
ভয়ঙ্কর সব প্রতারণা হচ্ছে ডিজিটাল মাধ্যমে। সময়ের সঙ্গে বাড়ছে প্রতারকের সংখ্যাও। বদলাচ্ছে প্রতারণার ধরন। প্রতারকরা নানা কৌশলে অর্থ হাতিয়ে নিয়ে নিঃস্ব করছে মানুষকে।
সম্প্রতি মোনার্ক (monarch.compan) নামের দুবাইভিত্তিক প্রতিষ্ঠানটি দেশজুড়ে ডিজিটাল প্রতারণার ভয়ঙ্কর ফাঁদ পেতেছে। ইউনাইটেড টোকেন নামে ক্রিপ্টোকারেন্সি বাণিজ্যের প্রলোভন দেখিয়ে প্রতিষ্ঠানটি ইতোমধ্যে কয়েকশ মানুষের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা তাদের পকেটে নিয়েছে। যদিও মোনার্কের বাংলাদেশে এ বাণিজ্যের কোনো বৈধতা নেই। এমনকি এখানে তাদের কোনো অফিসও নেই। অবশ্য অফিস না থাকা এবং এদেশে ক্রিপ্টোকারেন্সি বাণিজ্যের বৈধতা না থাকার বিষয়টি অকপটে স্বীকার করেন মোনার্কের বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর ইঞ্জিনিয়ার মুজাহিদ।
অনুসন্ধানে জানা যায়, ইঞ্জিনিয়ার মুজাহিদের নেতৃত্বে একটি চক্র মোনার্কের এজেন্ট হিসেবে দেশজুড়ে প্রতারণার ভয়ঙ্কর ফাঁদ পেতেছেন। চক্রের প্রথমসারির অন্য দুই সদস্য- রিপন আহম্মেদ ও কালাম। এছাড়া তাদের সাথে রয়েছে মনির হোসেন নামে একজন। তিনি প্রতিষ্ঠানটির লিগ্যাল অ্যাডভাইজার হিসেবে রয়েছে বলে জানা যায়।
তারা এমএলএম ব্যবসার আদলে দেশজুড়ে নেটওয়ার্ক মার্কেটিং করছে। বিভিন্ন মাধ্যমে শিক্ষিত বেকার ও সদ্য অবসরপ্রাপ্ত চাকরিজীবীদের দ্বিগুণ, তিনগুণ লাভের প্রলোভন দেখিয়ে বিভিন্ন অভিজাত রেস্তোরাঁয় নিয়ে সেমিনারের মাধ্যমে ব্যবসার পলিসি দেখিয়ে আকৃষ্ট করছে। এমন কয়েকটি সেমিনারের ভিডিও ফুটেজ এ প্রতিবেদকের হাতে এসেছে।
ওই ভিডিও ফুটেজের সূত্র ধরে অনুসন্ধানে আরো জানা যায়, গত ২৩ অক্টোবর মোনার্কের প্রতিনিধি মার্টিন কারুস দুবাই থেকে বাংলাদেশে আসে। ওইদিন থেকে তিনি ঢাকা, সিলেট, চট্টগ্রাম ও খুলনার বিভিন্ন অভিজাত রেস্তোরাঁয় সেমিনার করে কয়েকশ মানুষকে তাদের ফাঁদে ফেলে কোটি কোটি টাকা তাদের পকেটে নিয়েছে। এসব টাকা অবৈধভাবে বিদেশে পাচার হচ্ছে। মোনার্কের ডিজিটাল ওয়ালেটে ক্রিপ্টোকারেন্সি বাণিজ্যে যুক্ত হতে তারা ২৫০ ইউরো থেকে সাড়ে ১২ হাজার ইউরো পর্যন্ত কয়েকটি প্যাকেজে ইউনাইটেড টোকেন কেনার অফার দিচ্ছেন। কেউ লগ্নি করতে আগ্রহী হলে তার কাছ থেকে সমপরিমাণ টাকা নগদ পেমেন্ট নিয়ে তাদের নির্দিষ্ট অ্যাপে একটি আইডি খুলে দেয়া হয় এবং তাদের একটি ইন্টারন্যাশনাল ভিসাকার্ড দেয়াসহ ওই কার্ডের মাধ্যমে বাংলাদেশসহ বিশ্বের যে কোনো লেনদেন করা সম্ভব বলে প্রলোভন দেয়া হয়। এমনকি সাড়ে ১২ হাজার ইউরোর ইউনাইটেড টোকেন কিনলে সাথে সাথে তার ওই অ্যাপে তার আইডিতে ৩০ হাজার ইউরো ব্যালেন্স চলে আসে। যা দিন দিন মূল্যবৃদ্ধির মাধ্যমে লাখ লাখ টাকা আয়ের প্রলোভন দেখানো হয়।
অনুসন্ধানে আরো জানা যায়, ইউনাইটেড টোকেন কেনাবেচা চলে কম্পিউটার, স্মার্টফোন এবং ট্যাবলেটে। নির্দিষ্ট এক্সচেঞ্জে ডিজিটাল ওয়ালেটের মাধ্যমে ইউনাইটেড টোকেন কিনতে হয়, সেখানেই তা জমা থাকে। ওয়ালেটের আইডি এবং পাসওয়ার্ড থাকে, যা ব্যবহার করে তা খুলতে হয়। ওই মুদ্রা বিক্রি করতে হলে ক্রেতাকে ডিজিটাল চাবি (আইডি ও পাসওয়ার্ড) জানাতে হয় বিক্রেতাকে। তবে লগ্নি করার একমাস পর ছাড়া ওই টোকেন বিক্রি করার সুযোগ নেই। এছাড়া ইউনাইটেড টোকেনের কোনো নিয়ন্ত্রক সংস্থাও নেই। তাই এতে লগ্নি করে অর্থ মার গেলে কারো কাছে অভিযোগ জানানো যায় না।
