
হিমালয় সংলগ্ন ভারতের উত্তরাখণ্ড রাজ্যের জোশীমঠ শহরের কাছাকাছি একটি গ্রাম সুনীল। সেখানে দীর্ঘদিন ধরে স্ত্রী-কন্যা নিয়ে বসবাস করতেন ৫২ বছর বয়সী দুর্গা প্রসাদ সাকলানি। দু’বছর আগে তাদের বাড়িতে প্রথম ফাটল দেখা দেয়। এরপর থেকে বহুবার কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ জানিয়েছেন বাড়ি দেবে যাচ্ছে বলে। কিন্তু দীর্ঘসময় এ বিষয়ে ‘কেউ পাত্তাই দেয়নি’।
ভারত সরকার দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোকেও উন্নয়নের আওতায় আনতে চায়। কিন্তু হিমালয় এলাকায় সেটি করার অসুবিধাগুলো চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে জোশীমঠের সমস্যা। শহরটি হাইকার ও সুউচ্চ ধর্মীয় স্থানগুলোতে যাওয়া তীর্থযাত্রীদের জন্য একটি জাম্পিং-অফ পয়েন্ট (নতুন যাত্রা শুরুর জায়গা)।
ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) বরাবরই নিজেদের ধর্মভীরু দেখাতে চায়। কিন্তু তীর্থযাত্রীদের কাছে গুরুত্ব এবং সাম্প্রতিক দাবতে থাকার ঘটনার কারণে জোশীমঠ এখন দলটির জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ মাসের শুরুর দিকে শহরটির বাড়িঘরে দৃশ্যমান ফাটল কয়েকগুণ বেড়ে যাওয়ার পর অবশেষে বিষয়টিতে মনযোগ দিতে শুরু করে কর্তৃপক্ষ। স্যাটেলাইটের তথ্য-চিত্র বলছে, নতুন বছরের মাত্র ১২ দিনে এলাকাটি পাঁচ সেন্টিমিটারের বেশি দেবে গেছে। এর আগে গত বছরের এপ্রিল ও নভেম্বরের মধ্যে দেবেছিল আরও নয় সেন্টিমিটার।
এ অবস্থায় স্থানীয় কর্তৃপক্ষ ওই এলাকায় সব ধরনের নির্মাণকাজ বন্ধ করে দিয়েছে। শত শত বাড়িকে অনিরাপদ ঘোষণা করা হয়েছে এবং দুর্গা প্রসাদ সাকলানি ও তার পরিবারসহ স্থানীয় বাসিন্দাদের অস্থায়ী বাসস্থানে স্থানান্তরিত করা হয়েছে। সাকলানি পরিবারের পাঁচজন এখন একটি হোটেলে বসবাস করছেন। সরকার তাদের ক্ষতিপূরণ হিসেবে দেড় লাখ রুপি দিয়েছে। সাকলানি জানিয়েছেন, বিষয়টিতে ‘কর্মকর্তারা এখন অন্তত খেয়াল করছেন’।
জোশীমঠ দেবে যাওয়ার সাম্প্রতিক কারণ হতে পারে ভূগর্ভস্থ জলাশয় ফেটে যাওয়া। এটি কী কারণে ঘটেছে তা নিয়ে তদন্ত চলছে। কিন্তু ১৯৭০-এর দশকেই অঞ্চলটি দেবে যাওয়ার উচ্চ ঝুঁকিতে থাকার কথা জানানো হয়েছিল। সেসময় একটি সরকারি কমিশন জানিয়েছিল, অতীতে ভূমিধসে জমা বালি ও পাথরের ওপর গড়ে ওঠার কারণে জোশীমঠ বৃহৎ উন্নয়নকাজের উপযোগী নয়। এছাড়া, গলে যাওয়া হিমবাহগুলো ভূপৃষ্ঠকে আরও আলগা করে দেওয়ায় বিপদ বেড়েছে বলে মনে করছেন উত্তরাখণ্ডের ভূতাত্ত্বিক সরস্বতী প্রকাশ সাতি। তিনি বলেন, আশপাশের শহর-গ্রামগুলোও একই সমস্যায় আক্রান্ত। এরপরও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পর্যটকদের আকৃষ্ট করার জন্য পরিকল্পিত বড় বড় নির্মাণ প্রকল্পগুলোর বিরোধিতা হয়েছে সামান্যই। এ নিয়ে সাতির প্রশ্ন, বৈজ্ঞানিক গবেষণা ও প্রতিবেদনগুলো যদি কখনো কার্যকর করাই না হয়, তাহলে সেগুলো দিয়ে কাজ কী?
স্থানীয় অনেকেই কেন্দ্রীয় সরকারের সমর্থনে হিন্দু তীর্থস্থানগুলোর মধ্যে নির্মিত একটি রাস্তা ও একটি জলবিদ্যুৎ প্রকল্পকে জোশীমঠের সাম্প্রতিক বিপদের জন্য দায়ী করেছেন৷ অতুল সাতি নামে স্থানীয় এক অধিকারকর্মী বলেন, বছরের পর বছর শহরটিকে রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়েছে সরকার। এমনকি দুই বছর আগে ভূমিধসে ২০০ জন নিহত হওয়ার পরেও উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। স্থানীয় একটি হিন্দু মঠের প্রধান সাংবাদিকদের বলেছেন, উন্নয়নকাজের মাধ্যমে ‘হিমালয় অঞ্চলের পরিকল্পিত ধ্বংসযজ্ঞ’ ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র হিসেবে জোশীমঠের টিকে থাকাকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলেছে।
সরকার অবশ্য এই বিপদের জন্য তার উন্নয়ন প্রকল্পগুলো দায়ী বলে স্বীকার করে না। তবে তারা জনমত নিয়ে চিন্তিত। চলতি মাসের মাঝামাঝি দেশটির জাতীয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ উত্তরাখণ্ডের কর্মকর্তা ও বিজ্ঞানীদের গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করতে বলেছে। যে ওয়েবসাইটে জোশীমঠ দেবে যাওয়ার গবেষণা তথ্য প্রকাশ করা হয়েছিল, সেখান থেকে তা অদৃশ্য হয়ে গেছে। এ কারণে কারও কারও আশঙ্কা, সরকার হয়তো বিষয়টিকে ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করছে।