অনার্স-মাস্টার্স পাস করে চাকরির সন্ধানে ছিলেন উম্মে সাদিয়া (ছদ্মনাম)। এর মাঝেই ফেসবুকে পরিচয় হয় বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের (বাপাউবো) তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (যান্ত্রিক) মো. আনিসুর রহমানের সঙ্গে একপর্যায়ে তাদের মধ্যে গড়ে ওঠে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। সেই সম্পর্ককে বেশ ভালোভাবেই কাজে লাগিয়েছেন ওই প্রকৌশলী।
চাকরি দেওয়ার স্বপ্ন দেখিয়ে বছর পঁচিশের ওই তরুণীর কাছ থেকে হাতিয়ে নেন ১০ লাখ টাকা। দীর্ঘ দিনেও চাকরি দিতে না পারায় টাকা ফেরত চাইতে আনিসুরের তেজকুনীপাড়ার ১০৫/২ নম্বর বাসায় যান ওই তরুণী। আপ্যায়নের আড়ালে কোকের সঙ্গে মিশিয়ে খাওয়ান চেতনানাশক। অচেতন হতেই কেড়ে নেন তার সম্ভ্রম। শুধু তাই নয়, ধর্ষণের চিত্র গোপনে ভিডিও ধারণ করে তা ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দিয়ে ওই চাকরিপ্রার্থীকে বছরজুড়েই ভোগ করেন আনিসুর রহমান।
এসব অভিযোগ এনে গত বছরের ২৯ অক্টোবর প্রকৌশলী আনিসুর রহমানের বিরুদ্ধে ঢাকা মহানগর হাকিমের আদালতে (১৪ নম্বর কোর্ট) পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইনে মামলা দেন সাদিয়া। ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ দিদার হোসাইনের নির্দেশে সেই মামলার তদন্ত শেষে অভিযুক্তের বিরুদ্ধে গত ৩০ এপ্রিল আদালতে অভিযোগপত্র (চার্জশিট) দেন ধানমন্ডি থানার এসআই মধুসুদন মজুমদার। চার্জশিট আমলে নিয়ে গত ২৫ আগস্ট আনিসুর রহমানের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা (ওয়ারেন্ট) জারি করেন আদালত। কিন্তু রহস্যজনক কারণে ধরা পড়ছেন না প্রকৌশলী আনিসুর।
এদিকে ভুক্তভোগী তরুণী প্রকৌশলী আনিসুরের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ জানিয়ে বাপাউবোর মহাপরিচালকের দপ্তরেও লিখিত অভিযোগ দেন। ঘুষ-সম্ভ্রম হারানোর বিস্তারিত ঘটনা লিখে জানান সাদিয়া। কিন্তু আনিসুর রহমানের টিকিটিও ছুঁতে পারেনি বাপাউবো কর্তৃপক্ষ। উল্টো মামলা তুলে না নিলে বিশেষ একটি গোয়েন্দা সংস্থাকে দিয়ে ভুক্তভোগী তরুণীকে তুলে নেওয়ার হুমকি দিয়ে যাচ্ছেন ওই প্রকৌশলী। হুমকিতে এখন ঘর ছেড়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন বাদী। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের মহাপরিচালক ফজলুর রশিদ আমাদের সময়কে বলেন, ‘তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো. আনিসুর রহমানের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের বিষয়ে আমি অবগত নই। বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে।’
আনিসুর রহমানের ক্ষমতার কাছে পুলিশও জানি অসহায়! গ্রেপ্তারি পরোয়ানা নিয়েও অভিযুক্ত ঘুরে বেড়াচ্ছেন প্রকাশ্যে। অফিসে গিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন দিব্যি। যদিও পুলিশের দাবি, ওয়ারেন্টভুক্ত ওই আসামিকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। ভুক্তভোগীর স্বজনরা অবশ্য জানিয়েছেন, টাঙ্গাইলের দেওলা এলাকায় গ্রামের বাড়িতে গত শুক্রবার আনিসুরের অবস্থান নিশ্চিত করলেও সাড়া দেননি ওয়ারেন্ট তামিলকারী কর্মকর্তা টাঙ্গাইল সদর থানার এসআই। আসামির অবস্থান শনাক্তের পরও ওয়ারেন্টভুক্ত আসামিকে গ্রেপ্তার না করার বিষয়ে জানতে চাইলে টাঙ্গাইল সদর থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মো. শামীম হোসেন বলেন, ‘এই ওয়ারেন্টের বিষয়ে আমি অবগত নই। এসআই আমিনুলের অভিযোগের বিষয়টি খতিয়ে দেখা হবে। সেই সঙ্গে দ্রুত সময়ের মধ্যে ওয়ারেন্ট তামিল করে আদালতের নির্দেশ পালন করা হবে।’
