার কতো কিছু নীরবেই হারিয়ে যায়। ব্যান্ড পার্টি এখন অনেকের কাছে সোনালি অতীতের মতো...।