দেশি বিদেশি পর্যটকে মুখরিত মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বিজড়িত পিরোজপুরের স্বরূপকাঠির আটঘর-কুড়িয়ানার পেয়ারা বাগান এলাকা। উপজেলা সদর থেকে মাত্র প্রায় ১০ কিলোমিটার দুরে অবস্থিত ওই ইউনিয়নে বাংলার আপেল খ্যাত এ জাতের পেয়ারার বাণিজ্যিকভাবে আবাদ চলছে শত বছর পূর্ব থেকে। ওই এলাকার সরু সরু খালের দু’পাড়ের দৃষ্টি নন্দন সারি সারি পেয়ারা বাগান দেখে পর্যটকদের মন জুড়িয়ে যায়।
প্রতিবছর পেয়ারার এই মৌসুমে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে তরুণ-তরুণীসহ বিভিন্ন বয়সের ভ্রমন পিপাসু দর্শনার্থীরা লঞ্চ, বাস ও মাইক্রোবাস সহ বিভিন্ন বাহনে করে এই এলাকায় ঘুরতে আসছেন। এখানে এসে পেয়ারার বাগান ও হাট ঘুরে দেখার জন্য ইঞ্জিন চালিত ট্রলার বা নৌকা ভাড়া করে তাতে চড়ে ঘুরে বেড়ান তারা। পেয়ারা এ মৌসুমে দেশের বিভিন্ন বিভাগ, জেলা, উপজেলা পর্যায়ের উর্ধ্বতন কর্মকর্তা, বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী ও নানা বয়সী ভ্রমণ পিপাসু অসংখ্য দর্শনার্থীরা ভিড় জমান ওই এলাকায়।
সপ্তাহের শুক্র ও শনিবার পর্যটকদের ভিড় বেশি হয়। দেশি পর্যটকদের পাশাপাশি বিদেশি পর্যটকরাও আসছেন এ পেয়ারা বাগানে। গত ৫ বছরে পেয়ারার এ মৌসুমে এই এলাকায় মার্কিন, থাইল্যান্ড ও ইন্দোনেশিয়ার রাষ্ট্রদূত এবং ভারতীয় হাইকমিশনার এই এলাকায় সফরে এসেছিলেন। গ্রামীণ জনপদে বিনোদনপ্রেমীদের জন্য মনোমুগ্ধকর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের পেয়ারা বাগান দিন দিন পরিনত হচ্ছে পর্যটনকেন্দ্রে।
এখানে আগত পর্যটকদের জন্য নেই সেই রকম কোন বিশ্রামাগার, নেই ভালো কোন মানসম্মত খাবার দোকান ও শৌচাঘর। পার্কগুলোতে ঘুরতে আসা পর্যটকদের জন্য বাগানে ঘুরে পেয়ারা পেড়ে খাবার ব্যবস্থা, চা-কফি সপ, শিশুদের জন্য রাইড, ওয়াচ টাওয়ার নির্মাণ করা হয়েছে। ফ্লোটিং পেয়ারা পার্ক ও পিকনিক স্পটে ৩০০ ফুট দীর্ঘ কাঠের দ্বিতল উড়াল সেতু ও ওয়াচ টাওয়ার নির্মাণ করা হয়েছে। আর পার্কে জনপ্রতি টিকেটের মূল্য ৩০ টাকা। ওই এলাকার কিছু শিক্ষিত বেকার যুবক পেয়ারা পার্ক নামে ৩টি মিনি পর্যটনকেন্দ্র গড়ে তুলেছেন।
ফ্লোটিং পেয়ারা পার্ক ও পিকনিক স্পটের মালিক প্রনয় মজুমদার ও অতনু হালদার তনু জানান, পেয়ারা বাগানে আসা পর্যটকদের বিনোদন ও বিশ্রাম দেয়ার পাশাপাশি নিজেদের বেকারত্ব দূর করার লক্ষে তারা ওই পর্যটনকেন্দ্রগুলো গড়ে তুলেছেন। এখানে আগত পর্যটকদের সেবা ও নিরাপত্তা বিধানে তারা স্বেচ্ছাসেবক নিয়োজিত রেখেছেন।
পার্কে ঘুরতে আসা পর্যটক মুনিয়া শরীফ মুনা জানান, এখানকার পরিবেশটা প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরা। একই এলাকার মধ্যে নানা ধরনের আনন্দ উপভোগ করার সুযোগ রয়েছে এখানে। মনোমুগ্ধকর এই এলাকায় ঘুরতে এসে যে কারো মন ভালো হয়ে যায়।