অনুসন্ধানে পাওয়া তথ্যের সত্যতা যাচাই করতে নিজের পরিচয় গোপন রেখে গত মঙ্গলবার এ প্রতিবেদক প্রথমে কথা বলেন প্রতারক চক্রের সদস্য মোনার্কের বাংলাদেশের প্রতিনিধি রিপন আহম্মেদের সঙ্গে। এসময় মোনার্কের ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে যুক্ত হয়ে ক্রিপ্টোকারেন্সি বাণিজ্যে আগ্রহ প্রকাশ করলে তিনি পর দিন বুধবার রাজধানীর রেডিসন ব্লু হোটেলে আমন্ত্রণ করেন এবং সেখানে বিজনেস পলিসি নিয়ে কথা হবে বলে জানান। তার আমন্ত্রণে গত বুধবার বেলা ১১টায় রাজধানীর রেডিসন ব্লু হোটেলের ৩২৭নং কক্ষে কথা হয় মোনার্কের বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর ইঞ্জিনিয়ার মুজাহিদ ও বাংলাদেশে অবস্থানরত দুবাই থেকে আসা মার্টিন কারুসের সাথে। এ সময় তাদের সঙ্গে আলাপকালে অনুসন্ধানে পাওয়া তথ্যের সত্যতা পাওয়া যায়।
মোনার্কের বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর ইঞ্জিনিয়ার মুজাহিদ বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠানটির অফিস না থাকা এবং ক্রিপ্টোকারেন্সি বাণিজ্যের বৈধতা না থাকার বিষয়টি স্বীকার করে বলেন, ব্যবসায় লাভ করতে হলে ঝুঁকি থাকবেই, এটা জেনে-বুঝে এখানে লগ্নি করার পরামর্শ দিয়ে থাকি। আমরা লগ্নি করতে কাউকে বাধ্য করছি না।
মোবাইলফোনে কথা হয় মনির হোসেনের সাথে, তিনিও অকপটে স্বীকার করেন প্রতিষ্ঠানটি বাংলাদেশে যে কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছে এখনো তার কোনো বৈধতা নেই। আপনি একজন আইনজীবী অথচ আপনার সম্পৃক্ততায় চক্রটি অবৈধভাবে তাদের কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে বিষয়টি আপনি কীভাবে দেখবেন- এমন প্রশ্নের সরাসরি জবাব না দিয়ে বিষয়টি এড়িয়ে যান তিনি।
ক্রিপ্টোকারেন্সির মাধ্যমে অর্থ লেনদেনে জড়িত থাকার অভিযোগে রাজধানী ঢাকায় ছয়টি মামলা দায়েরের তথ্য পাওয়া গেছে। সবশেষ ১১ অক্টোবর আরেকটি মামলা হয়েছে। সেই মামলায় গ্রেফতার হয়েছেন পাঁচজন। আর ক্রিপ্টোকারেন্সিতে লেনদেনের চারটি মামলায় বিচারের মুখোমুখি হয়েছেন কয়েকজন।
ঢাকার সাইবার ট্রাইব্যুনালের স্পেশাল পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) নজরুল ইসলাম বলেন, বাংলাদেশের আইনে ভার্চুয়াল মুদ্রার ব্যবহার নিষিদ্ধ। দেশি-বিদেশি কোনো অ্যাপের মাধ্যমেই ভার্চুয়াল লেনদেন করা যাবে না। তবে বাংলাদেশের অনেকে ভার্চুয়াল মুদ্রা ক্রিপ্টোকারেন্সি ব্যবহার করছেন। ঢাকার সাইবার ট্রাইব্যুনালে এমন চারটি মামলার বিচার চলমান।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার ফজলুর রহমান বলেন, নিষিদ্ধ হওয়ার পরও ক্রিপ্টোকারেন্সি ব্যবহার করে অনেকে দেশ থেকে অর্থপাচার করছেন। ইতিমধ্যেই তারা চারটি চক্রকে গ্রেফতার করে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করেছেন।
গত জুলাইয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের জারি করা সবশেষ প্রজ্ঞাপন বলছে, ক্রিপ্টোকারেন্সিতে লেনদেন করা যাবে না। এসব ভার্চুয়াল মুদ্রা কোনো দেশের বৈধ কর্তৃপক্ষ ইস্যু করে না। সুতরাং এই মুদ্রার বিপরীতে কোনো আর্থিক দাবি স্বীকৃতও নয়।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৩০ ধারা অনুযায়ী, ‘কোনো ব্যাংক, বীমা বা অন্য কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠান বা মোবাইলে আর্থিক সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান থেকে কোনো ইলেকট্রনিক বা ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহার করে আইনানুগ কর্তৃত্ব ব্যতিরেকে ই-ট্রানজেকশন করা অপরাধ। এই অপরাধ প্রমাণিত হলে সর্বোচ্চ শাস্তি পাঁচ বছর কারাদণ্ড বা পাঁচ লাখ টাকা অর্থদণ্ড।’
ক্রিপ্টোকারেন্সিতে লেনদেনের অভিযোগে ১০ অক্টোবর রাজধানীর রামপুরা থেকে গোলাম কিবরিয়া এবং এস এম আরিফুল বারী ওরফে সুমনকে গ্রেফতার করে পুলিশের গোয়েন্দা শাখা (ডিবি)। ডিবি বলছে, কয়েক বছর ধরে তারা ক্রিপ্টোকারেন্সিতে লেনদেন করে আসছিলেন। এ ঘটনায় পাঁচজনের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করা হয়েছে।