অভিযোগ সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন দাবি করেছেন প্রকৌশলী আনিসুর রহমান। গতকাল সোমবার দুপুরে তিনি আমাদের সময়কে বলেন, ‘চাকরির কথা বলে ওই তরুণীর কাছ থেকে ১০ লাখ টাকা ঘুষ নেওয়া এবং ধর্ষণের যে অভিযোগ তিনি তুলেছেন, তা অসত্য। অনৈতিক সুবিধা নেওয়া এবং আমার সামাজিক মর্যাদা ক্ষুণের উদ্দেশ্য চক্রটি নানা অভিযোগ তুলছে।’ আদালতে দাখিল করা ধর্ষণের ভিডিওর বিষয়ে তিনি বলেন, ‘এই আধুনিক প্রযুক্তির যুগে সব কিছুই সম্ভব। যদি আদালতে এমন কিছু মেয়েটি দিয়ে থাকে তা অবশ্যই এডিট করা ও সাজানো।’ মামলা উঠিয়ে না নিলে তরুণীকে তুলে নেওয়ার হুমকির অভিযোগ প্রসঙ্গে প্রকৌশলী আনিসুর রহমান বলেন, ‘এটি কোনো কথা হলো, তাকে উঠায় আনতে হবে কেন? আমি যদি চাই ও-তো সুড় সুড় করে চলে আসবে! মামলায় চার্জশিটের বিষয়ে আমি জানি না।’ অফিসের কাজে ব্যস্ততার দোহাই দিয়ে এর বেশি কথা বলতে অপারগতা প্রকাশ করেন এই প্রকৌশলী।
এদিকে প্রকৌশলী আনিসুর রহমান তার বিরুদ্দে আনা অভিযোগ ভিত্তিহীন বলে দাবি করলেও তদন্ত কর্মকর্তা চার্জশিটে উল্লেখ করেন- আনুষঙ্গিক কার্যাক্রমের পাশাপাশি জব্দকৃত আলামত (বাদী-আসামির তিনটি ঘনিষ্ঠ ছবি, তাদের অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ধারণকৃত ভিডিও) পরীক্ষা করানো হয়। এ বিষয়ে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) এসআই ও আলোকচিত্র বিশারদ রিপন হালদার মতামত দেন, ভিকটিমের নমুনা ছবির সঙ্গে অশ্লীল স্থিরচিত্র থাকা নারীর ছবি ও ভিডিওতে সংরক্ষিত ভিডিওচিত্রে থাকা নারীর ছবির মিল রয়েছে এবং তা এডিট করা হয়নি।
তদন্তে পাওয়া তথ্যের বরাত দিয়ে এসআই মধুসুদন মজুমদার চার্জশিটে আরও উল্লেখ করেন, বাদীর সঙ্গে মামলার এজাহারভুক্ত পলাতক আসামি আনিসুর রহমানের ফেসবুকের মাধ্যমে পরিচয়। পানি উন্নয়ন বোর্ডের একজন বড় প্রকৌশলী পরিচয় দিয়ে তিনি বাদীকে চাকরি দেওয়ার আশ্বাস দেন। সেই সঙ্গে বাদীর কাছ থেকে বায়োডাটা এবং বিভিন্ন সময়ে ১০ লাখ টাকা নেন। কিন্তু চাকরি না দিয়ে তিনি বাদীকে ঘুরাতে থাকেন। একদিন টাকা ফেরত দেওয়ার কথা বলে আসামি তার তেজকুনীপাড়ার বাসায় তরুণীকে নিয়ে যান। কিন্তু বাসায় কেউ না থাকায় সন্দেহ হলে বাদী চলে আসতে চান। এ সময় আসামি আনিসুর রহমান জোর করে তাকে কোক খাওয়ান। তার সঙ্গে ছিল চেতনানাশক। ফলে বাদী নিস্তেজ হয়ে পড়লে আসামি তাকে ধর্ষণ করেন। জ্ঞান ফিরলে বাদী নিজেকে আসামির বিছানায় বিবস্ত্র অবস্থায় দেখেন। কোনো মতে সেখান থেকে বাসায় চলে আসেন ওই তরুণী। পরবর্তী সময় শারীরিক মেলামেশার জন্য আসামি ফের তার বাসায় যেতে বললে বাদী রাজি হননি। এ সময় তিনি হুমকি দেন যে, ধর্ষণের সেই দৃশ্য ভিডিও ধারণ করা আছে। আমার কথামতো না চললে সেই ভিডিও ইন্টারনেটে ছেড়ে দেওয়া হবে। অগত্যা পারিবারিক ও সামাজিক অবস্থান বিবেচনায় আসামির কথায় সায় দিতে বাধ্য হন তরুণী। তদন্তকালে প্রাপ্ত সাক্ষ্যপ্রমাণ ও আলামত পরীক্ষার রিপোর্ট পর্যালোচনা এবং ঘটনার পারিপার্শ্বিকতায় বাদীর অভিযোগ ২০১২ সালের পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইনের ৮ (১)/৮ (২) ধারার প্রমাণিত হয়। কিন্তু ব্যাপক চেষ্টার পরও আনিসুর রহমানকে গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়নি।