তবে এক প্রকার উশৃঙ্খল পর্যটকদের উচ্চশব্দে সাউন্ডবক্স বাজিয়ে এলাকায় শব্দদূষণ ও বাগানে ঢুকে পেয়ারা গাছের ঢাল ভাংঙ্গাসহ নানা ধরনের অশোভন আচরণে অনেকটাই বিরক্ত এখানকার লোকজন। তাই এখানে আগত পর্যটকদের জন্য উচ্চশব্দে সাউন্ডবক্স বাজানো নিষেধ সহ কিছু নির্দেশনা দিয়েছে স্থানীয় প্রশাসন।
স্বরূপকাঠি উপজেলায় বাংলার আপেল খ্যাত এ জাতের পেয়ারার বাণিজ্যিকভাবে আবাদ চলছে শত বছর পূর্ব থেকে। উপজেলা কৃষি অফিস থেকে পাওয়া তথ্যমতে উপজেলার ২৫ টি গ্রামের ১ হাজার ৯ শত ৩৫ টি বাগানের ৬ শত ৭ হেক্টর জমিতে ২ হাজার ৭০ টি পরিবার এই পেয়ারা চাষের সাথে জড়িত। আর পেয়ারার চাষাবাদ ও বিপণন ব্যবস্থার সাথে ঐ সমস্ত এলাকার প্রায় ৭ থেকে ৮ হাজার শ্রমজীবী মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত থেকে জীবন-জীবিকা নির্বাহ করছে। প্রতিবছর আষাঢ় মাসের মাঝামাঝি সময় হতে ভাদ্র মাসের মাসামাঝি সময় এই দুই মাসকে পেয়ারার মৌসুম হিসেবে ধরা হয়। এবছর প্রতি হেক্টরে ১০ টন করে ফলন হয়েছে।
উপজেলার কুড়িয়ানা, আটঘর, আদমকাঠি, জিন্দাকাঠি, ধলহার, আতা, মাদ্রাসহ ছোট বড় মিলিয়ে অন্তত ১০ টি খালে প্রতিদিনই পেয়ারার ভাসমান হাট বসে। দেখতে অনেকটা ইতালীর ভেনিস শহরের মত তাইতো এই এলাকাটিকে বাংলাদেশের ভেনিস শহরও বলে থাকেন কেউ কেউ। বর্তমানে হাটে পেয়ারা পাইকারিভাবে মন প্রতি ৪০০ থেকে ৬০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
প্রতিবছর পেয়ারার এ মৌসুমে ঢাকা, কুমিল্লা, চাঁদপুর, সিলেটসহ দেশের বিভিন্ন স্থানের এক শ্রেণির পাইকাররা এখান থেকে সরাসরি হাজার হাজার মন পেয়ারা ক্রয় করে লঞ্চ, ট্রাক ও পিকআপ যোগে নিয়ে যায়। অপরপক্ষে স্থানীয় পর্যায়ে এক শ্রেণির ব্যবসায়ীরাও প্রতিদিন শত শত মন পেয়ারা এখান থেকে লঞ্চ, ট্রলার ও ট্রাক যোগে দেশের বিভিন্ন স্থানে চালান দেয়।
পেয়ারার পাশাপাশি এই এলাকায় আমড়া, কলা, লেবু, গাব, নারিকেল, পান ও সুপারী সহ অন্যান্য কৃষিজাতপন্যের ব্যাপক চাষাবাদ হয়।
পর্যটক ও স্থানীয়দের মতে, সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে পেয়ারা বাগান এলাকায় গড়ে উঠতে পারে অপার সম্ভাবনাময় পর্যটনকেন্দ্র এবং এর মাধ্যমে সরকারের আয় হতে পারে বিপুল পরিমান রাজস্ব।
আটঘর-কুড়িয়ানা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মিঠুন হালদার জানান, এই এলাকার পেয়ারা চাষীদের জন্য সরকারিভাবে যদি একটি কোল্ডষ্টোরেজ ও পেয়ারা দিয়ে উৎপাদিত কোন পন্যের কারখানা তৈরি করা হয় তবে এখানকার চাষীরা অনেক লাভবান হবে।
এ ব্যাপারে নেছারাবাদ উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. মাহবুব উল্লাহ মজুমদার জানান, এখানে আসা পর্যটকদের জন্য সরকারিভাবে একটি রেষ্ট হাউজ এবং একটি পার্ক তৈরির কাজ চলমান রয়েছে। এছাড়াও এখানকার পেয়ার চাষীদের জন্য যদি কোন উদ্যোক্তা কোল্ড ষ্টোরেজ বা কোন কারখানা তৈরি করতে চান তাহলে তাকে জমি ও ঋণ প্রদানসহ সার্বিক সহযোগীতা করা হবে।